Home ইতিহাস ও জীবনী মসজিদে টেরাকোটার কারুকার্যে অনুপম মস্ক অফ জেনি

মসজিদে টেরাকোটার কারুকার্যে অনুপম মস্ক অফ জেনি

-সংগৃহিত ছবি।

ধর্মীয়স্থানের চাকচিক্য পৃথিবীর যেকোনো দেশেই চোখে পড়ার মতো। তবে মাটির তৈরি আস্ত একটা মসজিদ, কথাটা বেশ চমকে দেয়। হ্যাঁ আপাদমস্তক মাটির তৈরি এরকমই একটি মসজিদ আছে আফ্রিকার মালিতে। মালির জেনি শহরে অবস্থিত এই মসজিদ আফ্রিকার অন্যতম পর্যটন কেন্দ্র। সুদানী-সহেলীয় স্থাপত্যের উদাহরণ হিসাবে এই মসজিদ শ্রেষ্ঠ স্থান পায়।

ত্রয়োদশ-চতুর্দশ শতকে স্থাপিত এই মসজিদ তৎক্ষণাৎ হয়ে ওঠে বাণিজ্য, পর্যটন ও ইসলামের প্রাণকেন্দ্র। পরবর্তিকালে এই আশ্চর্য মসজিদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে, বিশেষ করে যখন ফরাসী ঔপনিবেশিকরা ১৮৯২ সালে মালি দখল করে। সময়ের সাথে সাথে এই মসজিদ হয়ে উঠেছে ধর্ম ও সংস্কৃতির মূল কেন্দ্র জেনি সহ সমগ্র মালিতে।

আরও পড়তে পারেন-

মসজিদের সূচনা-

বর্তমানে যে বিশাল মসজিদ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে আফ্রিকার বুকে, এটা তার তৃতীয় সংস্করণ। কথিত আছে ত্রয়োদশ শতকে রাজা কোই কোনবরো ইসলাম ধর্মগ্রহণ করেন এবং মালির প্রথম সুলতান হিসাবে এই বিশাল মসজিদের পত্তন করেন। এই মসজিদ সম্পূর্ণ ভাবে স্থানীয় পদ্ধতি ও স্থাপত্যকে অনুসরণ করে ইসলাম ধর্ম পালনকারীদের জন্য তৈরি করা হয়। সুলতান কোনবরোর উত্তরাধিকারীরা পরবর্তিকালে মসজিদে আরও দুটি গম্বুজ যুক্ত করে এবং মসজিদকে ঘিরে একটা প্রাচীর বানিয়ে দেয়। এরপর সময়ের সাথে সাথে মসজিদের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে, বলা হয় যে ষোড়শ শতাব্দি নাগাদ মালির অর্ধেক জনসংখ্যা ওই মসজিদের মধ্যে ঢুকে যেত।

জেনি ও তার বিখ্যাত মসজিদ সম্বন্ধে ইউরোপের মানুষদের ধারণা তৈরি হয় উনবিংশ শতকে। এই সময়ের এক ফরাসি লেখক রেনে কাইলি, আফ্রিকা ভ্রমণের অভিজ্ঞতায় একটি বই লেখেন “জার্নাল অফ এ ভয়েজ টু টিমবাকটু এন্ড জেনি” । কাইলি ১৮২৭ খ্রীষ্টাব্দে জেনিতে আসেন এবং তিনিই ছিলেন একমাত্র ইউরোপীয় যে ওই মসজিদের প্রথম স্থাপত্য চাক্ষুষ করেছিলেন। এর পর খুব শীঘ্রই মসজিদটির প্রাথমিক রূপ ধ্বংস হয়ে যায়। কাইলির ভ্রমণ অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায় যে মসজিদ তখন যথেষ্ট জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল যার প্রধান কারণ রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। মাটির তৈরি হওয়ার ফলে বৃষ্টিতে মাটি ধুয়ে এবং এই মসজিদকে নিয়মিত প্লাস্টার করা প্রয়োজন। মসজিদের দ্বিতীয় সংস্করণ তৈরি হয় ১৮৩৪-৩৬ খ্রীষ্টাব্দে। ফরাসি সাংবাদিক ফেলিক্স দুবোঁ এই সময়ের কিছু ছবি আঁকেন যার থেকে মসজিদের দ্বিতীয় সংস্কারের প্রমাণ পাওয়া যায়। এছাড়া ফেলিক্স ওই মসজিদের একটি নক্সাও তৈরি করেন ছাপানোর জন্য।

সংস্করণ-

মসজিদের বর্তমান এবং সর্বশেষ সংস্করণ হয় ১৯০৭ সালে। কিছু বিশেষজ্ঞরা দাবি করেন মসজিদটির শেষ সংস্করণ করে ফরাসী ঔপনিবেশিকরা যখন তারা ১৮৯২ খ্রীষ্টাব্দে মালি দখল করেছিল। যদিও তাদের দাবির পক্ষে কোনো যথেষ্ট প্রমাণ নেই। মসজিদের সংস্কারের বিষয়ে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য হলো, জেনির কারিগররা এই মসজিদ সংস্কার করে মজুরদের বেগার খাটিয়ে যা ফরাসিরা শুরু করেছিল।

বর্তমান মসজিদে টেরা-কোটা দিয়ে বানানো গম্বুজে বেশ কিছু গর্ত দেখা যায়, যা আসলে প্রচন্ড গরমেও বায়ু চলাচলের ব্যবস্থা করে। মসজিদের সম্মুখ ভাগে তিনটি উঁচু মিনার আছে এবং তার মাঝখানে বেশ কিছু স্তম্ভ আছে যা একটা ছন্দোবদ্ধ রুপ দেয় প্রবেশপথকে। প্রতিটা পিলারের মাথায় আছে উটপাখির ডিম- যা মালি অঞ্চলে শুদ্ধতা ও উর্বরতার প্রতীক। বাইরের দিকে কাঠের বিম দিয়ে বাঁধানো অংশগুলি এই বিশাল স্থাপত্যকে এক অনন্য রুপ দিয়েছে। এই কাঠের বিম গুলো প্রতি বছর প্লাস্টার করার সময় ভারা বাঁধার কাজেও ব্যবহার করা হয়। এই মসজিদ প্রথমের তুলনায় বেশ কিছুটা উন্নত, বহু নতুন জিনিস তৈরি করা হয়েছে মসজিদে, এর মধ্যে অন্যতম হলো মেয়েদের জন্য বানানো হলঘর, প্রবেশপথে মাটির দুটি পিলার এবং দুটি স্থানীয় নেতার কবরের সৌধ।

সবমিলিয়ে এই মসজিদ যেন অত্যাশ্চর্যের সমাহার। শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে প্রচুর মুসলিম ও অমুসলিম মানুষদের মিলনতীর্থ জেনির বিখ্যাত মসজিদ।