Home ইসলাম ‘যাকাত’ ট্যাক্স নয়

‘যাকাত’ ট্যাক্স নয়

- ফাইল ছবি।

।। মাওলানা বাহাউদ্দীন যাকারিয়া ।।

যাকাত কোন ট্যাক্স নয়; বরং এটি একটি মৌলিক ইবাদত। কোন কোন লোকের যাকাত সম্পর্কে নীচু ধারণা রয়েছে।একে রাষ্ট্র কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া ট্যাক্সের মতো মনে করে থাকে। যেমন সরকারের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা ধরনের ট্যাক্স ধার্য করা হয়। যাকাত রাষ্ট্র বা সরকার কর্তৃক চাপিয়ে দেয়া কোন ট্যাক্স নয়। এমন কি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের পক্ষ থেকে ইসলামী সরকারের প্রয়োজনে যাকাতের বিধান আরোপ করেননি। বরং মুসলমানদের বিত্তশালীদের নিকট থেকে যাকাত সংগ্রহ করে অভাবী, দরিদ্র লোকদের মাঝে বন্টন করে দেয়ার নির্দেশ কুরআন-হাদীসে সুস্পষ্ট ভাবে বিবৃত হয়েছে।

এমনিভাব এ কথাও ভাবা ভুল যে, যাকাতদাতা যাকাত দিয়ে দরিদ্র, অভাবী ও মিসকিনদের প্রতি দেয়া করছেন। বরং যাকাত গ্রহণ করে অভাবী, দরিদ্ররাই বিত্তশালীদের ওপর দয়া করছেন। এদের মাধ্যমেই তাদের সম্পদ আল্লাহর ব্যাংকে জমা হচ্ছে। আপনি কি কাউকে ব্যাংকে অর্থ জমা দেয়ার জন্য প্রদান করে কারো প্রতি দয়া করছেন? যদি একে দয়া না বলা হয়, তাহলে দরিদ্র কে যাকাত প্রদান করাও ‘দয়া করা’ বলা যাবে না।

পূর্বের উম্মতের যে সম্পদ আল্লাহর দরবারে কুরবানী হিসেবে পেশ করা হত, তা ভোগ করা কারো জন্য জায়েয ছিল না। কুরবানীকৃত দ্রব্য কুরবানীর স্থানে রাখা হত। আকাশ থেকে আগুন এসে তা যদি ভস্মিভূত করে দিত, তবে তা ছিল কুরবানী কবুল হবার নিদর্শন। আর স্ব অবস্থায় পড়ে থাকাকে প্রত্যাখ্যাত হবার নিদর্শন ভাবা হত।

আল্লাহ তায়ালা এ উম্মতের ওপর বিশেষ দয়া করেছেন। তিনি বিত্তশীলদের নির্দেশ দিলেন যে, তোমরা যা আল্লাহর দরবারে পেশ করতে চাও , তা অমুক অমুক বান্দা (দরিদ্র-মিসকিন)-কে প্রদান কর। এ নির্দেশের মাধ্যমে একদিকে দরিদ্রের প্রয়োজন পুরনের ব্যবস্থা করেছেন, অপরদিকে এ উম্মতকে লাংছনা ও অপমান থেকে রক্ষা করেছেন। এখন আল্লাহই ভাল জানেন, কে হালাল সম্পদ থেকে দান করেছেন, আর কে অপবিত্র সম্পদ থেকে দান করেছেন? কোন ব্যক্তি কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের প্রত্যাশায় দান করেছেন? আর কে সুখ্যাতি, প্রসিদ্ধি এবং লোক দেখানোর উদ্দেশে দান করেছে? আসল কথা হল যাকাত কোন ট্যাক্স নয়; বরং এটি আল্লাহ তায়ালার দরবারে নজরানা পেশ করা। এ জন্যই তো কুরআন মজীদে আল্লাহ তায়ালা একে ‘করযে হাসানা’ বলেছেন। ইরশাদ হচ্ছে-

منً ذَا ا الذي يقرض الله قرضا حسنا فيضاعفه له وله اجر كريم.

অর্থাৎ-  ‘কে আছে এমন; যে আল্লাহ তাযালাকে উত্তম ঋণ দিবে? তাহলে তিনি তা বহু গুণ বৃদ্ধি করে দিবেন এবং তার জন্য রয়েছে সম্মানজনক পুরস্কার।’

এখানে সদকাকে করযে হাসানা এ জন্য বলা হয়েছে যে, যেভাবে ঋণ পরিশোধ করা বাধ্যতামূলক, তেমনিভাবে দানকারী নিশ্চিত থাকতে পারে যে, তার এ দান সহস্র বরকত এবং কল্যানসহ তার নিকট প্রত্যাবর্তন করবে। এমন উদ্দেশ্য নয় যে, আল্লাহর কোন জিনিসের প্রয়োজন আছে।

আরও পড়তে পারেন-

এ কারণে বলা হয়, দানকৃত বস্তু দরিদ্রের হস্তগত হবার পুর্বেই আল্লাহর দরবারে পৌঁছে যায়। ফকির যেন দাতা থেকে প্রাপ্ত হচ্ছ না; বরং আল্লাহ থেকেই প্রাপ্ত হচ্ছে। যিনি সকলেরই দাতা।

ট্যাক্স এবং যাকাতের মধ্যে পার্থক্য হল, সরকার ট্যাক্স নিয়ে নিজ পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যয় করে থাকে। আর যাকাত নির্ধারিত খাত অর্থাৎ গরীব, দরিদ্র, মিসকিন, অভাবীদের মাঝে বন্টন করা হয়। ইসলামে যাকাতের অর্থ ব্যয়ের খাতও নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। (হাকীকাতুয যাকাত- ৫৭, মিসাইলে যাকাত- ৪৬)।

যাকাত এবং ট্যাক্সের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য:

ট্যাক্স দেয়াকে যাকাতের জন্য যথেষ্ট মনে করা কিংবা যাকাতের কিছু অংশ দ্বারা ট্যাক্স আদায় করা জায়েয নয়। যাকাত এবং ট্যাক্সের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যাকাত একটি মৌলিক ইবাদত। এর জন্য নিয়ত করা জরুরী। যাকাত একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য প্রদান করা হবে। যাকাতের প্রাপকও নির্দিষ্ট। এদেরকেই যাকাত প্রদান করতে হবে। অমুসলিম এবং সাধারণ জনকল্যাণমূলক কাজে যাকাতের অর্থ ব্যয় করা জায়েয নেই।

উল্লেখ্য, যাকাত যাদের প্রদান করা হবে, তা তাদের পরিপূর্ণ মালিকানা সত্ত্ব হয়ে যায়।

যাকাত ফরয হবার জন্য শরীয়ত কর্তৃক সম্পদের একটি সীমা নির্ধারিত আছে। অত:পর আদায়যোগ্য হবার জন্য এক বছর সময় দিতে হবে। বিশেষ প্রকার সম্পদে যাকাত ফরয হয়। সব ধরনের সম্পদের ওপর ফরয হয় না। এ সব বিধি-বিধান কুরআন-হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। এতে পরিবর্তন, পরিবর্তনের কোন সুযোগ নেই।

ট্যাক্স হচ্ছে এর বিপরিত। এটি কোন ইবাদত নয়; বরং এটি রাস্ট্রের সহায়তা করা কিংবা রাস্ট্র কর্তৃক সুবিধাপ্রাপ্তির বদলা দেয়া। এর জন্য না কোন পরিমাণ নির্দিষ্ট আছে, না কোন সম্পদকে নির্দিষ্ট করা হয়। ট্যাক্সের জন্য নিয়তের কোন প্রশ্নই আসে না। যাকাতের যারা প্রাপক আর ট্যাক্সের প্রাপক এক নয়। এর জন্য শরীয়ত নির্ধারিত কোন সীমাও নেই। বরং ক্ষেত্র বিশেষ যুলুমের আওতায় পড়ে যায়। (জাদীদ ফিক্বহী মাসাইল ১২৫, মাসাইলে যাকাত ৪৬-৪৭ পৃষ্ঠা)।

আরো একটি উল্লেখযোগ্য পার্থক্য:

যাকাত এবং ট্যাক্সের মধ্যে সবচেয়ে বড় পার্থক্য নামেও পরিলক্ষিত হয়। যাকাত শব্দের অর্থ হচ্ছে পবিত্রতা, প্রবৃদ্ধি ও বরকত। ইসলামী শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত সম্পদের যে অংশ যাকাতদাতা নির্ধারিত খাতে প্রদান করে তাকেই যাকাত বলে। এর দ্বারা যাকাতদাতার মনে এ প্রতিক্রিয়া সৃস্টিই উদ্দেশ্য যে, যাকাত তার বরকত লাভের মাধ্যম হবে। সম্পদে প্রবৃদ্ধি হবে। সর্বপরি তার সম্পদকে করবে পবিত্র।

এর বিপরিত ট্যাক্স বলতে বুঝায় যা যবরদস্তি ও বাধ্যতামূলক সম্পদশালী ব্যক্তির ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। তাইতো মানুষ ক্ষেত্রবিশেষ ট্যাক্স কে বোঝা বা জরিমানা মনে করে থাকে।

যাকাত শব্দ পবিত্রতা, বরকত ও প্রবৃদ্ধির অর্থ বুঝানোর সাথে সাথে এ কথার ইংগিত বহন করে যে, সম্পদশালী ব্যক্তি আল্লাহর হক প্রদান না করে যে সম্পদ জমা করে রাখে তা নাপাক-অপবিত্র হয়ে যায়। যাকাতই তা পবিত্র করতে পারে। সম্পদশালীকে কৃপণতা ও লোভ থেকে রক্ষা করে। যাকাত শব্দ এ কথাও প্রমাণ করে যে, যাকাত প্রদানের কারনে সম্পদে বাহ্যত হ্রাস পাওয়া পরিলক্ষিত হলেও বাস্তবতা এর বিপরিত। বরং যাকাত প্রদানের ফলে সম্পদে প্রবৃদ্ধি লাভ করে।

লেখকঃ প্রিন্সিপাল- জামিয়া হোসাইনিয়া ইসলামিয়া আরজাবাদ-মিরপুর ঢাকা, সহসভাপতি- বাংলাদেশ কওমি মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড (বেফাক), যুগ্মমহাসচিব- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।