।। ফারজানা ইসলাম লিনু ।।
সিলেট এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে এই কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী ফারজানা ইসলাম লিনু সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গত ২৬ সেপ্টেম্বর দুপুরে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন। তার ফেসবুক থেকে ‘উম্মাহ’[ পাঠকদের জন্য তা হুবহু তুলে ধরা হলো-
আগের রাতে গৃহকর্মের ব্যস্ততা ছিলো, তারউপর ছোটখাটো এক দু্র্ঘটনায় আঘাত প্রাপ্ত হয়ে টিভিতে সারাদিনের সালতামামি না দেখেই ঘুমিয়ে পড়ি। প্রত্যুষে বৃষ্টির ঝুমঝুমানিতে মনে মনে ঠিক করি, আজ ছুটির দিন, সকালে ক্লাস নেই, ঘুমাবো ইচ্ছামতো।
বৃষ্টির কান্নায় বিষাদের সুর। ঘুম লাগেনা। ফেসবুক ও টিভি অন করতেই দেখি বিরাট তোলপাড়। এমসি কলেজ ক্যাম্পাস থেকে সন্ধ্যারাতে তুলে নিয়ে স্বামীর সামনে স্ত্রীকে গনধর্ষণ।
ভয়ে, ঘৃনায় কুঁকড়ে উঠে মনটা।
স্মৃতির পরতে পরতে জড়ানো মায়ায় এই কলেজে কেটেছে শিক্ষাজীবনের প্রায় সাতটি বছর। পুত্রকন্যার বাপের এইচএসসি এই কলেজে, আমার অনার্স মাস্টার্স এই কলেজে।
বড় কন্যা এসএসসি পাশ করার পর কলেজে ভর্তির প্রসঙ্গ আসে। পিতা-পুত্রির মিলিত সিদ্ধান্ত চান্স পেলে কন্যা এমসি কলেজেই পড়বে। আমি নারাজ। আবার সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি, ভালো কলেজে পড়াতো গর্বের ও সৌভাগ্যের ব্যাপার।
কর্মজীবি মা আমি, যখন তখন জরুরি প্রয়োজনে মেয়েকে কলেজ থেকে আনা নেওয়া করতে পারবো না। এই যুক্তি শুনে কন্যার ব্যস্ত পিতা আমাকে আশ্বস্ত করলেন। সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বললেন, মেয়েকে আমিই আনা নেওয়া করবো। যেদিন পারবো না সেদিন দেখা যাবে।
সপ্তাহের বেশির ভাগ দিন কলেজ গেইটের সামনের স্যারের বাসা দিয়ে শুরু হতো কন্যার দৈনিক রুটিন। বাপ কন্যার রুটিনের প্রতি খেয়াল রেখে ব্যবসা ও অফিসের কাজে সিলেটের বাইরে যাওয়ার সময় ঠিক করতেন। অতীব জরুরি প্রয়োজনে মেয়ে গাড়িতে, রিক্সায় করে একা আসা যাওয়া করেছে কোন সময়। উদ্বিগ্ন মায়ের উদ্বিগ্নতায় স্বস্তির বদলে কন্যাকে পীড়া দিয়েছে বেশি। কত সময় বিরক্ত হয়ে বলেছে, মা আপনার বেশি বেশি।
আরও পড়তে পারেন-
- ঋণ বা ধারকর্য পরিশোধে ইসলামের বিধান
- কাশ্মীরীরা নিজেদের ভারতীয় মনে করে না, তারা ভারতীয় হতে চায় না
- আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রাহ.): কিছু কথা, কিছু ব্যথা
- ইসলামে সামাজিক সম্পর্ক এবং ভ্রাতৃত্ববোধ বজায় রাখার গুরুত্ব
- ‘গ্যাং’ কালচারের বিরুদ্ধে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা সময়ের দাবী
এম সি কলেজ MUN ক্লাবের সাথে যুক্ত থাকায় কন্যাকে কলেজের অনেক অনুষ্ঠানে যেতে হতো যখন তখন। দুইদিন তিনদিন ব্যাপী অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে রাত হতো প্রায়ই। আমি বিকেল থেকে কলেজে গিয়ে বসে থাকি। অনুষ্ঠানের সমাপনীতে স্যারেরা উপস্থিত থাকলেও আমার উদ্বিগ্নতা কাটেনা। অংশগ্রহণকারী মেয়েদের যাদের অভিভাবক আসতে দেরি হয় আমি তাদেরও সঙ্গ দেই।
আসার পথে আয়োজক কন্যার সাথে ক্যাঁও,ক্যাঁও করি, প্রোগ্রাম আরো জলদি শেষ করতে পারো না? কন্যা বিরক্ত হয়ে বলে, কতো মানুষ এইখানে, আপনি শুধু শুধু ভয় পাচ্ছেন। এতো টেনশন নিয়ে আমাকে নিতে আসেন কেন? বাফন আসলে তো এমন করেন না।
অসহায় মায়ের যন্ত্রণা মেয়েকে বুঝাতে পারিনা। খালি বলি, তুই মা হলে বুঝবি?
মায়ের উৎকন্ঠায়, উদ্বিগ্নতায় মেয়ের কলেজ জীবন প্রায় শেষ।
কলেজের সমাপনী অনুষ্ঠানের শেষলগ্নে মেয়েকে আনতে গেলাম যথারীতি। কাচুমাচু মুখ করে বেরিয়ে আসে মেয়ে।
জিজ্ঞেস করলাম, কি হয়েছে?
অনুষ্ঠান মাঝপথে শেষ হয়ে গিয়েছে।
কেন?
রাজনৈতিক দলের বড় ভাইরা কি জানি ঝামেলা করেছে। খাবারের প্যাকেট হাতে দিয়ে আমাদেরকে বলা হয়েছে চলে যেতে।
একটু এগিয়ে গিয়ে কিছু অভিভাবক ও জটলা থেকে যা জানলাম তা নিয়ে সেদিন লিখার সাহস হয়নি আমার। কারণ আমিওতো মরুভূমিতে মুখ গুজে থাকা এক উটপাখি।
অনুষ্ঠানে আগত একছাত্রী তার ছেলেবন্ধুকে নিয়ে ছবি তুলছে। এই দৃশ্য কলেজের নেতৃস্থানীয় বড় ভাইদের সহ্য হয়নি। কলেজের পরিবেশ বিনষ্টকারী(!) এই জুটিকে তারা বার বার উত্যক্ত করে।
একপর্যায়ে ছেলে মেয়ে দুজনকে নাকি তারা আটকে রাখে একটা কক্ষে।
এমসি কলেজে প্রেম ডেটিং করবে আর তাদেরকে তোয়াজ করবে না তা কি করে হয়। অশ্লীল ভাষা ব্যবহার করে হুমকি ধামকি ও টাকা দাবি করা হয়, আটকে রাখা হয় ছেলেটার দামি মটর সাইকেল। মেয়েটার অভিভাবকের ফোন নাম্বার দিতে চাপ প্রয়োগ করা হয়।
মধ্যস্থতাকারী আরো কিছু ভাই বন্ধুর সহায়তায় দিন শেষে পনেরো হাজার টাকার বিনিময়ে মটর সাইকেল সহ যুগল ছাড়া পায়।
উপস্থিত সমবেত অভিভাবকদের তর্জনী প্রেমিক যুগলের উপর। তাদের কথা হলো মেয়েটা তার বহিরাগত ছেলে বন্ধুকে নিয়ে না আসলে কলেজের বড় ভাই রূপী অভিভাবকরা এমনটা করতো না।
বুঝলাম যত দোষ ঐ মেয়েটার।
আমার বিবেকের অতল গহীনে কেবল একটা প্রশ্ন উঁকি দিলো, কোন মেয়ে কার সাথে প্রেম করবে,কোথায় প্রেম করবে তার দায়িত্ব কি কলেজের বড় ভাইদের?
প্রশ্নটা তাৎক্ষনিক আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেলো।আমি জানি কেউ আমার প্রশ্নটা স্বাভাবিক ভাবে নেয়নি।
চাপা গুঞ্জন, ছেলে মেয়েদের অবাধ প্রেমের প্রশ্রয় দিয়ে সমাজে বিনাশ ডেকে নিয়ে আসে আমার মতো অসভ্য মহিলারা।
প্রতিবাদ আমার এতোটুকুতেই সীমাবদ্ধ ছিলো। উপস্থিত সুধীমহলের কথার আক্রমণ আমি একা সামলাতে পারবো না, কন্যা আমাকে কথা বাড়াতে দেয়নি।
প্রতিবাদ না করার পেছনে আবার কলেজের বড় ভাইদের আতংক তো আছেই। সেই আতংকতো আজকে নতুন না। আড়াই যুগ আগে আমাদের ছাত্র জীবনেও এমনটা ছিলো। খালি দলীয় পরিচয় আর ব্যক্তি পরিচয় ভিন্ন ছিলো। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন সর্বকালে, সর্বসময়ে সকলের অভিভাবক। কলেজ কর্তৃপক্ষও তাদের তোয়াজ করতে বাধ্য।
তাইতো তাদের তান্ডবের শিকার এমসি কলেজে বেড়াতে আসা জুটি ও দর্শনার্থীরা।
কলেজ ক্যাম্পাসে বহিরাগতদের আগমন নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব কলেজ কর্তৃপক্ষের। অথচ প্রায়ই শুনা যায় ছাত্র সংগঠন অমুক, তমুক জুটিকে ডেকে শাসিয়ে তাড়িয়ে দিচ্ছে।
তাদের বাপের সম্পত্তি কলেজ ক্যাম্পাসকে জুটিমুক্ত করে নিজের অপকর্মের অভয়াশ্রম বানিয়ে ধর্ষনের ষোলকলা পূর্ণ করছে আজ।
আমাদের অজান্তে কত ঘটনা ঘটে যায়,সব খবর আমাদের গোচরে আসেনা। সামাজিক ও পারিবারিক সম্মানের কথা চিন্তা করে ভুক্তভোগীরা নিভৃতে সহ্য করে যায় সেই কষ্টের কাহন। প্রতিবাদ না করতে করতে আজ বিবাহিত এক তরুণী এই অসুস্থ বড় ভাইদের লালসার শিকার।
মর্মান্তিক এই ঘটনার দ্রুত বিচার না হলে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠান বারবার কলংকিত হবে, কুলুষিত হবে পশুদের হাতে। [ ২৬শে সেপ্টেম্বর, ২০২০ সাল]
– ফারজানা ইসলাম লিনু
শিক্ষক, কথাসাহিত্যিক।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ