Home ইসলাম ‘চোখ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই সকল দম্ভ ও আস্ফালন বিলীন হয়ে যাবে’

‘চোখ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই সকল দম্ভ ও আস্ফালন বিলীন হয়ে যাবে’

- আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান। ছবি- উম্মাহ।

।। আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

[ঢাকা উত্তরার জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী (৮ জানুয়ারী) শুক্রবার জুমায় খুতবার পূর্বে মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

হামদ-সালাতের পর আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান বয়ানে বলেন- “আল্লাহ তায়ালা ফেরেশতাদের অনাগ্রহ সত্ত্বেও আমাদের আদি পিতা হযরত আদম (আ.)কে সৃষ্টি করলেন, মা হাওয়া (আ.) কে সৃষ্টি করলেন । অতঃপর আমাদের স্থায়ী নিবাস জান্নাতে কিছুদিন বাস করার সুযোগ দিলেন।

এই দুনিয়া তো আমাদের অস্থায়ী নিবাস। আমাদের স্থায়ী আবাস তো হল জান্নাত; যার ওয়াদা আল্লাহ তায়ালা করেছেন। তারপরও আমরা এই দুনিয়ার মরিচিকার পেছনে দৌড়ে আমাদের হায়াত নষ্ট করছি।

এই দুনিয়া হল মোমবাতির মত, যাতে আলোও আছে, আবার দহনও আছে। যার থেকে আলো বিচ্ছুরণ হয়, আবার এর কাছাকাছি ঘেঁষলে পুড়ে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সেই মোমবাতির বাহ্যিক আলো দেখে কীট-পতঙ্গরা এর কাছাকাছি আসে। যেখানেই থাকুক সেই আলো তাকে চরমভাবে আকর্ষণ করে। সে এর থেকে দূরে থাকতে পারে না। চলে আসে কাছাকাছি। আরো কাছে আসে, আরো কাছে আসে। কাছে আসতে আসতে একসময় এর দহনের ভেতর চলে আসে এবং ভস্মিভূত হয়ে নিঃশেষ হয়ে যায়।

এভাবে আরেকটা আসে, ভস্ম হয়, আরেকটা আসে শেষ হয়। একসময় দেখা যায় যে, হাজার হাজার পোকামাকড় মোমবাতির নিচে ভস্মীভূত হয়ে পড়ে আছে। আরো হাজার হাজার পতঙ্গ মোমবাতির আলোতে উড়ছে। এটা যে তাকে নিঃশেষ করে দেবে, এই শিক্ষা সে পূর্ববর্তীদের থেকে নেয় না। নিতে পারে না। কারণ, তাকে বিবেক দেয়া হয়নি। আর মূল্যবাণ বিবেক দেয়া হয়েছে একমাত্র “আশরাফুল মাখলুকাত” মানুষকে। কিন্তু সেই মানুষও এই দুনিয়ার মরিচিকার পেছনে ছুটে বেড়ায়। তাকে তার বিবেক বাধা প্রদান করে। কিন্তু তার সস্তা আবেগ তথা নফসের কাছে তার মূল্যবান বিবেক হেরে যায়। সে দুনিয়ার কাছে আসে, আরো নিকটবর্তী হয়, এমন হতে হতে একসময় সে এতে ডুবে যায়। তার জীবন ধ্বংস হয়ে যায়। সেখান থেকে উঠে আসার আর কোন উপায় থাকে না, সেখান থেকে উত্তরণের কোন রাস্তাই আর খোলা থাকে না।

দেখা যায় যে পূর্ববর্তী হাজার হাজার মানুষ এতে ডুবে ধ্বংস হয়ে আছে, আর পরবর্তী আরো হাজার হাজার মানুষ সেই মরিচিকার পেছনে দৌড়াচ্ছে। কেউই পূর্ববর্তীদের থেকে শিক্ষা নেয় না। কারণ, তারা তাদের নফসের কাছে পরাজিত। তাদের অতি মুল্যবান আদালত (বিবেক) তাদের সস্তা আবেগের কাছে পর্যদুস্ত। এই দুনিয়া হল মৌমাছির জন্য মোমবাতির মত বিধ্বংসী মোহময়, বরং তারচেয়েও ভয়ংকর।

দুনিয়ার জীবনে যারা তাদের বিবেককে কাজে লাগায়, তারা ক্ষমতা দেখায় না। তারা দাম্ভিকতা প্রদর্শন করে না। কোন ক্ষমতাসীন কি বলে যে, আমি মন্ত্রী, তাই আমি সবার চেয়ে উঁচু জায়গায় সিজদা করবো? আমার সিজদাহ্ এর জায়গাটা সাধারণ মুসল্লীদের চেয়ে দুই ইঞ্চি উঁচু হবে? বরং মসজিদের সামনের ভিখারি যেই জমীনে সিজদাহ্ করে ঐ ক্ষমতাসীন বাদশাহও সেই একই জমীনেই সিজদাহ্ করেন। আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেন না যে, আমি তাহাজ্জুদ দিয়ে দিন শুরু করি? আমি কুরআন তিলাওয়াত দিয়ে দিন শুরু করি? কারণ, বিবেককে কাজে লাগায় বলেই এ উক্তিটা করে।

ক্ষমতাসীন হলেই দাপট দেখাতে হবে এবং দম্ভভরে চলতে হবে- এই থিউরি কোথায় পেয়েছেন? আজ ক্ষমতার দম্ভে বিশ্বের কোন কোন জায়গায় দম্ভোক্তি করা হয় যে, ‘বিশ্বের যে কোন প্রান্তে আমাদের জন্য হুমকি মনে হলে আমরা সেখানে অভিযান পরিচালনা করার ক্ষমতা রাখি। এক্ষেত্রে আমাদের কারো অনুমতির প্রয়োজন নেই। এমনকি যে দেশের সীমারেখায় অভিযান চালাবো সে দেশের সরকারেরও অনুমতির প্রয়োজন নেই!’

কতটুকু ক্ষমতা পেয়েছেন যে, এতো আস্ফালন দেখান। চোখ বন্ধ হওয়ার সাথে সাথেই সব আস্ফালন বিলীন হয়ে যাবে। মিশরের বাদশাহগণ আপনার চেয়ে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতার অধিকারী ছিলো, আপনার চেয়েও অঢেল সম্পদের মালিক ছিলো। তারা মারা যাওয়ার পর ক্ষমতার দাপটে তাদের আপন শরীর কে ঠিক রাখার জন্য তাদের আকৃতিকে অক্ষত রাখার মানসে নিজের শরীরকে ‘মমি’ করে নিতো এবং কবরকে অনেক উঁচু করতো। রাজার লাশের সাথে কয়েক যুগ চলার মত খাবার পানীয় দিয়ে দিতো। অঢেল স্বর্ণ রৌপ্য মণি-মুক্তা ইত্যাদি কবরে দিয়ে দিতো, আরো দিতো দাস দাসী নর্তকী আর নিরাপত্তা রক্ষী। সব দিয়ে তারপর মাটি চাপা দিতো। যেগুলো আমরা আজ মিশরীয় পিরামিড নামে চিনি।

আরও পড়তে পারেন-

আজ হাজার বছর পর বিশ্ব চোরেরা পিরামিড খুঁড়ে সেখান থেকে সেই সমস্ত সম্পদ ইত্যাদি হাতিয়ে নিচ্ছে। আর এর মাধ্যমে শাশ্বত সত্য যেটা উদঘাটিত হল, সেটা হচ্ছে মৃত্যুর পর দুনিয়াবি কিচ্ছুই কাজে আসে না। কাজে যেটা আসে সেটা হল নেক আমল।

ক্ষমতা চালাবেন তো হযরত সুলাইমান (আ.)কে অনুকরণ করুন, নমরূদকে নয়। নেতৃত্ব পরিচালনা করবেন তো হযরত উমর ইবনুল খাত্ত্বাব (রাযি.)কে অনুসরণ করুন, ফিরআউনকে নয়। অঢেল সম্পদের মালিক হবেন তো হযরত উসমান ইবনে আফফান (রাযি.)কে আইডল বানান, কারুনকে নয়।

আল্লাহ তায়ালা হযরত সুলাইমান (আ.)কে ক্ষমতা দিলেন। কেমন ক্ষমতা? বর্তমান বাদশাহদের মত সীমিত ক্ষমতা নয়। সারা দুনিয়ার ক্ষমতা দিলেন। সুলাইমান (আ.) বলেন, আমাকে রাজত্ব দিয়েই তো পরীক্ষা করবেন।

ھب لی ملكا لاينبغي لأحد من بعدي “আমাকে এমন রাজত্ব দান করেন, যা পরবর্তীতে কাউকে দান করা হবে না”। যেন চুড়ান্ত পরীক্ষা দিতে পারি।

আল্লাহ তাআলা বলেন যে, এটা তো আমার কাছে কিছুই না। যাও, দিয়ে দিলাম। হযরত সুলাইমান (আ.) বাদশাহ হলেন। তার তখতে সুলাইমানী নিয়ে এক সকালে এক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে যেতেন। বিকেলে আবার সেই এক মাসের পথ পাড়ি দিয়ে রাজ্যে ফিরে আসতেন (غدوہا شهر ورواحها شهر) । কি ছিল সেই “তখতে সুলাইমানী?” তা হল সুলাইমান (আ.)এর সিংহাসন, মন্ত্রী পর্ষদ, তাদের আসন সমূহ, কেবিনেট, কেবিনেট পরিচালনা কমিটি, দাসদাসী, সংসদ সদস্য এবং এসব কিছুর শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য নিরাপত্তা বাহিনী। তাঁর নিরাপত্তা বাহিনীতে মানুষ থেকে শুরু করে পশু-পাখি, দৈত্য-দানব সব ছিল। এসব মিলিয়ে মোটামুটি একটা বিমান বহর। এই হল “তখতে সুলাইমানী”।

একদিন সভা বসলো। সুলাইমান (আ.)এর এক সংসদ সদস্য ‘হুদহুদ পাখি’ নাই। কেমন সেই হাজিরা খাতা যে খাতায় এতো এতো সভাসদের মাঝে এই ছোট্ট হুদহুদ পাখির অনুপস্থিতি ধরা পড়লো! বিস্ময়কর।

তিনি বললেন, যদি সে তার অনুপস্থিতির সঠিক কারণ ব্যখ্যা দিতে না পারে, তাহলে তাকে কঠিন শাস্তি দেবো। কেমন বাদশাহ যে অনিয়মের জন্য পাখিকেও ছাড় দেন না!

হুদহুদ পাখি এসে বলল, জাহাপনা! শামে তো এমন এক মহিলা আছে, যে রাজ্য পরিচালনা করে আবার কুফুরীও করে। সুলাইমান (আ.) বললেন, কে তার সিংহাসন নিয়ে আসতে পারবে? তার সভাসদের জীনদের মধ্য থেকে এক শক্তিশালী দানব বলল যে, আপনি আপনার স্থান থেকে উঠার পুর্বেই আমি তা হাজির করতে পারবো। সুলাইমান (আ.) বললেন, উঁহু! দেরি হয়ে যাবে। তখন সভাসদের মাঝ থেকে কিতাবী ইলম ওয়ালা এক সদস্য বললেন যে, আপনি আপনার চোখের পলক ফেলার পূর্বেই আমি তা উপস্থিত করতে পারবো (انا اتيك به قبل ان يرتد اليك طرفك)। সিংহাসন নিয়ে আসা হল। রানী বিলকিস অবাক হয়ে গেলেন! আরে, আমার এতো মুল্যবান সিংহাসন কোথায়? এতো মণি-মুক্তা খচিত সিংহাসন! এতো এতো প্রটোকল! সব ভেঙ্গে কোথায় হাওয়া হয়ে গেল? সুলাইমান (আ.) পত্র প্রেরণ করলেন।
انه من سليمان وانه بسم الله الرحمن الرحيم রানী বিলকিসের সভাসদবৃন্দ বলল, আমরা অনেক শক্তিশালী। চলুন যুদ্ধ লড়ি।

রানী বিলকিস ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমতী নারী। তিনি বুঝলেন, “যে বাদশা আমার এতো বড় সিংহাসন চোখের পলকে নিয়ে যেতে পারে, না জানি সেই বাদশাহর শক্তি কত বেশি? সে কোন সাধারণ বাদশা নয়”। তিনি দুটি মণি-মুক্তা খচিত স্বর্ণের দুটি ইট উপহার প্রেরণ করলেন এই আশায় যে, পরিস্থিতি কিছুটা সহজ করা যায় কি-না!

সুলাইমান (আ.) তার চৌকস গুপ্তচর ‘হুদহুদের’ মাধ্যমে তা জানতে পারলেন এবং তাদেরকে সাদরে সম্ভাসন জানানোর জন্য তার প্রাসাদ থেকে দেশের সীমানা পর্যন্ত মণি-মুক্তা খচিত স্বর্ণের ইট দ্বারা রাস্তা নির্মাণ করলেন। মাঝে হীরা জহরত দিয়ে নির্মাণ করলেন ‘রোড ডিভাইডার’।

রানী বিলকিসের প্রেরিত দূত এলো। তাদের চক্ষু চড়কগাছ! কার কাছে কি উপহার নিয়ে আসলাম? তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে রানী বিলকিসকে বললেন, রানী মশাই! জলদি গিয়ে মাফ চান!

প্রিয় মুসল্লিয়ানে কেরাম! এতো এতো ক্ষমতার অধিকারী সুলাইমান (আ.) তাঁর শেষ জীবনে অসিয়ত করে গেলেন যে, “যখন আমার লাশ নিয়ে যাওয়া হবে, তখন যেনো আমার কাফনের ভেতর থেকে আমার হাতদুটো বাইরে বের করে রাখা হয়, মানুষকে এটা শিক্ষা দেয়ার জন্য যে, প্রচন্ড ক্ষমতাধর সুলাইমান (আ.)ও খালি হাতেই দুনিয়া থেকে কবরে ফিরে গেছেন।

وما هذه الحياه الدنيا الا لهو ولعب৷ এই দুনিয়া খেল-তামাশা বৈ কিছুই নয়। তাই নফসে শয়তানীর ধোকায় পড়ে দুনিয়ার পিছনে না পড়ে আমরা আখেরাতমুখী হই। আখেরাতমুখী হওয়া মানে দুনিয়া ছেড়ে দেয়া নয়। বনবাসে যাওয়া নয়। বরং নেক আমল করা আল্লাহর আদেশ-নিষেধ মেনে চলা।

একবার যদি খাস নিয়তে سبحان الله والحمد لله ولا اله الا الله والله اكبر পড়েন, তাহলে আখেরাতে এটারও বিশাল সওয়াব পাবেন। আল্লাহ আমাদের বুঝার আমল করার তাওফীক দান করুন। আমিন।”

– আল্লামা হাফেয নাজমুল হাসান কাসেমী, প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক- জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া-উত্তরা ও রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসা এবং খতীব-  উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদ এবং উপদেষ্টা- উম্মাহ ২৪ ডট কম।

অনুলিখনে- মাহমূদ হাসান নাহিয়ান

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।