Home ইসলাম হাশরের ময়দানে জালেমদের সকল দম্ভ চূর্ণ হবে: জুমার বয়ানে আল্লামা হাফেজ নাজমুল...

হাশরের ময়দানে জালেমদের সকল দম্ভ চূর্ণ হবে: জুমার বয়ানে আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র ভারপ্রাপ্ত পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান শুক্রবার (১ জানুয়ারী) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

বয়ানের শুরুতে হামদ-সালাতের পর আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান পবিত্র কুরআনের সূরা আল-আনকাবুত-এর ৬৪নং আয়াত তিলাওয়াত করেন-

وَمَا هَٰذِهِ الْحَيَاةُ الدُّنْيَا إِلَّا لَهْوٌ وَلَعِبٌ ۚ وَإِنَّ الدَّارَ الْآخِرَةَ لَهِيَ الْحَيَوَانُ ۚ لَوْ كَانُوا يَعْلَمُونَ

আমাদের দুনিয়াবী যিন্দেগী তুচ্ছ এক খেল-তামাশার নামান্তর। এই জীবন থেকে একটি বছর হারিয়ে গেলো ইতিহাসের অতল গহ্বরে। এই বছরটি আমাদের মাঝে আর ফিরে আসবে না। আজকে যারা ২০২১ সালের প্রথম মাসের প্রথম দিনের প্রথম জুম’আ মসজিদে আদায় করছেন, তারা কেউ এই নিশ্চয়তা দিতে পারবেন না যে, ২০২১ সালের ৩১শে ডিসেম্বর পর্যন্ত বেঁচে থাকবেন।

ইতিহাসকে অনেকে অনেকভাবে সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেন। কেউ কবর উঁচু করেন, কেউ কবর পাকা করেন; যার যেমন সাধ্য। মোঘল বাদশা শাহজাহান তার স্ত্রীর কবরের উপর বিশ হাজার কর্মীকে ২২ বছর খাটিয়ে হাজার কোটি টাকা খরচ করে মহল বানালেন। নাম দিলেন ‘তাজ মহল’। যা বিশ্বের সপ্তমাশ্চার্যের একটি। কোটি কোটি পর্যটককে যা গভীরভাবে আকৃষ্ট করে। কিন্তু এর মাধ্যমে কি, অর্থাৎ- এই কবরের ভিতরে যিনি শুয়ে আছেন, যার কবরের সৌন্দর্য বর্ধন ও সংরক্ষিত করার জন্য এতো আয়োজন, যাকে ইতিহাসে অম্লান রাখার এতো প্রয়াস, এতে তার বিন্দুমাত্র শান্তি বৃদ্ধি হচ্ছে? তার আযাব কি এই ‘তাজ মহল’ বানানোর মাধ্যমে বিন্দুমাত্র লাঘব হচ্ছে? সবই দুনিয়ার খেল-তামাশা! তুচ্ছতা!

হিজরী সাল অনুযায়ী রাসূল (সা.)এর জন্মের ১৪৯৬ বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। ঈসায়ী সন অনুযায়ী প্রায় সাড়ে চৌদ্দশত বছর অতিবাহিত হয়ে গেলো। আজ পৃথিবীতে রাসূল (সা.) বেঁচে না থাকলেও ওয়ারীসে নবীরা আজও বেঁচে আছেন। তারা মানুষকে রাসূল (সা.)এর মতই আপন করে, মায়া করে বুঝানোর চেষ্টা করেন যে, কোনটা ঠিক আর কোনটা ভুল। এতদসত্ত্বেও যারা উলামায়ে হক্বানিদের শত্রু ভেবে দূরে ঠেলে দিচ্ছেন, তারা বেওকুফ বৈ কিছুই নয়।

নাবালেগ থাকতেই হিফজ শেষ করে কিতাবখানায় পা রেখেছি। তখন থেকে আজ পর্যন্ত কুৃরবানির ঈদ বাড়িতে পালন করিনি। ৬/৭বছর বাংলাদেশে পড়ালেখা করেছি। অত:পর চলে গেলাম হিন্দুস্তানের দারুল উলূম দেওবন্দ। সেখানে থাকাবস্থায় বাড়ি থেকে পত্রের মাধ্যমে পিতার মৃত্যুর সংবাদ পাই। সবর করি। উস্তাদগণ জানতে পেরে আমার প্রতি আদর বাড়িয়ে দেন। যার দরূন পিতার অনুপস্থিতি কিছুটা লাঘব হয়। তারও কয়েকমাস পর বছরান্তে দেশে এসে মরহুম পিতার কবর যিয়ারত করি। পারিবারিকভাবে বড় ছেলে হিসেবে অনেকেই সংসারের দায়িত্ব নেয়ার কথা বলেন। কিন্তু আমার মা বলেন, “ঝাড়ের বড় কুড়োল টা আমি ভাংতে দেবো না।” বাবার কর্মস্থল থেকে পেনশন হিসেবে যে টাকা পেয়েছিলেন আমার মা, তা দিয়েই সংসার চালানোর ইচ্ছা করলেন। তা শেষ হয়ে গেলে জমিজমা বিক্রি করার কথা এবং সবশেষে ভিটাবড়ি পর্যন্ত বিক্রি করবেন বলে ইচ্ছে করলেন। কিন্ত ঝাড়ের বড় কুড়োলটা তিনি অটুট রাখতে চান।

আরও পড়তে পারেন-

মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল, বাড়িতে একটা ঈদ করি। মায়ের প্রশ্ন- সব চাকুরী জীবিরাই তো বাড়িতে ঈদ করে। তুমি কেন বাড়িতে আসো না? বলি, মা! ওদের তো শিডিউল ঈদের তিনদিন আগে থেকে ঈদের তিনদিন পর পর্যন্ত ছুটি। আর আমার তো ঈদের দিন ২৪ঘন্টাই ডিউটি। সকালে ১২নং সেক্টরে ঈদের নামাজ পড়িয়ে উত্তরার মুসল্লিদের কুরবানির ব্যবস্থা করে ফের বারিধারায় যাওয়া। সেখানকার কুরবানি আছে। আমার তো বাড়িতে ঈদ উদযাপন করার সে সুযোগ নেই। গত জানুয়ারীতে তিনি আল্লাহর দরবারে চলে গেছেন। সকলের কাছে দোয়ার দরখাস্ত।

আজ অনেকে ক্ষমতাবলে ইসলামকে পাল্টে দিতে চায়। ক্ষমতাবলে নবীর ওয়ারীসদের লঞ্ছিত ও অপমানিত করা হয়।

তো আমরা এতো কুরবানী করে পিতা বিসর্জন দিয়ে বাড়িঘর ছেড়ে দূরদেশে গিয়ে ইলম অর্জন করে তা আপনাদের কল্যাণার্থেই ব্যয় করার পর যখন আপনারা ক্ষমতার দম্ভে দম্ভোক্তি করে বলেন- “তুমি মাদরাসায় গিয়া পিটুনি খাইয়া ইলম শিখছো, আর আমি ঘরে বসে নিজ ইচ্ছায় ‘আলিফ’ থেকে ‘ইয়া’ পর্যন্ত শিখেছি। তুমি কেমনে আমার চেয়ে বড় আলেম হইলা?” তখন কি কষ্ট লাগে না?

দায়িত্বশীল হয়ে ক্ষমতাবলে আমাদের লেজ কেটে দেয়ার কথা বলেন?

রাষ্ট্রের লোক হয়ে, আইনের লোক হয়ে ক্ষমতার দম্ভে আমাদের চুপ থাকতে বলেন? আমাদের হাত ভেঙ্গে দেয়ার কথা বলেন? আমাদের পাকিস্তান চলে যাওয়ার কথা বলেন? আমরা ইসলামের কথা বলে পাকিস্তান নয়, আপনার বুলেটে কবরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত।

মনে রাখবেন, সকলের সাথে আল্লাহ তায়ালা “ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা” লাগিয়ে দিয়েছেন। যাদের নাম ‘মুনকার-নাকির’। “আপনার ইহজগতের সব কর্মকান্ড ঐ মহান সত্ত্বা স্বয়ং নিজে পর্যবেক্ষণ করছেন, যে সত্তা ইস্রাফিলের শিঙ্গার এক ফুঁৎকারে ফেরেশতাকূল সহ তার সকল মাখলুককে এই জগতকে ধ্বংস করে দিবেন। আবার সেই শিঙ্গার দ্বিতীয় ফুঁৎকারে সবকিছুকেই পুনরুত্থিত করবেন। এই দুনিয়াকে বানানো হবে হাশরের ময়দান। সকলেই নিজ নিজ কবর থেকে উলঙ্গাবস্থায় উঠবে, যেভাবে দুনিয়ায় দানা থেকে উদ্ভিদের শীষ উদ্গত হয়। আমলনামা নিয়ে দৌড়াদৌড়ি শুরু করবে। আর বলবে-

ما لهذا الكتاب لا يغادر صغيرة ولا كبيرة إلا أحصاها.

হাশরের ময়দানে জালেমদের সকল দম্ভ চূর্ণ হবে। সেদিন তারা বলবে- ربنا ماكنا مشركين কিন্তু আল্লাহর পক্ষ হতে ঘোষিত হবে-

اليوم نختم على أفواههم وتكلمنا أيديهم وتشهد أرجلهم بما كانو يكسبون.

আপনার যবান বন্ধ হয়ে যাবে, সাক্ষ্য দেবে আপনার হাত। যবান বন্ধ হয়ে যাবে, সাক্ষ্য প্রদান করবে আমার আপনার পা। সাক্ষ্য দেবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ। দম্ভকারীদের দম্ভ সেদিন চূর্ণ হবে।”

আমাদের মামলা তো ঐ উচ্চ আদালতে। দুনিয়ার নিম্ন আদালতে আমাদের কোন মামলা নাই, আমাদের সব মামলা ঐ মহান সত্ত্বার আদালতে, যে মহান সত্ত্বা এই বিশাল ভূমণ্ডলকে চোখের পলকে সৃষ্টি করেছেন, বিস্তৃত করেছেন এবং তা কে সূচারুরূপে পরিচালনা করছেন। আমাদের মামলা হাত ভেঙ্গে দেয়ার মামলা নয়। আমাদের মামলা লেজ কেটে দেয়ার মামলা নয়। আমাদের মামলা দম্ভ/বড়ত্ব প্রকাশের মামলা নয়! আমাদের মামলা হল, বিপথগামীদের জন্য হিদায়াতের মামলা।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আমাদেরকে হিদায়াত দান করুন, আমদেরকে বুঝার আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

– আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক- জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা-ঢাকা, সাংগঠনিক সম্পাদক- জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- উত্তরা রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা, খতীব-  উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ এবং উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডট কম।

অনুলিখনে- মাহমূদ হাসান নাহিয়ান

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।