Home সম্পাদকীয় কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আর কত দূর?

কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আর কত দূর?

- ফাইল ফটো।

।। ড. আলী আল গামদি ।।

পাকিস্তান প্রত্যাবাসন পরিষদ (পিআরসি) সম্প্রতি জেদ্দায় ভারত কর্তৃক কাশ্মিরের দখলদারিত্বের বিষয়ে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করেছিল। উল্লেখ্য, পাক-ভারত উপমহাদেশ বিভক্তির সময় চুক্তি অনুযায়ী মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ কাশ্মির অবশ্যই পাকিস্তানে যোগদানের কথা ছিল।
বিষয়টি নিয়ে সিম্পোজিয়ামে আলোচনা করার সময় বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি কাশ্মিরকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার ব্যাপারে গুরুত্বারোপ করেন। কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান ভারতের সাথে কয়েকবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছিল। আলোচকেরা কাশ্মিরিদের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দেয়ার ব্যাপারে যে নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছিল কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রস্তাবে তার উল্লেখ করে কাশ্মিরিদের ‘অবশ্যই আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে’ বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। তারা প্রায় ৭০ বছর আগে জাতিসঙ্ঘ কাশ্মিরে গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে যে প্রস্তাব পাস করেছিল, পাকিস্তান সরকারকে তা বাস্তবায়নের জন্য দাবি জানানোর অনুরোধ করেন। তারা পাকিস্তান ভেঙে নতুন দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটার সময় বাংলাদেশে আটকেপড়া, পাকিস্তানি নাগরিকদের প্রতি তাদের দায়িত্ব পালনের জন্যও ইসলামাবাদের প্রতি আহ্বান জানান।

সমাবেশে বক্তৃতা করতে গিয়ে কাশ্মির বিষয়ে একটি সিম্পোজিয়ামের আয়োজন করার জন্য পিআরসিকে ধন্যবাদ জানাই। কাশ্মির সঙ্কট হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন ইস্যু। ভারতীয় উপমহাদেশে ব্রিটিশের ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটার পর ভারত ও পাকিস্তানের স্বাধীনতা লাভের পরপরই এই সমস্যার সৃষ্টি হয়।

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং সর্বভারতীয় মুসলিম লীগের নেতৃত্বে উপমহাদেশের মানুষের দীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে দু’টি দেশের স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল। তখন উপমহাদেশকে ভারত ও পাকিস্তান নামক দু’টি রাষ্ট্রে বিভক্ত করার জন্য ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এই তিন পক্ষের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। টু নেশন থিওরি তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান এবং হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে ভারত গঠিত হলো। তখন প্রিন্সলি স্টেট তথা রাজা কর্তৃক শাসিত রাজ্যগুলোকে ভারত অথবা পাকিস্তানে যোগদানের স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। এই তত্ত্বের ভিত্তিতে রাজা কর্তৃক শাসিত অন্যতম রাজ্য কাশ্মিরের অবশ্যই পাকিস্তানে যোগদান করা উচিত ছিল। কারণ কাশ্মিরের ৯০ শতাংশেরও বেশি জনগণ হলো মুসলিম; কিন্তু উপমহাদেশ বিভাজনের সময় কাশ্মিরের শাসক ছিলেন একজন হিন্দু। তিনি কোনো দেশের সাথে যোগ না দিয়ে স্বাধীন থাকতে চাইলেন; কিন্তু শিগগির তিনি উপলব্ধি করলেন, স্বাধীন থাকা সম্ভব হবে না। তাই তিনি ভারতে যোগদান করাকে অগ্রাধিকার দিলেন।

যাই হোক না কেন, এটা পাকিস্তান মেনে নিতে পারেনি। কারণ, পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য কাশ্মিরের কৌশলগত গুরুত্ব এবং কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা হচ্ছে মুসলিম। এ কারণে স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই অবিলম্বে কাশ্মির নিয়ে পাকিস্তান ও ভারত প্রথম যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপে যুদ্ধ বন্ধ হয় এবং উভয়পক্ষকে যুদ্ধবিরতিতে বাধ্য করা হয়। আন্তর্জাতিক সংস্থা কাশ্মিরি জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের জন্য গণভোট অনুষ্ঠানের জন্য কয়েকটি প্রস্তাব পাস করেছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছেÑ এ ধরনের গণভোট অনুষ্ঠানের ব্যাপারে প্রথম প্রস্তাব আসে স্বাধীন ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওয়াহের লাল নেহরুর কাছ থেকে; কিন্তু উপমহাদেশ ভাগ হওয়ার পর কাশ্মিরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে অজুহাত তুলে ভারত পরবর্তীকালে কাশ্মিরে গণভোট অনুষ্ঠানে অস্বীকৃতি জানায়।

কাশ্মিরে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে শেখ মুহাম্মদ আবদুল্লাহ জয় লাভ করেন। তিনি ভারতের ফেডারেল রাষ্ট্রের অংশ হিসেবে কাশ্মিরকে ভারতের সাথে রাখার প্রতি সমর্থন জানান এবং দাবি করেন, নির্বাচনের ফলাফল প্রকৃতপক্ষে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারের মতো একই; কিন্তু পাকিস্তান এবং কাশ্মিরের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ শেখ আবদুল্লাহর দাবি প্রত্যাখ্যান করেছেন। তারা জাতিসঙ্ঘের অধীনে অব্যাহতভাবে একটি গণভোট অনুষ্ঠানের দাবি জানাতে থাকেন। প্রতিবেশী দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নের ক্ষেত্রে কাশ্মির সমস্যা একটি প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়ায়।

এই সঙ্কটের কারণে প্রতিবেশী দুই দেশ কয়েকবার যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছে এতে উভয়পক্ষে বহু মানুষ হতাহত এবং দুই দেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। দুই দেশ জনসংখ্যা এবং সম্পদের দিক দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় তাদের বহু উন্নয়ন প্রকল্পও বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এতে উভয় দেশের মানুষও ক্ষতির সম্মুখীন হলো।

তাই, জাতিসঙ্ঘের তত্ত্বাবধানে একটি গণভোট অনুষ্ঠান এবং গণভোটের ফল মেনে নিয়ে দীর্ঘ দিনের এই সমস্যার সমাধান করার জন্য জাতিসঙ্ঘের হস্তক্ষেপের ব্যাপারে জোর দিচ্ছি। সঙ্কট সমাধানে জাতিসঙ্ঘকে অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে হবে।

বক্তব্যের উপসংহার টেনে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী কাশ্মিরিদের বৈধ অধিকার তথা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার প্রতিষ্ঠায় কাশ্মিরি জনগণের পাশে দাঁড়ানোর জন্য পাকিস্তান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই। সরকারের প্রতি আটকেপড়া পাকিস্তানিদের সমস্যা সমাধানেও এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছি। পাকিস্তান সরকারের অবহেলার কারণে তাদের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। সরকারের অবহেলায় তাদের পাকিস্তানি নাগরিকত্বের পরিবর্তন হবে না। তাদের বিষয়টি গুরুত্বের সাথে দেখাটা সরকারের জাতীয় নৈতিক এবং মানবিক দায়িত্ব।

মক্কাভিত্তিক মুসলিম ওয়ার্ল্ড লীগের সহায়তায় পাকিস্তান সরকার রাবিতা অনুদানের যে তহবিল গঠন করেছিল সেটা কী অবস্থায় আছে? পাকিস্তান সরকার আটকেপড়া পাকিস্তানিদের বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাবাসনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, বিষয়টি এখন কোন অবস্থায় রয়েছে, তা আমরা জানতে চাই।

লেখক: দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া বিষয়ে বিশেষজ্ঞ সৌদি আরবের সাবেক কূটনীতিক।

সৌদি গেজেট থেকে ভাষান্তর: মুহাম্মদ খায়রুল বাশার