।। মীম মিজান ।।
সাম্প্রতিককালে নারী-শিশু ধর্ষণ, অপহরণ ও হত্যার ঘটনা সমাজে উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। অবলীলায় নির্যাতন, ধর্ষণ, সহিংসতা ও হত্যার শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। কোনোভাবেই যেন লাগাল টেনে ধরা যাচ্ছে না এ পাগলা ঘোড়ার। কোমলমতি শিশু থেকে মায়ের বয়সী নারীরাও হচ্ছেন ধর্ষণের শিকার। ধর্ষক শুধু ধর্ষণ করেই ক্ষান্ত হচ্ছে না, ধর্ষিতাকে ধর্ষণের আগে-পরে অমানবিক শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করছে।
চলন্ত বাস, একাকী বাসায়, কোচিং সেন্টারে এমনকি ক্যান্টনমেন্টের ভেতরেও চলছে এই ধর্ষণ নামক ভয়ানক ভাইরাসের মহরা। ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্রী তনু; গারো তরুণী; একাকী বাসের যাত্রী গার্মেন্টসকর্মী নারী; ভারতের ২০১২ সালের ১৬ ডিসেম্বরের সেই চাঞ্চল্যকর চলন্ত বাসের মেডিক্যাল শিক্ষার্থীকে তার প্রেমিকের সামনে ছয়জন মিলে গণধর্ষণ; বনানীর হোটেলে সাফাতের দেশকে ঝাঁকুনি দেয়া সেই ধর্ষণ; নায়িকা ভাবনাকে ধর্ষণ আমাদের ভাবিয়ে তোলে বারবার।
শিশু ধর্ষণ ও হত্যার কিছু নমুনাঃ খাবারের প্রলোভন দেখিয়ে ঘরে ডেকে নিয়ে রাজধানীর বাড্ডায় তিন বছরের শিশু তানহাকে ধর্ষণের পর হত্যা করে শিপন নামে এক নরপশু। এরপর শিপন লাশটি তানহাদের ভাড়া বাড়ির শৌচাগারে ফেলে যায়। গত ১৮ অক্টোবর দিনাজপুরের পার্বতীপুরে পাঁচ বছর বয়সী এক শিশু নিখোঁজ হয়। পরদিন অচেতন অবস্থায় তাকে পাওয়া যায় বাড়ির পাশের হলুদ ক্ষেতে। অবুঝ শিশুটি যাকে কাকু বলে জানত, সেই নরপিশাচ সাইফুল শিশুটির ওপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে। সাথে তার সহযোগী। শিশুটিকে বাঁচিয়ে রাখতে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গঠিত বোর্ডের সদস্যরা বলেছেন, তাদের চিকিৎসা জীবনে এমন নিষ্ঠুরতা দেখেননি। পাষণ্ডের পাশবিকতায় ভেঙে গেছে শিশুটির প্রজনন হাড়। ব্লেড দিয়ে কাটা হয়েছে বিশেষ অঙ্গ। কী পাষণ্ডতা! কী নির্মমতা! কী পশুত্ব! কী অবক্ষয়ে তলিয়ে যাচ্ছে জাতি ও সমাজ!
এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, গত চার বছরে ১২ হাজার ৮৫টি শিশু হত্যার শিকার হয়েছে। ২০১৬ সালে নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছিল ২১ হাজার ২২০টি। যা আগের বছরের তুলনায়ও বেশি। এটা নিঃসন্দেহে আতঙ্কজনক ঘটনা।
এরকম হাজারো ঘটনা দেখে আমরা অভ্যস্ত। টিভি খুললেই ধর্ষণ ও হত্যার সংবাদ। পত্রিকার পাতায় পাতায় নারী ও শিশু ধর্ষণের পর হত্যার খবর ছেয়ে গেছে।
কিন্তু কেন এই ধর্ষণ? অনেকেই বলেন পোশাকে শালীনতা নেই তাই ধর্ষণের হার বেড়ে গেছে। আমার প্রশ্ন, তাহলে কি একটি তিন বছরের শিশুর কি পোশাকে শালীনতা লাগবে? কেন তবে এই তিন বছরের শিশু হচ্ছে ধর্ষণ ও হত্যার শিকার?
মূল ঘটনা হলো, আমরা তথ্যপ্রযুক্তির ছোঁয়ায় হচ্ছি অত্যাধুনিক। আমাদের হাতের মুঠোয় আজ সারা পৃথিবী। আমরা সারাদিন পড়ে থাকি ঘরে আবদ্ধ হয়ে। চোখ সবার নিবিষ্ট মোবাইল, ট্যাব ও পিসির পর্দায়। সবার স্টোরেজ মেমোরিতে ভরপুর পর্নোগ্রাফিতে। ওয়েবসাইটগুলোতে আছে অবাধ বিচরণ। খেলতে বের হইনা কোথাও। এভাবে এক উন্মত্ত ও উন্নাসিক মানসিক বিকৃতি নিয়ে বাস করছি সবাই।
ডিভাইসগুলোতে যা দেখি তা বাস্তবে করার জন্য মনটাও আনচান করে। আর সেই সাইটগুলোতে বিকৃত মস্তিষ্কের পাশবিকতাও দেখানো হয়। যার ফলে আমরা ভুলে যাই কোনটা নৈতিকতা আর কোনটা অনৈতিক। কোনটা মানবিক আর কোনটা অমানবিক। ফলে বেড়েই চলছে সমাজ বিধ্বংসী এসব কার্যকলাপ।
বড়দের প্রতি নেই সম্মান। ছোটদের প্রতিও নেই আর আগের মতো স্নেহ-মমতা। স্বামীর প্রতি নেই স্ত্রীর আস্থা। স্ত্রীর প্রতিও নেই স্বামীর বিশ্বাস। পরকীয়ায় সবাই মত্ত। বিশ্বাসহীনতার এ সময়ে আরো যোগ হয়েছে বিচার বিভাগের দীর্ঘসূত্রতা। পেশিশক্তির প্রভাবও এই সংস্কৃতির জন্য অনেকাংশেই দায়ী।
– রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে।