Home ইসলাম যে শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টায় ইবলিস কখনো ক্লান্ত হয় না

যে শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টায় ইবলিস কখনো ক্লান্ত হয় না

অলংকরণ- উম্মাহ গ্রাফিক্স।

।। ডা. তানজিনা রহমান ।।

আজকাল বোনদের অনেকেই হিজাব পড়ছি, আলহামদুলিল্লাহ। বাচ্চাকেও অনেকেই কুর’আনে হিফজ করাচ্ছি,৭ বছর বা তারও আগে থেকে নামাজ পড়া, রোজা রাখা শিখাচ্ছি, আলহামদুলিল্লাহ। ইসলামের দিকে ফিরে আসার এই চেষ্টায় আল্লাহ বারাকাহ দিন, আমীন।

কিন্তু সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ যে বিষয়টা আমাদের নজর এড়িয়ে যাচ্ছে তা হল, “ঈমান” এবং “তাওহীদ”। তাওহিদ ইসলামের মূল ভিত্তি। আর ইবলিসের সাথে আমাদের লড়াইটাও এখানেই। অথচ তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ, তাওহীদে উলুহিয়্যাহ এবং আসমাউস সিফাতের জ্ঞানে কোন কমতি থাকলে গোড়াতেই তো গলদ থেকে গেল। আমি মনে করি, বাচ্চার বুঝ হবার পর থেকেই তাকে তার বয়সের উপযোগী করে সহজভাবে তাওহীদের ধারণা দেয়া শুরু করা উচিত।

আমি যখন নতুন দ্বীনের রাস্তায় চলতে শুরু করলাম, মানে পোশাকে, জীবন যাপনে ইসলামকে টেনে আনা শুরু করলাম, তখন আমার সেক্যুলার কিন্তু নামাজী বৃহত্তর পরিবারের অনেকেই একটা মন্তব্য করেছিলেন- “কয় দিন, দেখা যাক… অমুক অমুক ৫ বছর পর ছেড়ে দিল..!!”

এটা সত্য অনেকেই হিজাব শুরু করেন, কিন্তু কিছু দিন পর হয় ছেড়ে দেয়, না হয় প্রপার হিজাব মেইনটেইন করেন না। কালো আবায়া আর খিমারের দিকে এগিয়ে যাবার সংখ্যাটা কিন্তু কম।

আবার অনেকের মেসেজ পাই, ছেলে-মেয়েকে নামাজ রোজা শিখিয়েছেন কুরআন পড়িয়েছেন, কিন্তু ছেলেমেয়ে বড় হবার পর ইসলামে থাকছে না, নিজের মত জীবন যাপন করছে।

ছোট বেলা থেকে ৫ ওয়াক্ত সালাহ এবং তাহাজ্জুদ পড়া বয়স্ক মানুষটিকেও বলতে শুনেছি, “মরার পর কে দেখেছে”! নাউযুবিল্লাহ! কোন কিছু যদি নিজে চোখে দেখেই নিলাম, তাহলে আর সেটা ‘ঈমান’ হল কি করে? চোখে দেখা জিনিসে ঈমান না আনাই তো বরং অস্বাভাবিক। হাজ্জ করে এসেছেন এমন মানুষকেও দেখেছি “সেই ১৪০০ বছর আগে” এই কথা বলে আল্লাহর আদেশ নিষেধকে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে; নাউজুবিল্লাহ! আল্লাহ মাফ করুন।

এটা কেন হচ্ছে? ভেবেছি কখনো?

ইসলামে প্রবেশের শুরুতেই কোন যুক্তি প্রমাণ ছাড়াই আল্লাহ এবং রাসূলের উপর আস্থার ভিত্তিতে ঈমানের এই ৬টি স্তম্ভকে বিশ্বাস করতে হবে। বুঝতে হবে রাব্বে কারীম আমাদের সব কিছুর কৈফিয়ত দিতে বাধ্য নন…। তিনি স্রষ্টা আমরা সৃষ্টি। আমাদের বিশ্বাস করা বা না করাতে তাঁর কিছু আসে যায় না। আল্লাহ চাইলে পৃথিবীর সবাই মুসলিম হত। ইসলাম অর্থই আনুগত্যের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ এবং একই সাথে শির্ক এবং মুশরিকের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ।

হযরত আবদুল্লাহ্ ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, সুফিয়ান ইবনে হারব আমার কাছে বর্ণনা করেন। হিরাকল তাঁকে বলেছিলেন, আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম তারা (ঈমানদারগণ) সংখ্যায় বাড়ছে, না কমছে? তুমি উত্তর দিয়েছিলে, তারা সংখ্যায় বাড়ছে। প্রকৃতপক্ষে ঈমানের ব্যাপার এরূপই থাকে, যতক্ষণ তা পূর্ণতা লাভ করে। আর আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কেউ তাঁর দীন গ্রহণ করার পর তা অপছন্দ করে মুরতাদ হয়ে যায় কি-না? তুমি জবাব দিয়েছ, ‘না।’ প্রকৃত ঈমান এরূপই, ঈমানের স্বাদ অন্তরের সাথে মিশে গেলে কেউ তা অপছন্দ করে না” (বুখারী)।

আরও পড়তে পারেন-

তার মানে কি দাঁড়াল, আমরা অনেকে আসলে প্রকৃত ঈমানদার হতে পারছি না। আমাদের অন্তর ঈমানের স্বাদ পাচ্ছে না ! সেটাই আমাদের জীবনাচরণে প্রকাশ পাচ্ছে! এটা কেন হচ্ছে?

ইবনে মাজাহ’য় বর্ণিত একটি হাদিসে পড়েছি, হযরত জুনদুব বিন আবদুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, ‘আমরা রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে থাকতাম। তখন আমরা যুবক ছিলাম। সে সময় আমরা কুরআন শেখার আগে ঈমানের শিক্ষা লাভ করি। তারপর আমরা কুরআন শিখি। এতে করে আমাদের ঈমান বহুগুণে বেড়ে যায়।”

দ্বীন পালনের ক্ষেত্রে আমরা বাহ্যিক আমলগুলোকেই কেবল গুরুত্ব দিচ্ছি। অথচ বিশুদ্ধ ঈমান থাকা আরো অনেক বেশি জরুরি। আর বিশুদ্ধ ঈমানের মূলে রয়েছে তাওহীদ বা একত্ববাদে বিশ্বাস।

আমরা নিজেরাও স্কুলের ধর্ম বইয়ে শুধু পড়েই এসেছি, ইসলামে ৫টি স্তম্ভের প্রথম স্তম্ভই হল ‘ঈমান’। এই ঈমান আরো ৬ টা পিলারের উপর দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু এই শিক্ষা জীবনে প্রয়োগ করতে শিখিনি।

আমি হয়ত ভাবছি আল্লাহর উপর বিশ্বাস তো আছেই। আমার পর্দা, নামাজ, রোজা, হাজ্জ যাকাত; সব ঠিক আছে। অনেক সাদাকা করছি। বাচ্চা কুরআনে হাফিয হচ্ছে। এটাকেই তো ইসলাম প্র‍্যাক্টিস বলে।

না বোন আমার, “এক আল্লাহর উপর বিশ্বাস” মানে শুধুই মুখে মুখে কলেমা পড়া নয়। তাওহীদের ৩টি শাখার ব্যাপারেই তো গাফেল রয়ে গেলাম। জানলাম ই না আল্লাহ আমাকে কোনটা করতে অনুমোদন দিয়েছেন, কোনটায় দেননি। ঈমানের এই প্রথম স্তম্ভটিই তো নড়বড়ে রয়ে গেল। তাওহীদের জ্ঞান পরিষ্কার না থাকার কারণে নিজেও এর গুরুত্ব বুঝতে পারছি না, সন্তানকেও তাওহীদ শেখাতে পারছি না।

ফলাফল, বংশ পরম্পরায় কেউ কেউ আল্লাহর কাছে পৌছাতে মাধ্যম খুঁজে বেড়াচ্ছি। আল্লাহর আয়াতের উপর আমল করার বদলে সেটা গলায়, কোমরে ঝুলিয়ে রাখছি! বদনজর থেকে বাঁচতে কালো টিপ দিচ্ছি। পীরের মুরিদ হচ্ছি। আল্লাহর আদেশ নিষেধ মানার গুরুত্ব না বোঝার কারণে ভাবছি সবার জন্যই দুআ করা যায়। হিজাব পরেও বাচ্চাদের সংস্কৃতি শেখানোর সরল উদ্দেশ্যে পহেলা বৈশাখ বা নিউ ইয়ার পালন করে যাচ্ছি। মানুষের সৃষ্ট মতবাদকে যুগোপযোগী এবং আল্লাহর আইনের চাইতে উন্নত বলে মনে করছি। হারামের মধ্য দিয়ে হালাল খুঁজে বেড়াচ্ছি।

প্রথম ধাপেই তো অকৃতকার্য আমি। ইসলামে থাকার অযোগ্য হয়ে গেলাম। অথছ ভাবছি বাকি ধাপগুলো পার করে আমি প্র‍্যাক্টিসিং মুসলিম।

তাওহীদ যদি ঠিক না থাকে তাহলে বাকি ৪টা পিলার যতই শক্ত থাকুক না কেন ইসলামের ভিত ভেংগে পড়বে।

আমরা প্রতিদিন ৫ ওয়াক্ত সালাতে সূরা ফাতিহা পড়ি। এখানে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ থেকে ‘মালিকি ইয়াওমিদ্দীন’ পর্যন্ত ‘তাওহীদুর রুবূবিয়্যাহ’ তথা সৃষ্টি ও প্রতিপালনের একত্ববাদ মেসেজ দেয়া হয়েছে। তারপর থেকে শেষ পর্যন্ত ‘তাওহীদুল উলূহিয়্যাহ’ তথা ইবাদতের তাওহীদ রয়েছে। পুরো কুরআনের আলোচ্য বিষয় যেহেতু সূরা ফাতেহা ধারণ করে রেখেছে, তাই তাকে ‘উম্মুল কুরআন’ বা কুরআনের জননী বলা হয়। (মাআরিফুল কুরআন)।

ইসলামের ভিত্তিই তাওহীদের উপর প্রতিষ্ঠিত। যখনি এই পৃথিবীতে তাওহীদ কলুষিত হয়েছে তখনি আল্লাহ নবী রাসূল পাঠিয়েছেন। তাদের পুরো জীবন তারা ব্যয় করেছেন এই তাওহীদ প্রতিষ্ঠা করার পেছনে।

মক্কার মুশরিকরাও কিন্তু বিশ্বাস করত, মূল প্রভুত্ব একমাত্র আল্লাহ-র! তাদের তাওহীদে রুবুবিয়্যাতে এবং আসমাউস সিফাতে কোন সমস্যা ছিল না।

‘আপনি যদি ওদের জিজ্ঞাসা করেন, আকাশ জমীন কে সৃষ্টি করেছেন? ওরা বলবে অবশ্যই আল্লাহ এগুলো সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা যূকরুফ, আয়াত-৮)।

এমন কি মূর্তিপূজারী অগ্নিপূজারীরাও তাই। এ জন্য কোনো নবীই এই দাওয়াত দেননি যে, “তোমরা বল, আল্লাহ আছেন” বা , “এই মহা বিশ্বের স্রষ্টা একজন।” বরং সকল নবীগণের দাওয়াত ছিলো তাওহিদে উলুহিয়্যাহ-র দিকে। কুরআনের বহু জায়গায় বলা হয়েছে, ‘তোমরা সাক্ষ্য দাও আল্লাহ ছাড়া কোনো মা’বূদ নেই। ‘ ‘তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর, তাতে অন্য কাউকে শরীক করো না।’

অন্যান্য আমলে কমতি থাকলেও আল্লাহ চাইলে বান্দা কে মাফ করে দিতেও পারেন, কিন্তু তাওহীদের ৩টি শাখা ঠিক না থাকলে বাকী আমল কোন কাজে আসবে না। আল্লাহ তাআলা বলেছেন, ‘‘হে আদম সন্তান, তুমি দুনিয়া ভর্তি গুনাহ নিয়ে যদি আমার কাছে হাজির হও, আর আমার সাথে কাউকে শরিক না করা অবস্থায় মৃত্যুবরণ করো, তাহলে আমি দুনিয়া পরিমাণ মাগফিরাত নিয়ে তোমার দিকে এগিয়ে আসবো’’। (তিরমিযী)।

ফোকাস পয়েন্ট, ঈমান কেবল মুখে কলেমা পড়া নয়। যারা দ্বীন পালনের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি, আমাদের পরবর্তী স্টেপ যেন হয় “তাওহীদ” অর্থাৎ ইসলামের প্রাণ তাওহীদে উল্যুহিয়াহ, তাওহীদে রুবুবিয়্যাহ এবং তাওহিদুল আসমাউল সিফাত জানা, বোঝা এবং সন্তানকে বোঝান। যে শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টায় ইবলিস কখনো ক্লান্ত হয় না।

ওয়ামা তাওফিকি ইল্লাবিল্লাহ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।