Home ইতিহাস ও জীবনী চলে গেলেন দরবেশী জীবনের বাদশাহ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)

চলে গেলেন দরবেশী জীবনের বাদশাহ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী (রাহ.)

ছবি- উম্মাহ।

।। লাবীব আবদুল্লাহ ।।

দরসে হাদিসে তিনি মুহাদ্দিস। বোখারির উস্তায শাইখুল হাদিস, হাদিস বিশারদ। মুহতামিমের পদে দরদি পরিচালক মাদ্রাসার, উপলব্ধি করেন অন্যান্য উস্তাযদের সুখ-দুঃখ। কওমি মাদ্রাসা থেকে ফারেগ হওয়ার পর মাওলানা যখন পাশে কাউকে পান না এবং বোর্ডিংয়ের সেই ইমদাদিখানার দরজা বন্ধ সেই দুঃখভরা দিনগুলোতে পাশে থেকে তিনি হিম্মত দিচ্ছেন, সাহস দিচ্ছেন। কোথাও খেদমতে পাঠানো যায় কি-না সেই চিন্তা করছেন। বোর্ডিং মেহমান হিসেবে রেখেছেন। এ নিয়ে হজরতের কোনো বিরক্তি নেই, বেকারারি নেই। দরদি পিতার মতো তিনি সাহস ও হিম্মত দিয়ে সদ্য ফারেগ মাওলানাকে অনুপ্রাণিত করছেন আগের আলেমদের কষ্টের গল্প শুনিয়ে।

বছরের শুরুতে কওমি মাদ্রাসায় দরস শুরু হয় শাওয়ালে। পুরো দেশ থেকে আবেদন ইফতেতাহি দরসে থাকতে হবে হাজির। তালেবে ইলম ও উস্তাযরা দেখতে চান। নসিহত নিতে চান। তিনি ছুটে চলছেন শহর থেকে শহরে। নগর থেকে নগরে। গ্রাম থেকে গ্রামে। কখনও উড়োজাহাজে, কখনও ভ্যানে বা রিকশায়। ইলমি নববির তালেবে ইলমদের উৎসাহিত করতে।

বছর শেষে শাবানে বোখারির শেষ হাদিসের দরস। খতমে বোখারির অনুষ্ঠান। মাদ্রাসাগুলোর দাবি হজরতকে শেষ হাদিসের দরস দিয়ে হাদিসের বরকতে ধন্য করতে হবে তালেবে ইলমদের। তিনি আবার হাজির মাদ্রাসা থেকে মাদ্রাসায়। হাজার মাদ্রাসার জনপদে তিনি চলছেন। ক্লান্তি নেই। বিরক্ত নেই।

দেশজুড়ে ওয়াজ মাহফিল, সম্মেলন, মহাসম্মেলন, জলছা ও দ্বীনি আয়োজন। হজরতকে অতিথি, আলোচক, বক্তা, সভাপতি হিসেবে চাচ্ছে মাহফিল আয়োজক কমিটি। হজরত দ্বীনি ফায়দা হবে এই বিবেচনায় যাচ্ছেন টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়ায়। কোনো ডিমান্ড নেই টাকা পয়সার। নেই কীভাবে নিতে হবে। কী খাওয়াতে হবে তারও কোনো ফিরিস্তি নেই। হাদিয়া বা টাকা-পয়সার প্রতি কোনো লোভ-লালসাও নেই। ফকিরি জিন্দেগি। সাদা ধবধবে পোশাক-পরিচ্ছন্ন। মনের শুভ্রতা ফুটে উঠেছে তার লেবাসে। চেহারায় নিষ্পাপ হাসির ঝিলিক। লাখো মানুষের ভিড়ে তিনি একা, নির্জনতায় নীরবে নিভৃতে জিকিরে মশগুল। নিমগ্ন উম্মাহর দরদে। দোস্ত-দুশমন ফরাক নেই তার কাছে। তিনি বাঙালি জাতির দ্বীনি চিন্তাচেতনা বিকাশে নিবেদিতপ্রাণ। নবীর ভালোবাসায় এই জাতি সিক্ত হবে এবং মদিনার সবুজ গম্বুজের সঙ্গে সম্পর্ক জুড়ে যাবে এই ফিকির।

তাবলিগের বিশ্ব ইজতেমা। তিনি সেখানেও হাজির। তালেবে ইলমদের ও উস্তাযদের পাঠাচ্ছেন তাবলিগি কাজে। নিজেও যাচ্ছেন কোটি জনতার স্রোতে। তিনি শরিয়ার মেজাজ ও দ্বীনি ফিকিরের সীমানা উপলব্ধি করেই সব কাজ করেন।

মসজিদের নগরী ঢাকা। হাজার বছরের ঐতিহ্যের শহর। বহু জাতি, নানা বর্ণের মানুষের আবাদ করা শহর ঢাকা। সেই মুঘল আমল থেকে ব্রিটিশের ঢাকা। বুড়িগঙ্গা ও তুরাগের ঢাকা। এই ঢাকায় রয়েছে ওলি-আউলিয়াদের স্মৃতি। দাওয়াহ কার্যক্রমের নমুনা। এই ঢাকার নাম ছিল জাহাঙ্গীরনগর। আজকের জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তো সেই নামের স্মৃতি! লালবাগ, শাহবাগ, গুলশান ও গুলিস্তান উর্দু বা ফার্সি শব্দে। আমি সেই ইতিহাসে যাচ্ছি না। মুসলিম জাহানে অনন্য একটি শহর ঢাকা। প্রাচ্যের ভেনিস হিসেবে পরিচিত হলেও এই শহরের কোটি জনতার দিল ও দেমাগে নবীজির প্রতি ভালোবাসা। ভালোবাসা মক্কা-মদিনার প্রতিও। চৌম্বকীয় আকর্ষণ হৃদয় জগতে। মুঘল, মুঘল-পূর্ব, ব্রিটিশ আমল, পাকিস্তানি শাসন ও লাল-সবুজের পতাকার ঢাকা নানা চরিত্র ধারণ করে।

আরও পড়তে পারেন-

আমাদের প্রাণজুড়ে যার ভালোবাসা, সেই হজরতের নাম আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী। যার বসবাস এই ঢাকার বারিধারায়। এখন তিনি ওপারে। রাহিমাহুল্লাহ।

কুমিল্লার চড্ডা গ্রামে জন্ম হলেও তিনি রাজধানীকে বেছে নিয়েছিলেন বর্ণাঢ্য কর্মময় জীবনের দিনগুলো কাটাতে। এই শহরে তিনি পাঁচ দশক উম্মাহর চিন্তাচেতনা বিকাশে ব্যয় করেছেন। বিনিয়োগ করেছেন চিন্তাচেতনার।

হাজার হাজার দ্বীন ইসলামের সৈনিক তৈরি করেছেন। স্বাধীনতার পর থেকে তিনি কখনও মালিবাগ জামিয়ায়, কখনও কখনও তুরাগ তীরে সুব্হানিয়ায় এবং স্বপ্নের নোঙর জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় স্বপ্নের বীজ বপন করেছেন, রোপণ করেছেন। ইলমের বৃক্ষ রোপণ করেছেন, পরিচর্যা করেছেন। সেই বৃক্ষ লতাপাতায়, পত্রপল্পবে, ফুলেফলে ভরা পল্লবিত। সেই আশির দশকে বারিধারায় বসে তিনি দ্বীনি অঙ্গনের নানা শাখায় খেদমত আনজাম দিচ্ছেন। হাদিসের দরস থেকে রাজপথে লড়াকু সৈনিক। অন্যায়-অবিচার, ভ্যাবিচার ও স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে তিনি রাজপথে মিছিলে-মিটিংয়ে সেøাগানে জনতার ভিড়ে। জনতার সঙ্গে ঈমানি কাফেলার সিপাহসালার।

কওমি মাদ্রাসা সনদের স্বীকৃতির ভালো-মন্দ দিক নিয়ে নানা কথা রয়েছে। আগামী দিনে তা বলবে লাভ হয়েছে না ক্ষতি। হজরত মাওলানা নূর হোসাইন কাসেমী আকাবির ও আসলাফের চিন্তাধারা রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন আমৃত্যু। সব চিন্তা হয়তো সবাইকে বোঝাতে পারেননি।

১৯১৯ সালে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের জন্ম

ব্রিটিশ খেদাও আন্দোলন যে দলের রয়েছে অসামান্য অবদান, রয়েছে কালাপানি ও আন্দামানের ইতিহাস- সেই অভিভক্ত উপমহাদেশে জন্ম নেওয়া দলটি বিভক্ত ভারবর্ষে পাকিস্তানে একরূপ। বাংলাদেশে আরেক চরিত্র। দেশ-জাতি-উম্মাহর ভালোবাসা ও কল্যাণে যার শতবর্ষের অবদান। আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী সেই রাজনৈতিক দলের জেনারেল সেক্রেটারি বা মহাসচিব। সভাপতির যোগ্য এই মনীষী পদ নিয়ে চিন্তা করেননি। কখনও পদ নিচে নেমেছে, কখনও পদ ওপরে। তিনি কাজ করেছেন পদের কথা চিন্তা না করে।

১৯৭৮ সালে জন্ম কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ। আল্লামা কাসেমী নানা পর্বে নানা তাজরেবায় নানা চড়াই-উৎরাইয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে শেষতক সিনিয়র সহসভাপতি পদ যাই থাক, কাজের নাম ইসমে আজম বাজি! এই চিন্তা নিয়ে তিনি কাজ করেছেন আমৃত্যু।

হেফাজতে ইসলামের উত্থান, জাগরণ ও সাময়িক বিপর্যয় ও কিছু মানুষের আপসকামিতা ও দরবারি হওয়ার কথা বাতাসে ওড়ে শাপলার শুভ্রতা যে রাতে রক্তাক্ত হয়েছিল, সেই রাতেও তিনি কাফেলায় ছিলেন। শাহাদতের তামান্নায় হেফাজত নিয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা চিন্তা রয়েছে, রয়েছে নানা বিশ্লেষণ। মাওলানা কাসেমী সেই হেফাজতের মহাসচিবও শেষতক।

তিনি দরসে হাদিসে, রাজনীতিতে, জোটে, একাকীতে, মাহফিলে, সেমিনারে, জনতায়, মিম্বর ও মেহরাবে ইখলাসের সঙ্গে আল্লাহর জন্যই কাজ করেছেন। পদপদবি, টাকা-পয়সার লোভলালসা কাজ করেনি আল্লামা কাসেমীর মনোজগতে।

পাঁচ দশক ঢাকায় এত পদ, সম্পর্ক থাকার পরও তিনি নিজের জন্য প্লট, ফ্ল্যাট, দামি গাড়ি বা সুরম্য বাড়ির চিন্তা করেননি। ফকিরি ও দরবেশি জিন্দেগি যাপন করেছেন। তিনি দরবেশি জিন্দেগিতেও বাদশাহি করেছেন দ্বীনি অঙ্গনে।

যারা কাসেমীর দ্বীনি কাজকে ধর্মব্যবসা বলতে চায় বলতে দিন, তাদেরকে যারা ধর্মান্ধ বলতে চায় বলতে দিন। এই ব্যবসা ও অন্ধ কত যে কাজের তা তো বিচার হবে ওপারে। চোখ দুটি বন্ধ হলে কবরের দেশে। মন যাদের অন্ধকার মনোজগৎ, যাদের অলোহীন তারাই এইসব বাজে লকব দেয়।

আল্লামা কাসেমী এসবের পরোয়া করেননি

বাংলাদেশের কোটি কোটি জনতার হৃদয়ের ভালোবাসা ও দোয়া আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর প্রতি। তিনি আধ্যাত্মিক শক্তির প্রভাবে দিন গুজরান করেন। সময়ের কোনো শাসকের দয়া, অনুকম্পা, হুমকি-ধমকি, লোভ-লালসায় পা বাড়াননি। তিনি শাহানশাহ, রাজাধিরাজের গোলামি করে মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত ছিলেন। আছেন তিনি চেতনায়, থাকবে তার দ্বীনি গায়রত ও চেতনা যুগ যুগ ধরে। নূর মানে আলো। যার জীবন-যৌবন ও বার্ধক্য ছিল আলোভরা, আলোয় আলোয় ঝলকিত হোক ওপারে।

লেখক: কলামিস্ট, ইবনে খালদুন ইনস্টিটিউট, ময়মনসিংহ।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।