Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘আধুনিকতা’ কি তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে?

‘আধুনিকতা’ কি তার প্রতিশ্রুতি পালন করেছে?

।। পিনাকী ভট্টাচার্য ।।

আধুনিকতা কী?

“আধুনিক” শব্দটা যখনই কোন লেখায় ব্যবহার করি এবং আধুনিকতার সমালোচনা করি তখনই এক শ্রেণীর মানুষ এসে বলতে থাকেন আধুনিকতার এতো সমালোচনা করি তবুও কেন কম্পিউটার ব্যবহার করি, কেন ফেইসবুক ব্যবহার করি? যাঁদের কিছু পড়াশোনা আছে তাঁদেরকেও এই ধরণের যুক্তি ইদানিং দিতে দেখছি। তাই আধুনিকতা প্রপঞ্চটা নিয়ে সবিনয়ে একটা সাধারণ ধারণা দিতে চাই।

“আধুনিকতা” বলতে জ্ঞান জগতে যা মীন করা হয় সেটা মানে কোন গ্যাজেট নয়, জীবন যাপন পদ্ধতিও নয়। এটা একটা “চিন্তা কাঠামো”। এই আধুনিকতার চিন্তা কাঠামোটা বুঝতে হলে ইউরোপে ১৭ এবং ১৮ শতকে প্রায় ২০০ বছর ধরে চলা বুর্জোয়া শ্রেণীর মতাদর্শিক ও রাজনৈতিক সংগ্রাম “ এনলাইটেনমেন্ট” নামের সেই লড়াইকে একটু বুঝতে হবে। কারণ এই এনলাইটমেন্টের বিশ্ববীক্ষা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে আধুনিকতার সঙ্গে। এই এনলাইটেনমেন্ট পর্বই আজকের আধুনিক চিন্তা কাঠামোর ভিত্তি তৈরি করে দেয়। তৈরি করে দেই পুঁজিবাদের মনোগাঠনিক ভিত্তি। এনলাইটেনমেন্ট এবং আধুনিকতা একটি বুর্জোয়া মতাদর্শ, এটা অনেক সময় প্রগতিশীল রাজনৈতিক কর্মীরা ভুল করেন সেটা খুব দুঃখজনক।

এনলাইটেনমেন্ট মানে কী?

এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্পের মুখ্য দিক হচ্ছে জীবনকে যুক্তির মাপে বেঁধে ফেলা, এই যুক্তিগ্রাহ্যতার ভিত্তিতে চিন্তার একটা বিশ্বব্যাপী সার্বজনীন পদ্ধতি তৈরি করা আর এই পদ্ধতির বদৌলতে জীবনকে পাল্টে দেয়া। এই এনলাইটেনমেন্ট পর্বেই আমরা পেয়েছি বিশ্বাসের বদলে যুক্তির একচ্ছত্র আধিপত্য। এনলাইটেনমেন্টের বদৌলতে সকল বিষয়ে যৌক্তিকতার দাবী মানুষের মানুষের অনুভব, আবেগ, অনুভুতি, সত্তা, আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতাকে পরাজিত করেছে। যুক্তিই শেষ কথা, যুক্তির বিচারে যে উত্তীর্ণ হতে পারবে না সে পরাজিত এবং তা পরিত্যাগযোগ্য। যুক্তির এই একচ্ছত্র আধিপত্যকে খুব মনোহর মনে হয়। পৃথিবীর চোখ ধাধিয়ে গিয়েছিল এই নতুন চিন্তার দর্শনে।

এনলাইটমেন্টের সমালোচনা

এই এনলাইটেনমেন্টের প্রথম সমালোচনা শুরু হয় ১৮ শতাব্দীতেই প্রথমে নিটসের অনুসারি ম্যাক্স ওয়েবার শুরু করেন এই সমালোচনা। ম্যাক্স ওয়েবার এই এনলাইটেনমেন্টকে বলেছিলেন “আয়রন কেইজ অব ফিউচার”, ভবিষ্যতের যুক্তি শাসিত লোহার খাঁচা। কৌতূহলউদ্দীপক হচ্ছে পুঁজিবাদী সমাজের চিন্তা কাঠামোকে “লোহার খাঁচা” বলে যেই সমালোচনা করা হয়েছে সেই অভিধাটিকেই পাল্টে পুজিবাদ সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর বিরুদ্ধে তার মতাদর্শিক সংগ্রাম চালিয়েছে। পুজিবাদ, সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোকে বলেছে “লৌহ যবনিকার অন্তরালের সমাজ”।

এর পরে ফ্রাঙ্কফুর্ট স্কুলের হর্কহাইমার আর অ্যাডোর্নো লেখেন ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্ট। সেখানে তাঁরা দেখান এই এনলাইটেনমেন্ট কি করে প্রকৃতির উপর মানুষের, শেষে মানুষের উপর মানুষের আধিপত্য তৈরি করে। (মুল বইটা পাবেন এই লিঙ্কে)

হর্কহাইমারের মতে, ফ্যাসিবাদ হচ্ছে বুর্জোয়া ধনতান্ত্রিক সমাজের যান্ত্রিক যুক্তিবাদের সর্বোচ্চ রূপ। এই অবস্থায় এনলাইটেনমেন্ট প্রকল্প সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে চলে গিয়ে এক ধরণের বর্বরতায় রূপান্তরিত হয়। হর্কহাইমারের প্রস্তাব অনুসারে ফ্যাসিবাদ ছিলো যান্ত্রিক যুক্তিবাদ ও শয়তানির সংশ্লেষ।

হর্কহাইমারদের পরে পৌস্ট মডার্ণরা দেখান এই এনলাইটেনমেন্টের ন্যারেটিভগুলো কীভাবে জীবনের একটা সর্বগ্রাসী যুক্তিগ্রাহ্য তত্ত্ব উপস্থিত করে, এই যুক্তিগ্রাহ্যতা মানুষের কল্পনা, মিথ, কবিতা সহ জীবন উপলব্ধির অন্য পদ্ধতিগুলোর উপরে আধিপত্য বিস্তার করে শেষে নির্মাণ করে এক শ্বাসরুদ্ধকর যুক্তি আক্রান্ত বাস্তবতা।

এনলাইটেনমেন্টের ধারনায় দুই ধরণের “যুক্তির ধারণার” সংঘাত হয়। একটি ব্যবহারিক যুক্তি অন্যটি যান্ত্রিক যুক্তি। ব্যবহারিক যুক্তি মানুষের উপর আরোপিত বাধ্যতা থেকে মুক্তির পথ দেখায় কিন্তু যান্ত্রিক যুক্তির একটাই লক্ষ্য সেটা হচ্ছে প্রকৃতির উপর আধিপত্য বিস্তার। আডোর্নো আর হর্কহাইমার ডায়ালেক্টিক অব এনলাইটেনমেন্টে দেখিয়েছেন বর্তমান আধুনিকতার মুল সংকট হলো প্রথম ধরণের যুক্তির উপর দ্বিতীয় ধরণের যুক্তির আধিপত্য।

এনলাইটেনমেন্ট হয়ে দাঁড়ায় চিন্তা ও সংস্কৃতির একমাত্র মানদণ্ড। আর বাকিরা যারা এই এনলাইটেনমেন্টের মানদণ্ডে আধুনিক বলে সার্টিফিকেইট পায় না, তারা হয় অসভ্য, বর্বর ও পশ্চাৎপদ। এই আধুনিকতার চাপে সভ্যতার তলায় থাকা মানুষ, সমাজ ও সংস্কৃতির সৃষ্টিশীল ক্ষমতা সম্পর্কে আধুনিক পৃথিবীর উন্নাসিকতা এনলাইটেনমেন্টের আরেক উপজাত। অনেকে বলেন হিটলারের গ্যাস চেম্বারে ইহুদীদের পুড়িয়ে মারাও এনলাইটেনমেন্টের অবদান। আজকের সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে অনন্ত যুদ্ধও এনলাইটেনমেন্টের অবদান। আর আজকে অ্যামেরিকানরা যেটাকে বলেন “আমেরিক্যান ওয়ে অব লাইফ”, সেটাই কিন্তু এনলাইটেনমেন্ট। এই এনলাইটেনমেন্টের গভীর অসুখ দুই দুইটা বিশ্বযুদ্ধ অনেকটাই উন্মোচিত করেছে, আর বাকিটা করছে বর্তমান বিশ্ব। যার চাপা খেয়ে পৃথিবীর মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে।

আধুনিকতা প্রসঙ্গে হাবারমাসের অবস্থান অবশ্য অন্যদের চাইতে আলাদা। তাঁর মতে আধুনিকতা একটি অসম্পূর্ণ প্রকল্প। তার অপূর্ণ সম্ভাবনার দিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি মনে করতেন আধুনিকতার সীমাবদ্ধতা ও ধ্বংসাত্মক প্রভাবগুলির উত্তরণের জন্য পর্যাপ্ত সম্পদ আধুনিকতার ধারণার মধ্যেই প্রোথিত আছে।

আধুনিকতা মানুষকে মুক্তি দেয়নি, মানুষকে সে বন্দী করেছে যুক্তির খাঁচায়। পদানত করেছে মানুষের সৃষ্টিশীল ক্ষমতাকে। আধুনিকতার তলায় চাপা পরা মানুষেরাই এখন সংখ্যাগরিষ্ঠ। এনলাইটেনমেন্টের সব কিছুই ফেলে দেয়ার মতো সেটা নয়। এই এনলাইটেনমেন্টের আবহেই তৈরি এবং পরিপুষ্ট হয়েছে মার্ক্সের দর্শন। তাই আধুনিকতা নামের এই প্রপঞ্চকে এক কথায় বাতিল করে দেয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি বিনা প্রশ্নে পরিপূর্ণভাবে গ্রহণ করাও প্রাজ্ঞতার পরিচয় নয়। #

লেখক: জনপ্রিয় অনলাইন এক্টিভিস্ট, লেখক, গবেষক ও মানবাধিকারকর্মী।