Home ইতিহাস ও জীবনী উকবা মসজিদ থেকেই, আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম আজান উচ্চারিত হয়েছিল

উকবা মসজিদ থেকেই, আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম আজান উচ্চারিত হয়েছিল

-মুসলিম দিগ্বিজয়ী উকবা বিন নাফ-এর নামানুসারে এই মসজিদের নতুন নাম উকবা বিন নাফে মসজিদ

নবম থেকে একাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় বিশ্ব জুড়ে  ইসলামি জ্ঞানচর্চা বেড়েই চলেছিল, তার সাথে সাথে ধর্ম চর্চা অর্থাৎ কোরানের প্রতি মানুষের আগ্রহও বৃহৎ আকার ধারণ করেছিল। তত্কালীন সময়ের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী নগর ছিল উত্তর অফ্রিকার তিউনিসিয়ার কায়রোয়ান শহর। যা বর্তমানে ইউনেস্কো-র ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট হিসেবে ঘোষিত।

মুসলিম দিগ্বিজয়ী উকবা বিন নাফ হলেন বিশ্বের চমক লাগানো কায়রোয়ান জামে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। তার নামানুসারে এই মসজিদের নতুন নাম অর্থাৎ উকবা বিন নাফে মসজিদ। এই স্থাপত্য নিদর্শন পশ্চিমা ইসলামী বিশ্বের সকল মসজিদের পূর্বসূরী হিসেবে বিবেচিত।

মসজিদ ও তার প্রতিষ্ঠাঃ

উকবা মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করা হয় প্রায় ১৩৫০ বছর আগে ৬৭০ সালে বা ৫০ হিজরিতে। তবে এটিকে টিকিয়ে রাখার জন্য চালানো হয় সংস্কারকাজ। অর্থাৎ টিকে থাকার মতো স্থাপনা নির্মাণ করা হয় এবং তা করা হয় প্রায় নবম শতকে। সংস্কারকাজ করা হয় আঘবালীয় রাজবংশের আমলে। জানা যায়, রাজবংশের রাজত্বকাল ৮০০ থেকে ৯১২ খ্রিস্টাব্দ। অবশ্য বেশ পরে যোগ করা হয় মসজিদের স্থাপনার কিছু অংশ। আরো বলা হয়, মসজিদটি নির্মাণ করা হয় উমাইয়া যুগে। জেনারেল উকবা ইবনে নাফি নির্মাণ করেন এটি। তার নামানুসারেও অনেকে মসজিদটিকে বলে থাকেন উকবা মসজিদ। তিনি আরব জাহানের একজন নাম করা সেনাপতি ছিলেন মুয়াবিয়া (রা.) ও এজিদের সময়ে।

আরও পড়তে পারেন-

এই মসজিদ থেকে আফ্রিকা মহাদেশের প্রথম আজান উচ্চারিত হয়েছিল বলে- ইসলামের ইতিহাসে এটির গুরুত্ব অপরিসীম। ওই সময়ের পশ্চিম ইসলামিক দুনিয়ার প্রথম মসজিদ বলেও কথিত আছে। পরবর্তীকালে এটি ছিল মাগরিবে স্থাপিত অন্যান্য মসজিদের মডেল। অর্থাৎ বিভিন্নস্থানে প্রচুর মসজিদ নির্মাণ করা হয় উকবা মসজিদেরই আদলে। কারণ, এর নকশা যেমন আকর্ষণীয় তেমনি মজবুত এর ভিত্তিপ্রস্তর। আরবরা মাগরিব বলে থাকে আলজেরিয়া, মরক্কো ও তিউনিসিয়াকে। এর মানে হলো, পশ্চিম বা সূর্যাস্তের দিক।

উকবা মসজিদটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যে, বাইরে থেকে এটি দেখলে মনে হবে একটি শক্তিশালী দুর্গ মসজিদটিকে বেষ্টন করে রেখেছে। শুনলে অবাক হবেন, এই আকর্ষণীয় মসজিদটি প্রায় ৯০০০বর্গকিমি আয়তনের বিশাল ভূমিতে বিস্তৃত। শুধু কি তাই ! এতে রয়েছে একটি পরিবারের নামাজ কক্ষ। আর একটা বর্গাকার মিনার।

মসজিদের বর্ণ্নাঃ

কায়রোয়ান মসজিদে ৫টি গম্বুজ ও ৯টি প্রবেশ দ্বার রয়েছে। এই মসজিদের মেহরাবের কাছে নীচু ছাদবিশিষ্ট আরেকটি কক্ষ রয়েছে। যার নাম মাকসুরা। খলিফাদের নামাজ আদায় এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য এই বিশেষ কক্ষ মাকসুরা নির্মাণ করা হয়েছিল। এই কক্ষের ভেতরে দাঁড়িয়ে মসজিদে অবস্থানরত মুসল্লিদের দেখা যাওয়ার পাশাপাশি তাদের সঙ্গে এক জামাতে নামাজ আদায় করা যেত।

ইসলামের ইতিহাসে হজরত মুয়াবিয়া (রা.) সর্বপ্রথম দামেস্কের উমাইয়া জামে মসজিদে মাকসুরা নির্মাণ করেন। কায়রোয়ান জামে মসজিদের প্রাচীর নির্মাণ করা হয়েছে ইট ও পাথর দিয়ে। এই প্রাচীরের ভেতরেই তৈরি করা হয়েছে বড় বড় স্তম্ভ। এই মসজিদের মিনারে যে চমৎকার কারুকাজ রয়েছে, আফ্রিকার অন্য কোনো মসজিদে তার নজির পাওয়া যায় না।

মসজিদে নামাজ কক্ষঃ

পূর্বেই বলেছিলাম এই মসজিদে রয়েছে স্নিগ্ধ এক নামাজ কক্ষ। যা দেখার জন্য মানুষেরা ছটফট করতে থাকে মনের মধ্যে। তবে হ্যাঁ, নামাজ এর উদ্দেশ্য ছাড়া এখানে ঢোকার কোনো রকম অনুমতি নেই। একমাত্র নামাজ পরতে আসলে তবেই সে কক্ষে ঢোকার অনুমতি মেলে। মসজিদের ভেতরে খুব সজ্জিত ভাবে সমস্ত ব্যবস্থা করা থাকে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা এখানে বিশ্বমানের কোনো ঐতিহ্যের তুলনায় কম কিছু নয়। সর্বোপরি বলা যায় এখানে আধ্যাত্মিক ও গৌরবের মধ্যে যে সুক্ষ্ম অথচ আশ্চর্য অনুভূতি আছে তা যেন রোজ সৃষ্টি হয়। যারা মুসলিম নয় অথচ এই মসজিদ  ভ্রমণ করতে এসেছেন তারা মসজিদের মূল আঙ্গিনায় প্রবেশ করতে পারেন, তবে তার ভিতরে প্রবেশ করার কোনো অনুমতি নেই। বাইরে  থেকে জানালার ভিতর দিয়ে নামাজ কক্ষ দেখতে পারবেন  এবং যথারীতি  ছবিও তোলার  অনুমতি আছে। আপনি যদি নামাজ আদায় না করে শুধুমাত্রই ভ্রমণের উদ্দেশ্যে আসতে চান তাহলে ঈদের দিন আর শুক্রবার –এই দুটো দিন এড়িয়ে চলুন।

নারীদের জন্য এখানে বিভিন্ন নিয়ম বিদ্যমান। মসজিদে প্রবেশ করতে চাইলেই এই গুরুত্বপূর্ণ উপাসনালয়ের সম্মানার্থে নারীদেরকে মাথা ঢেকে যাওয়া আবশ্যক, তিনি ভিনধর্মী হলেও। সে কারণে যখনই আসবেন, স্কার্ফ বা ওড়না পরিধান করে যাওয়াই আবশ্যকীয়। যদি সেটা সম্ভব না হয় বা আপনার কোনো সমস্যা আছে, তাহলে মসজিদে প্রবেশ করার সময় বিনয়ের প্রকাশ স্বরূপ আপনি কিছু দিয়ে মাথা ঢেকে দিয়ে ঢুকুন।

মসজিদে ঘুরতে গিয়ে কী করতে পারেন?

মোটামুটি এক ঘন্টা মসজিদ আঙ্গিনায় ভ্রমণ করার ইচ্ছা হলে  এবং মসজিদের বাইরে ও ভিতরের যে সৌন্দর্য সেটার আকর্ষণীয় কারুকার্য উপভোগ করতে চাইছেন তো আপনি একটা স্থানীয় অভিজ্ঞ গাইডের সাহায্য  নিয়ে নিন। আর যদি আপনার পুরোটাই দেখার থাকে তো মসজিদের দক্ষিণের কজন দোকানীর সাহায্য নিয়ে নিন, যারা আপনাকে তাদের ভবনের ছাদ থেকে মসজিদের প্যানরমিক ভিউ দেখার ব্যবস্থা করে দেবেন।

কায়রোয়ান শহর তার বুননশিল্পের জন্য খুব পরিচিত। অসংখ্য পর্যটক শুধুমাত্র বিচিত্র ও চমকপ্রদ মাদুরের সন্ধানেই এখানে আসে। এই বাজার বুননশিল্পী, রৌপ্যকার ও স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী পোষাক প্রস্তুতকারকদের গুঞ্জনে মুখরিত থাকে। শহরের পুরাতন অংশে সরু গলি এবং আঁকা বাঁকা পথ দেখা যায়। যার দু’ধারে রয়েছে সার দেওয়া সাদা চুনকম করা বাড়ি।

২৭ হিজরি সনে ইসলামের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান ইবনে আফফান রা.-এর খেলাফতের সোনালি শাসনামলে তিউনিশিয়া দেশটি ইসলামি শাসন বলয়ের অধীনে আসে। খলিফা উসমান রা.-এর শাসনামলে মুসলমানরা এদেশ জয় করার পর ‘কায়রোয়ান’ নামক শহরটির পতন ঘটে।

মুসলিম বাহিনীর মহান সেনাপতি উকবা ইবনে নাফে ফাহরি রা. গভীর চিন্তা-ভাবনার পর এ শহরটি গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আফ্রিকার এই অংশটি মুসলিম শাসনাধীন আসার পর উকবা ইবনে নাফে এখানে বড় বড় ইসলামী পন্ডিত ওলামা বুদ্ধিজীবীদের এক সমাবেশের আয়োজন করেন।

তবে ১৯ শতকের শেষের দিকে ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্স তিউনিসিয়ার উপর হামলা চালিয়ে তা দখল করে নেয়। প্রায় পৌনে এক শতক পর্যন্ত তিউনিসিয়ার উপর ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকে। এই দীর্ঘকাল ফ্রান্সের শাসনাধীন মরক্কো এবং আলজেরিয়া ইত্যাদি এলাকার মতো ফরাসী ভাষাই এখানকার সরকারি ভাষা হিসাবে চালু থাকে। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে ইউরোপিয়ান কৃষ্টি-কালচারের প্রাধান্যও দেশটিতে বৃদ্ধি পায়।

তা সত্ত্বেও আজ এই পুরাতন নগরীর আনছে কানাচে মধ্যযুগের সেই ইতিহাস, ইসলামী স্থাপত্য ও ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের স্মৃতি রোমন্থন কায়রোয়ান শহরকে অন্য মাত্রা ও মর্যাদা দেয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।