Home ইতিহাস ও জীবনী মানুষ গড়ার কারিগর শায়খ জিয়া উদ্দীন: দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিদীপ্ত আলেম হিসেবে তিনি...

মানুষ গড়ার কারিগর শায়খ জিয়া উদ্দীন: দৃঢ়চেতা ও বুদ্ধিদীপ্ত আলেম হিসেবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত

।। মুফতি এনায়েতুল্লাহ ।।

‘ব্যক্তিত্ব’ মানুষের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোর অন্যতম। এ বৈশিষ্ট্যটি একজন ব্যক্তির চরিত্রের অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের সঙ্গে পার্থক্যসূচক; যা সহজেই অন্যান্য বৈশিষ্ট্যের ওপর প্রাধান্য বিস্তারের ক্ষেত্রে সমুজ্জ্বল। একজন ব্যক্তির পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থান, শিক্ষার মান এবং পদমর্যাদাভেদে আচরণ যথাযথ বিবেচিত হলে তিনি ব্যক্তিত্ববান হিসেবে পরিগণিত হন। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক পরিবেশ সুস্থ, সুন্দর ও সাবলীল হলে তা ব্যক্তিত্বের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। একজন ব্যক্তিত্ববান মানুষ কথা ও কাজে এবং চলনে বলনে সবসময় ধীরস্থির প্রকৃতির হয়ে থাকেন। ব্যক্তিত্ববান মানুষের আচরণ মার্জিত ও পরিশীলিত হওয়ায় স্থান-কাল-পাত্রভেদে তিনি বেশি গ্রহণযোগ্য হন।

এমনই একজন ব্যক্তিত্ব নিয়ে আজকের আলোচনা। বৃহত্তর সিলেটের সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেমেদ্বীন আল্লামা শায়খ জিয়া উদ্দীন।

মাওলানা জিয়া উদ্দীন, অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে সাহসীকন্ঠ। দ্বীনী শিক্ষার চর্চা ও বিকাশের আদর্শ পথিকৃৎ। ধর্মীয়, সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনের অভিজ্ঞ নেতা। বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে তিনি নাজিম সাহেব হুজুর নামে সমধিক পরিচিত।

বহুদর্শী, চিন্তাশীল কীর্তিমান এ আলেম সিলেটের ঐতিহ্যবাহী ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরের পরিচালক। বর্ষীয়ান আলেম, বরেণ্য শিক্ষাবিদ, অভিজ্ঞ রাজনীতিক এবং ইসলামি চিন্তাবিদ হিসেবে সর্বমহলে তার সুখ্যাতি রয়েছে।

সততা, ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, নিরহঙ্কারিতা প্রভৃতি গুণ মানুষকে মহিমান্বিত করে তোলে। যেকোনো দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসন, আইন-আদালত, শিক্ষাজ্ঞান, চিকিৎসাব্যবস্থা প্রভৃতিতে এমন ব্যক্তিত্ববানদের সরব উপস্থিতি ওই দেশকে সব দিক থেকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেয়। এমন ব্যক্তিত্ববানরা নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য বিষয়ে সচেতন বিধায় তার দ্বারা অন্যের অনিষ্ট ও ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে না। মাওলানা জিয়া উদ্দীন সেই কাতারেরই একজন মানুষ। তার বিশাল কর্মময় জীবনকে অল্প পরিসরে বয়ান করা কঠিন।

জননন্দিত এ আলেম ১৯৪১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেট জেলার বিয়ানীবাজার উপজেলার কাকরদিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুকাদ্দাস আলী (রহ.) ছিলেন কোরআনের হাফেজ। আর ধর্মভীরু নারী হিসেবে এলাকায় পরিচিত ছিলেন মা খায়রুন্নেছা বেগম (রহ.)। তিন ভাই ও দুই বোনের সংসারে মাওলানা জিয়া উদ্দীন দ্বিতীয় সন্তান।

আরও পড়তে পারেন-

মাওলানা জিয়া উদ্দীন মা-বাবার কাছে অক্ষরজ্ঞান এবং বুনিয়াদি শিক্ষার প্রাথমিক জ্ঞান লাভ করেন। পরে গ্রামের মক্তবে তার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সূচনা হয়। মক্তবে প্রাথমিক স্তরের শিক্ষাগ্রহণ শেষে ১৯৫৩ সালে ভর্তি হন গ্রামের পাঠশালায়। ১৯৫৫ সালে প্রাইমারি শিক্ষা শেষ করে ১৯৫৬ সালে মাথিউরা ঈদগাহ বাজার মাদরাসায় ভর্তি হন। শিক্ষা জীবনের নানা পর্যায়ে দারুল উলুম দেউলগ্রাম মাদরাসা ও গাছবাড়ি জামিউল উলুম মাদরাসায় পড়ালেখা শেষে ১৯৬২ সালে চলে যান উম্মুল মাদারিসখ্যাত দারুল উলুম হাটহাজারী।

হাটহাজারী মাদরাসায় তিনি ভর্তি হন হেদায়া জামাতে। এখান থেকেই ১৯৬৫ সালে দাওরায়ে হাদিস পাস করেন। পরের বছর হাটহাজারীর তাফসির বিভাগে ভর্তি হন এবং সফলতার সঙ্গে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন।

১৯৬৭ সালে সিলেটের জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। সেই থেকে অর্ধশতাব্দীরও বেশি (৫৩ বছর) সময় ধরে তিনি আঙ্গুরা মাদরাসায় শিক্ষকতা করছেন, এ এক বিরল ঘটনা। এসব অবশ্য ভিন্ন আলোচনা।

আঙ্গুরা মাদারাসায় শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের অল্পদিনেই কর্মদক্ষতা ও যোগ্যতাবলে জনপ্রিয় শিক্ষক হিসেবে সবার নজর কাড়েন। মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা মুহতামিম মাওলানা শায়খ শিহাব উদ্দীন রহমাতুল্লাহি আলাইহি মাওলানা জিয়া উদ্দীনের কর্মতৎপরতা দেখে দুই বছরের মাথায় তাকে জামেয়ার শিক্ষাসচিবের দায়িত্ব দেন। শিক্ষাসচিব মানে নাজেমে তালিমাত। সেই থেকে তিনি নাজেম সাহেব হুজুর নামে পরিচিত পেতে থাকেন, এখনও তিনি এ নামেই সমধিক পরিচিত।

১৯৬৯ সাল থেকে মাওলানা জিয়া উদ্দীন আঙ্গুরা মাদারাসার শিক্ষা বিভাগ সামাল দিচ্ছেন অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে। তার পরিচালনায় আঙ্গুরা মাদারাসার শিক্ষা ব্যবস্থার সুনাম চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে যোগাযোগ সুবিধাবঞ্চিত অজপাড়াগাঁয়ে অবস্থিত জামেয়ায় দূর-দূরান্ত থেকে শিক্ষার্থীরা এসে ভীড় জমাতে থাকেন। অল্পদিনেই জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর সিলেটের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর পুরো কৃতিত্ব মাওলানা জিয়া উদ্দীনের।

ছাত্রজীবনের শেষাংশে আঙ্গুরা মাদরাসায় তার সঙ্গে আমার দেখা হয়েছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনের আগ মুহূর্তে। নির্দিষ্ট সময়ের প্রায় সাড়ে তিন ঘণ্টা বিলম্বে আঙ্গুরা পৌঁছে তার আন্তরিক ব্যবহারে বিস্মিত হয়েছি। তার মতো ব্যক্তি আমাদের অপেক্ষা করছেন! তার চাহনি থেকে শুরু করে কথা বলার ভঙ্গি সবকিছুতেই এক অদ্ভুত সম্মোহনী শক্তি রয়েছে।

২০১০ সালে শিক্ষাসচিবের দায়িত্বের পাশাপাশি তিনি জামিয়ার মুহতামিম পদেও অধিষ্ঠিত হন। বর্তমানে তিনি দুই দায়িত্বই অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সঙ্গে পালন করে যাচ্ছেন। বস্তুত ব্যক্তির তুলনায় কোনো প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনকে প্রকৃত অর্থে ভালো রাখতে হলে ক্ষমতার মোহে আবিষ্ট না হয়ে, বিবেককে জাগ্রত রেখে কাজ করতে হয়। মাওলানা জিয়া উদ্দীনের মাঝে সেই গুণ বিদ্যামান। বিধায়, কোনো ধরনের বিতর্ক ছাড়া এসব দায়িত্ব একনিষ্ঠভাবে পালন করে যাচ্ছেন।

ইতিহাসের পাতায় চলতি বছরটি ‘শোকের বছর’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। বছরজুড়ে আমরা বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষ আলেমকে হারিয়েছি। ওইসব আলেমদের শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়। কিন্তু দ্বিতীয়, তৃতীয় কিংবা পরবর্তী প্রজন্মের সামনে যারা এখনও আশার আলো হয়ে আছেন, বটগাছের মতো নিরবচ্ছিন্নভাবে ছায়া দিয়ে জাতিকে আগলে রেখেছেন- মাওলানা জিয়া উদ্দীন তাদের অন্যতম।

বৃষ্টিতে যেমন ফসলের ক্ষেত সজীব হয়ে ওঠে, পরবর্তীতে সেসব শুকিয়ে মাঠ ফেটে চৌচির হয়ে যায়। তেমনি টগবগে যৌবনেও এক সময় বার্ধক্যের জরা চেপে বসে। তখন অধিকাংশ সময়ে মানুষ আর সুচিন্তা করার সুযোগ পায় না- পার্থিব জীবনটা এমনই। এটা ভুলে থাকার কোনো উপায় নেই। তার পরও আশার আলো হয়ে আমাদের মাঝে এই পাষাণ সময়ে নেতৃত্ব দিয়ে যাওয়া হাতেগোণা কয়েকজন শীর্ষ আলেমদের একজন মাওলানা জিয়া উদ্দীন আছেন- এটাই আমাদের প্রাণে সজীবতা সৃষ্টি করে। গর্বে বুক ফুলে ওঠে, কানে ভেসে আসে সাহসের বাণী; প্রথাগত বিভেদের মাঝেও শোনা যায় ঐক্যের সুর।

জ্ঞানীরা বলেন, ‘যোগ্যতা’ মানুষের একটি গুণ বিশেষ। এ গুণ শুধু প্রথাগত শিক্ষার মাধ্যমে অর্জিত হয় না। যেকোনো কর্মজীবীর জন্য, নেতৃত্বের জন্য- যোগ্যতা অর্জন অপরিহার্য বিষয়। যোগ্যতা ছাড়া যেকোনো দায়িত্বপালন নৈতিকতার পরিপন্থী কাজ। দীর্ঘ ৫৩ বছর ধরে মাওলানা জিয়া উদ্দীন অতুলনীয় যোগ্যতা দিয়ে জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুরে ইলমে দ্বীনের খেদমত করে যাচ্ছেন। হাজার হাজার ছাত্র গড়েছেন। দেশ-বিদেশে হাতেগড়া তার বহু ছাত্র রয়েছে। যারা মুফতি, মুহাদ্দিস, মুফাসসির, ইমাম, খতিব ও গবেষক হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছেন। সুদীর্ঘ অর্ধ শতাব্দীর বেশি সময় ধরে বাংলাদেশে ইসলামি শিক্ষার প্রচার-প্রসার ও শিক্ষকতায় বিরল কৃতিত্বের স্বীকৃতস্বরূপ ২০১৬ প্রিয় ক্যাম্পাস অনলাইন গ্রুপ তাকে বিশেষ সম্মাননা প্রদান করেন।

২০১৭ সালের ১৬ মে ইংল্যান্ডের বার্মিংহামে তাকে নাগরিক সংর্বধনা দিয়ে সম্মানিত করা হয়। ২০১৫ সালে আঙ্গুরা মাদরাসার ফারেগিনরা ‘মুফাক্কিরে ইসলাম’ নামে তার জীবন ও কর্মের ওপর একটি স্মারক বের করেছেন। কওমি শিক্ষাধারায় যে কয়জন জীবন্ত কিংবদন্তী এমন সম্মান পেয়েছেন- মাওলানা জিয়া উদ্দীন তাদের একজন।

মাওলানা জিয়া উদ্দীন বিভিন্ন রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। হাটহাজারী মাদরাসায় পড়ালেখার সময় সক্রিয়ভাবে অংশ নেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক শাসক জেনারেল আইয়ুব খান কর্তৃক আনীত ‘মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১’ এর বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলনে। ওই আন্দোলনে অংশ নিয়ে তিনি গুলিবিদ্ধ হন। ১৯৬৬ সালে চট্টগ্রামে মাজারপন্থীদের সঙ্গে আকিদা ও মাসয়ালাগত বিষয় নিয়ে হাটহাজারী মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকদের দ্বন্দ্ব হয়, দ্বন্দ্ব এক সময় রূপ নেয় সংঘর্ষে। ওই সময়ও মাওলানা জিয়া উদ্দীন মারাত্মকভাবে আহত হন। চিকিৎসাধীন মাওলানা জিয়া উদ্দীনকে হাসপাতালে দেখতে যান- শায়খুল হাদিস আল্লামা আবদুল কাইয়ুম (রহ.) ও শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)সহ হাটহাজারীর শীর্ষ শিক্ষকগণ। এ সময় আল্লামা আবদুল কাইয়ুম তার জন্য একটি আরবি কবিতা আবৃত্তি করেন। আল্লামা আহমদ শফী (রহ.) মাওলানা জিয়া উদ্দীনের ত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানিয়ে নিজ হাতে একটি আবেগপূর্ণ চিঠিও লেখেন। এসব ঘটনা তার জীবনে ব্যাপক প্রভাব সৃষ্টি করে। যে কারণে আন্দোলন-সংগ্রামে তাকে সর্বদা সামনের কাতারে পাওয়া যায়।

স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক আন্দোলন-সংগ্রামে মাওলানা জিয়া উদ্দীন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ, ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্ব দেন। নব্বইর দশকে বিয়ানীবাজারে ইসমতে আম্বিয়া ও খতমে নবুওয়ত আন্দোলন, বিতর্কিত লেখিকা তাসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলন, শাবিপ্রবির হলের নামকরণ বিরোধী আন্দোলন থেকে শুরু করে ফতোয়া বিরোধী রায়ের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা আন্দোলনে তিনি সিলেটে নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিলেন। সিলেট শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থান করে আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া সহজ কাজ নয়। এসব সম্ভব হয়েছে তার দৃঢ়চেতা মনোভাবের কারণে।

২০০৫ সালে ভারতীয় নদী আগ্রাসনের প্রতিবাদে জাতীয় আগ্রাসন প্রতিরোধ কমিটি কর্তৃক আহুত টিপাইমুখ অভিমুখী লংমার্চে তিনি সিলেট বিভাগীয় সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১১ সালের ৮ ডিসেম্বর জমিয়ত উলামায়ে ইসলামের ডাকা টিপাইবাঁধ অভিমুখে রোডমার্চের আহবায়ক ছিলেন। ২০০৮ সালে প্রস্তাবিত কোরআন-সুন্নাহ বিরোধী নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরুদ্ধে সিলেটে ‘কোরআনী আইন সংরক্ষণ কমিটি’র আন্দোলনে তিনি সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন। ২০১৩ সালে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাস্কর্যের নামে মূর্তি স্থাপনের বিরুদ্ধে ‘শাহজালাল ঐতিহ্য সংরক্ষণ কমিটি’র ব্যানারে সর্বদলীয় আন্দোলন গড়ে ওঠে। মাওলানা জিয়া উদ্দীন ওই কমিটির অন্যতম মুখপাত্র হিসেবে সাহসী ভূমিকা পালন করেন।

২০১৩ সালে হেফাজতের আন্দোলনে মাওলানা জিয়া উদ্দীন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সিলেট জেলা হেফাজতের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন তিনি। তার নেতৃত্বে ২০১৩ সালের ১১ এপ্রিল হেফাজতের উদ্যোগে শানে রিসালাত সম্মেলন নামে সিলেটে স্মরণকালের সর্ববৃহৎ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মাওলানা জিয়া উদ্দীন ওই সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এভাবে ২০১৩ সালের ৬ এপ্রিল ঢাকায় হেফাজতের লংমার্চ, হেফাজতের সংবাদ সম্মেলন ও ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকা অবরোধেও তিনি সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ৫ মের রাতে তিনি শাপলা চত্বরে উপস্থিত ছিলেন, এ কারণে পরবর্তীতে তাকে নানা হয়রানির শিকার হতে হয়, তার বিরুদ্ধে ছয়-ছয়টি মিথ্যা মামলা দায়ের করা হয়।

রাজনৈতিকভাবে মাওলানা জিয়া উদ্দীন উপমহাদেশের প্রাচীনতম সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে ইসলামের সঙ্গে জড়িত। রাজনীতির দীর্ঘ যাত্রাপথে প্রথমে জমিয়তে তোলাবায়ে আরাবিয়ার বৃহত্তর সিলেট শাখার সভাপতি, ১৯৮৭ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বিয়ানীবাজার উপজেলার সাধারণ সম্পাদক, ১৯৯৪ সালে সিলেট জেলার সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরপর তিন মেয়াদে তিনি সিলেট জেলা জমিয়তের সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৮ সালে তিনি কেন্দ্রীয় জমিয়তের সহকারী মহাসচিব নির্বাচিত হন। ২০১১ সালে সিলেট জেলা জমিয়তের সভাপতির দায়িত্ব পান। এ বছরই কেন্দ্রীয় জমিয়তের সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। ২০১৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর পুনরায় জেলা জমিয়তের সভাপতি হন। ২০১৫ সালের ৭ নভেম্বরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে তাকে পুনরায সহ-সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ২০১৮ সালে তাকে তৃতীয়বারের মতো সিলেট জেলা জমিয়তের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। জমিয়ত সভাপতি আল্লামা আবদুল মুমিন ইমামবাড়ির ইন্তেকালের পর ২০২০ সালের ৮ এপ্রিল মাওলানা জিয়া উদ্দীনকে কেন্দ্রীয় ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মনোনীত করা হয়।

রাজনৈতিক সক্রিয়তা ছাড়াও মাওলানা জিয়া উদ্দীন বেশ কয়েকটি ধর্মীয় ও সামাজিক সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। দেশের প্রাচীনতম কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড আযাদ দ্বীনী এদারায়ে তালীম বাংলাদেশের সভাপতি তিনি। ১৯৪১ সালের ১৬ মার্চ বোর্ডটি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই বোর্ডের অধীনে ৭৭৮টি মাদরাসা রয়েছে। প্রথমে সিনিয়র-সহসভাপাতি ও ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন শেষে ২০১৮ সালের ১৫ জানুয়ারি তিনি বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন। সিলেট এদারার উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সিলেবাসের আধুনিকায়নে তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে অনুষ্ঠিত (৯-১১) তিন দিনব্যাপী ৩০ সালা দস্তারবন্দী সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন তিনি। এদারার সভাপতি হিসেবে পদাধিকার বলে তিনি কওমি মাদরাসার সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আল হাইআতুল উলিয়া লিল জামিয়াতিল কাওমিয়া বাংলাদেশের সদস্য।

এ ছাড়া তানযীমুল মাদারিস সিলেট, মাদানিয়া কোরআন শিক্ষাবোর্ড, নুরানী তালিমুল কোরআন বোর্ডসহ বেশ কয়েকটি আঞ্চলিক শিক্ষাবোর্ডের উপদেষ্টা হিসেবে তাদের নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সহযোগিতা করে আসছেন।

আঙ্গুরা মুহাম্মপদুর ছাড়াও তিনি জামিয়া কাসিমুল উলুম মেওয়া, জামিয়া হাতিমিয়া শিবগঞ্জ, বাহাদুরপুর জালালিয়া মাদরাসা, আকাখাজানা মহিলা টাইটেল মাদরাসাসহ বেশ কয়েকটি মাদরাসার মুহতামিমের দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে।

আশ শিহাব পরিষদ, ইকরা ফাউন্ডেশন ইউকে, আল হিলাল ছাত্র সংসদ, আল-কলম গবেষণা পরিষদ, চেতনা সাহিত্য পরিষদ, জাগরণ ইসলামি সাংস্কৃতিক পরিষদ, হিজবে এলাহী বিয়ানীবাজারসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক, সাহিত্যসেবী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনেরও উপদেষ্টা তিনি।

আত্মশুদ্ধির ক্ষেত্রে মাওলানা জিয়া উদ্দীন মাওলানা আবদুল মতিন চৌধুরী ফুলবাড়ির খলিফা। শায়খে ফুলবাড়ি মদিনা শরীফে ইতিকাফরত অবস্থায় স্বীয় খলিফা বিয়ানীবাজারের মাওলানা আবদুস সবুরের মাধ্যমে মাওলানা জিয়া উদ্দীনকে তরিকতের ইজাযত দেন।

মাওলানা জিয়া উদ্দীন ১ ছেলে এবং ৬ মেয়ের গর্বিত পিতা। ছেলে মো. সাইফুল আলম ইসলামি ব্যাংকে চাকরি করেন। জেনারেল শিক্ষায় শিক্ষিত হলেও তিনি লেবাস ও সুরতে আলেমদের মতোই। জামাতারাও সবাই সুপ্রতিষ্ঠিত। তার এক জামাতা মাওলানা ফয়যুল হক আবদুল আজিজ ইংল্যান্ডের পরিচিতি ইসলামি মিডিয়া ব্যক্তিত্ব।

দ্বীনি কাজে ও ব্যক্তিগত কারণে তিনি বেশ কয়েকটি দেশ সফর করেছেন। তন্মধ্যে- ইংল্যান্ড, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাত অন্যতম।

মাওলানা জিয়া উদ্দীনের বিশেষ গুণ হলো- স্থানকাল পাত্র বুঝে কাজটা সম্পন্ন করেন। মানুষ চেনার এক অপরিসীম দক্ষতা রয়েছে তার। মানুষকে তার যোগ্যতা অনুযায়ী মূল্যায়ন করতে তিনি কসুর করেন না। উদারমনা, মানুষ গড়ার কারিগর হিসেবে তার ব্যাপক সুনাম রয়েছে। ভিন্নমত ও দলের প্রতি তার শ্রদ্ধাপূর্ণ ব্যবহার মাওলানা জিয়া উদ্দীনকে অন্য উচ্চতায় আসীন করেছে। নিজের দল, মাদরাসার প্রতি শতভাগ দায়বদ্ধ একজন মানুষ তিনি। স্বল্পভাষী হলেও নিজের সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকার এক বিরল গুণ রয়েছে তার।

উদারমনা হলেও নিয়ম ভাঙার নজির নেই। মেধাবী শিক্ষার্থী ও ভালোমানের উস্তাদদের পৃষ্ঠপোষকতা করেন। দলমতের ঊর্ধ্বে ওঠে যোগ্যদের মূল্যায়ন করেন। তার নিলোর্ভী মানসিকতার নানা ঘটনা লোকমুখে প্রচলিত আছে।

রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় ও শিক্ষাক্ষেত্রে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলের একজন আদর্শ অভিভাবক। নিজ কর্মগুণে প্রায় ছয় ফুট লম্বা দেহের অধিকারী এই ব্যক্তিত্ব এখন পরিণত হয়েছেন বিশাল এক বটবৃক্ষে। যার ছায়ায় গড়ে উঠেছে হাজার হাজার ছাত্র, অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ও সংস্থা।

এমন ব্যক্তিত্বসম্পন্ন নেতা আমাদের সমাজে বেশি প্রয়োজন। মাওলানা জিয়া উদ্দীনের নির্লোভী চিন্তা, দৃঢ়চেতা মানসিকতা, দূরদর্শী চিন্তা, সাহসী পদক্ষেপ এবং বুদ্ধিদীপ্ত সিদ্ধান্ত জাতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। তাই নেতা হিসেবে, বুদ্ধিদীপ্ত আলেম হিসেবে তিনি সর্বমহলে সমাদৃত।

দোয়া করি, আলেম-উলামা ও সাধারণ মানুষের এই আস্থা ও বিশ্বাস অক্ষুন্ন থাকুক। দেশ-ধর্ম ও সমাজের প্রতি তার এমন দরদ এবং অভিভাবকত্ব আরও দীর্ঘ হোক। আমিন।

– মুফতি এনায়েতুল্লাহ, বিভাগীয় প্রধান, ইসলাম, বার্তা২৪.কম।

উম্মাহ২৪ডটকম:এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।