Home পরিবার ও সমাজ সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা দিন দিন কেন বাড়ছে?

সামাজিক ও পারিবারিক জীবনে অস্থিরতা দিন দিন কেন বাড়ছে?

-ফাইল ছবি।

।। তৈমূর আলম খন্দকার ।।

নেপোলিয়ন বলেছিলেন, আমাকে একজন শিক্ষিত ‘মা’ দাও, আমি তোমাদের একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ রয়েছে- Charity begins at home। অর্থাৎ বদান্যতা নিজ ঘর থেকে শুরু করো। দুটি উক্তিতেই একেকটি ‘পরিবারকে’ সুনির্দিষ্টভাবে যথেষ্ট গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। শিষ্টাচার শিক্ষার ক্ষেত্রে একটি পরিবার একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও অধিক কার্যকর। ভূমিষ্ঠ শিশু প্রথমে কথা বলতে ও হাঁটতে শেখে পরিবার থেকেই। শিশু বড় হওয়ার সময় পিতা-মাতাসহ বয়োজ্যেষ্ঠদের যা করতে দেখে তা থেকেই শিক্ষা লাভ করে, কারণ শিশুরা অনুকরণপ্রিয়, যা দেখে সে মতেই অনুকরণ এবং তা নিজের ওপর প্রযোজ্য বলে বিশ্বাস করে।

ধর্ম একটি অনুশাসন, একটি শাসনব্যবস্থা। মানুষের সার্বিক কল্যাণ রয়েছে অনুশাসনের ওপর। মানুষের ‘মন’ অনেক কিছু পেতে বা করতে ইচ্ছা করে, কিন্তু সে ইচ্ছার বাস্তবায়ন অনুশাসনের মধ্যে করতে হবে। অনুশাসন বা সামাজিক শিষ্টাচার মোতাবেক যদি নিজেকে কোনো ব্যক্তি পরিচালিত না করে, নিজেকে নিজে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারে তখনই সৃষ্টি হয় পারিবারিক তথা সামাজিক বিপত্তি। মানুষ সামাজিক জীব। এ সমাজ একদিনে গঠিত হয় নাই, তিলে তিলে গড়া ‘সমাজ’ এখন কার্যত ‘আধুনিকতার’ নামে বিলীন হতে বসেছে। যুগে যুগে ‘তৈল মর্দন’ প্রিয় শাসনকর্তাদের দ্বারা সামাজিক ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়েছে বটে, কিন্তু যুগে যুগে সংস্কারকরা পৃথিবীতে আগমন করে ‘সমাজ’কে নিজস্ব নিয়মে চলতে উদ্বুদ্ধ করেছেন।

মানুষ নিজেই একটি Animal; তবে Social animal একটি কারণে তা হলো ‘মানুষের বিবেক’, অন্য কোনো প্রাণীর যা নেই। বিবেকে যখন পচন ধরে তখনই সে উল্টোপথে হাঁটতে থাকে এবং সমাজকে বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে নিজ ইচ্ছেমতো চলার জন্য নিজ ধারণা মতে একটি Life Style তৈরি করে এবং দিনে দিনে পাপে নিমজ্জিত হয় যা থেকে ফিরে আসা আর সম্ভব হয় না। একটি পরিবারে একজন অন্য একজনের পাহারাদার হিসেবে কাজ করে।

পারিবারিক ব্যবস্থায় মানুষ যদি একটি বন্ধনের মধ্যে থাকে তবে একজন আরেকজনকে Care করতে পারে। উচ্ছৃঙ্খল নর-নারীরা পরিবার বা সমাজে টিকতে না পেরে পরস্পর আলাদা হয়ে পড়ে এবং নিজেকে নিজের জন্য Sufficient মনে করে, যা সম্পূর্ণ ভুল ধারণা। ‘ব্যক্তি’ কোনো দিনই স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, সমষ্টি বা সংঘবদ্ধ জীবনযাপনই খুব শক্তিশালী।

আরও পড়তে পারেন-

আধুনিকতার নামে উচ্ছৃঙ্খলতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এ জন্য যৌন হয়রানি, ধর্ষণ ও অন্যান্য অপরাধের সৃষ্টি হয়। কথিত আধুনিকতার কারণেই রাজধানীর হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ করেছিল ধনাঢ্যের পুত্র। মামলা হয়ে গ্রেফতার হওয়ার পরে তার বাবা মিডিয়াতে যা বলেছেন তাতে তিনি অনুতপ্ত না হয়ে উল্লসিত হয়েছিলেন। এতে প্রতীয়মান হয়, যেমন বাবা তেমনি ছেলে। পরিবারটিতে যদি অনুশাসন থাকত তবে ছেলের এ ধরনের অপরাধের জন্য বাবার অনুতপ্ত হওয়া উচিত ছিল। বরং অনুতপ্ত না হয়ে দাম্ভিকতা প্রকাশ করেছেন তিনি। মনে হলো এ ধরনের অপরাধ তার কাছে যেন অপরাধই নয়।

এ দিকে, কিশোর গ্যাং অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। পুলিশ ইতোমধ্যে অনেক কিশোর গ্যাংকে গ্রেফতার করেছে। কিন্তু গ্রেফতার করাই কি এর একমাত্র সমাধান? যেসব কিশোর পরিবারের অনুশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে তারাই এখন ‘কিশোর গ্যাং’। তা ছাড়া ডিজিটাল মোবাইল ফোন, সিনেমা, নাটকের অরুচিশীল এবং অ্যাডভেঞ্চার জাতীয় দৃৃশ্য দেখে বলে চুলের স্টাইল, পোশাক পরিচ্ছদ, কথা বলার ভাবভঙ্গি, চলা ফেরা ইত্যাদি কিশোরদের উৎসাহিত করে এবং সে থেকেই কিশোর গ্যাং সৃষ্টি। ওরা এখন এতই বেপরোয়া যে, তারাই খুন, রাহাজানি, মাদক ব্যবসায় জড়িত হয়ে পড়েছে এবং এগুলো হচ্ছে গডফাদারদের নিয়ন্ত্রণে। ‘গডফাদার’ শব্দের উৎপত্তি হয়েছে ভারতীয় সিনেমা, প্রতি ঘরে ঘরে ভারতীয় চ্যানেল অ্যাডভেঞ্চারমূলক এবং একটি পরিবারে পরকীয়ার মাধ্যমে কিভাবে ধ্বংস হয়ে যায় সে দৃশ্যই প্রদর্শন করে। এগুলো অনুকরণ করে সমাজে অবহেলিত কিশোররা ছোট ছোট অপরাধ থেকে পরবর্তী সময়ে কিশোর গ্যাং হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।

পরিবারের অভ্যন্তরীণ শিষ্টাচারবহির্ভূতভাবে পরপুরুষ বা পর নারীর সাথে অনৈতিক সম্পর্ক রাখাই হলো পরকীয়া। তা এখন সমাজে মহামারীর আকার ধারণ করেছে। যে পরিবারের আন্তরিকতা নেই, সে পরিবারেই পরকীয়া জন্ম লাভ করে। যে ব্যক্তি পরিবারবদ্ধ আছে, তার অবশ্যই জবাবদিহিতা রয়েছে। মানুষ জবাবদিহিতার আওতাভুক্ত থাকলে পরকীয়া প্রেম সহজে চালিয়ে যেতে পারে না। সম্প্রতি একটি ইংরেজি পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, প্রতিদিন গড়ে ৩৯টি বিয়ে বিচ্ছেদ ঢাকা মহানগরীতে হয়ে থাকে। একটি বিয়ে বিচ্ছেদ একটি পরিবারে ডেকে আনে চরম ভোগান্তি। এর কারণ পারস্পরিক অবিশ্বাস, পরকীয়া, আপার সোসাইটির জৌলুসপূর্ণ খরচের ব্যয় মেটাতে ব্যর্থতা প্রভৃতি। অনেক সময় স্বামীর বিপথে গমন বা স্ত্রীর বিপথে গমনের কারণেও বিয়ে বিচ্ছেদ হয়ে থাকে।

একটি পরিবার যদি এক টেবিলে বসতে পারে, হোক তা নাশতার টেবিলে বা নৈশভোজ, পারস্পরিক মতবিনিময়ই এখানে বেশি প্রযোজ্য। একটি পরিবারে যদি পাঁচজন নারী-পুরুষ সদস্য থাকে, সেখানে দেখা যায় পাঁচজনের ঘরেই টেলিভিশন এবং আলাদা আলাদাভাবে তারা টেলিভিশন দেখে সময় কাটাচ্ছে, কাজের লোক যার যার টেবিলে খাওয়া দিয়ে আসছে এবং উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েরা স্মার্টফোন টিপাটিপি নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকে যে, একজন আরেকজনের সাথে কথা বলার সময়ই বের করতে পারে না। এ ধরনের মানসিকতা থেকেই পারিবারিক বিপর্যয়ের উৎপত্তি হয়ে থাকে। পত্রিকা খুললেই দেখা যাচ্ছে, পরকীয়ার কারণে মা কর্তৃক সন্তান খুন, বাবা কর্তৃক ছেলে খুন, স্বামী কর্তৃক স্ত্রী খুন, স্ত্রী কর্তৃক স্বামী খুন। এমনকি, শ্বশুর কর্তৃক পুত্রবধূকে ধর্ষণ প্রভৃতিসহ চরমভাবে ঘৃণা করার মতো অনেক নারকীয় ঘটনা।

পৃথিবী যখন পাপে নিমজ্জিত হয়ে পড়ে তখনই মহামারী শুরু হয়। পবিত্র কুরআন শরিফের ভাষ্য মতেই এ কথাটি সত্য। কারণ পবিত্র কুরআন শরিফে আল্লাহ পাক মানবজাতিকে বহুবার অশ্লীলতা, অনাচার ও অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে দূরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তিনি হিসাব গ্রহণে তৎপর। করোনা মহামারী চলছে এখন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ডিজি ভবিষ্যতে মহামারী আরো প্রকট আকার ধারণ করবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। পৃথিবী যখন অশ্লীলতায় নিমজ্জিত হয় তখনই মহামারীর উৎপত্তি হয়ে থাকে এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। অশ্লীলতাকে রোধ করার জন্য আল্লাহ কর্তৃক নির্দেশিত জীবনব্যবস্থা, ইসলাম পারিবারিক ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দিয়েছে, যার অন্যতম উপাদান বিয়ে প্রথা।

সমকামিতার অপরাধে লুত সম্প্রদায়কে আল্লাহ ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। অন্যায় অত্যাচারে নিমজ্জিত হওয়ার কারণে নূহ আ:-এর সাথে নৌকায় উঠে পড়া প্রাণী ছাড়া সবাইকেই বন্যার পানিতে ডুবিয়ে মেরেছেন তিনি। যখনই অপরাধ বিশেষ করে অশ্লীলতা সীমা লঙ্ঘন করে তখনই আল্লাহপাকের ভয়াবহ গজব পৃথিবীতে নেমে আসে। ঘৃণ্য অপরাধ সমকামিতাকে পৃথিবীর অনেক রাষ্ট্র অনুমোদন দিয়েছে। একই লিঙ্গের তথাকথিত বিয়ে উন্নত রাষ্ট্রে আইন করে বৈধতা দিয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ‘ইসলাম’। অথচ আমরা নামধারী মুসলমানরা ‘ইসলাম’ থেকে বর্তমানে অনেক দূরে। এই দূরত্বই ধ্বংসের শেষপ্রান্তে আমাদের জাতিকে পৌঁছে দিচ্ছে।

নিত্যনতুন মাদক বাংলাদেশে আমদানি হচ্ছে, ফেনসিডিল ও ইয়াবার ব্যবহার এখন চরম পর্যায়ে। বস্তিবাসী থেকে শুরু করে উচ্চ শিক্ষিত ও সম্পদশালী বাবার সন্তানরা দলবেঁধে কোনো গোপন আড্ডায় মিলিত হয়ে, এ নেশার জগতে প্রবেশ করে, যা থেকে শত চেষ্টা করেও ফিরিয়ে আনা যায় না। পারিবারিক শিক্ষার মাধ্যমে যদি তাদের শিষ্টাচার ও ধর্মীয় অনুশাসনে আনা যেত তবে নেশার আড্ডায় কিশোর-কিশোরী বা যুবক-যুবতীরা প্রবেশ করতে পারত না।

‘লিভ টুগেদার’ অর্থাৎ বিয়ে ব্যতীত একই ছাদের নিচে ও একই ঘরে স্বামী স্ত্রীর মতো বসবাস করা। ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট এটাকে আইনগত বৈধতা দিয়েছে, যা অত্যন্ত ন্যক্কারজনক। ভারত সরকার সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ কিংবা রিভিউ করার জন্য পিটিশন করেনি। এতে বুঝা যাচ্ছে, লিভ টুগেদারের প্রতি জনগণের সবার সমর্থন না থাকলেও সরকারের রয়েছে। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে তা খুবই অশ্লীল। এ ধরনের অশ্লীলতার জন্যই কোরআনিক ভাষ্য মতে, করোনার মতো মহামারীর উৎপত্তি ঘটে যার ওষুধ এখনো বাংলাদেশে পৌঁছায়নি। ভবিষ্যৎ মহামারী থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য আমাদের অশ্লীলতাবিরোধী পদক্ষেপ নেয়া আবশ্যক।

পবিত্র কুরআন শরিফে বলা হয়েছে, মা-বাবার কাছে বাহু উঁচিয়ে কথা না বলা বা এমন কোনো কাজ না করা এবং সন্তান কর্তৃক এমন ব্যবহার না করা যাতে মা-বাবা কষ্ট পেয়ে ‘উহ্’ শব্দ উচ্চরণ করেন। এত কঠিন নির্দেশ থাকার পরও কুলাঙ্গার সন্তানরা শুধু সম্পত্তির লোভের কারণে মা-বাবাকে পিটিয়ে ঘর থেকে বের করে দিচ্ছে, অথচ আমরা নিজেদের ‘সভ্য’ বলে দাবি করি। বর্তমানে করোনা গজব এসব অপরাধেরই প্রতিফলন যা মানুষ নিজের কর্মফলে ডেকে এনেছে।

– তৈমূর আলম খন্দকার, রাজনীতিক, কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)।
E-mail: taimuralamkhandaker@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।