Home সম্পাদকীয় বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা রাজনীতিতে অনগ্রসর কেন?

বাংলাদেশের ইসলামপন্থীরা রাজনীতিতে অনগ্রসর কেন?

।। তারেকুল ইসলাম ।।

বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের যেটা সবকিছুর আগে বুঝা দরকার ছিল, সেটা হলো- এখানকার জনগণের প্রচলিত রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, বোধ ও অভিজ্ঞতা এবং তাদের রাজনৈতিক ঐতিহ্য ও ইতিহাস। এগুলো গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও উপলব্ধি না করে কোনো আদর্শিক বা ধর্মভিত্তিক রাজনীতিই এদেশে খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারবে না। বামপন্থী ও সেকুলারদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

ধরুন, আপনি ইসলামী রাজনীতি করছেন। কিন্তু আপনি সারাক্ষণ ইসলাম কায়েম করবেন, ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করবেন, দুনিয়ায় আল্লাহর হুকমত প্রতিষ্ঠা করবেন বলে মাইক ফাটিয়ে জযবা দেখান।

কিন্তু শেষপর্যন্ত দেখা যায়, জনগণ ভোট দিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ দেয় মূলত আওয়ামী লীগ বা বিএনপি’কে। অথচ ক্ষমতার রাজনীতিতে আপনাদেরকে জনগণ রাষ্ট্রক্ষমতায় যাওয়ার সরাসরি সুযোগ দেয় না। এর কারণ কী?

এর কারণ আমার মতে, আমাদের মূলধারার জনগণ মডারেট ইসলামপন্থা কিংবা ট্রাডিশনাল ইসলামপন্থা- এসব বুঝে না। যেমন সেকুলারিজম বা সমাজতন্ত্রও তারা বুঝে না। কিন্তু আমাদের জনগণ ঠিকই গণতন্ত্র বুঝে, ভোটাধিকার বুঝে, নির্বাচন বুঝে, ভোট দিয়ে তাদের জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করার সিস্টেমে তারা অভ্যস্ত।

কিন্তু ক্ষমতার দৌড়ে এসে আপনার আদর্শিক বা ধর্মীয় রাজনীতি মার খাওয়ার কারণ হলো: আপনি তো কেবল ইসলামী রাষ্ট্র কায়েমের জযবা দেখান, কিন্তু ক্যামনে কী করবেন এবং জনগণকে কীভাবে এক্ষেত্রে সম্পৃক্ত করবেন- আপনার সেই রাজনৈতিক কৌশল ও কর্মপন্থা সম্পর্কে আপনি জনগণকে বুঝাইতে এবং কনভিন্স করতে ব্যর্থ।

আর ব্যর্থ বলেই আপনি ক্ষমতার রাজনীতিতে জনসমর্থন আদায় করতে পারেন না। সেজন্যই শেষতক আপনার হাতে ক্ষমতাও আর আসে না। এই বাস্তবতা অস্বীকার করার সুযোগ নাই।

তাহলে আপনাদের এখনকার করণীয় কী? সেটা হলো: এদেশের জনগণের বিদ্যমান রাজনৈতিক শিক্ষা-দীক্ষা, অভিজ্ঞতা এবং তাদের রাজনৈতিক বোধ ও ইতিহাস-ঐতিহ্য বুঝার চেষ্টা করা। সেটা যদি আপনার রাজনীতির সাথে খাপ খায়, তাহলে তো ভালোই! আর যদি খাপ না খায়, তাহলে আপনার উচিত ব্যাপক গণসংযোগের মাধ্যমে জনগণকে আপনার রাজনীতির দীক্ষা দিয়ে তাদের পূর্বের রাজনৈতিক বোধজ্ঞান পরিবর্তন করা। অন্যান্য প্রচলিত রাজনীতির চেয়েও যে আপনার ইসলামী রাজনীতি আরো উত্তম— এটা প্রায়োগিকভাবে তাদের বুঝানো।

অন্যথায় আপনি আপনার রাজনীতির পক্ষে জনসমর্থন আদায় করতে পারবেন না বলেই আমার ধারণা। জনসমর্থন না পেলে আপনার রাজনীতি– নামে যতই ইসলামিক হোক, জনগণের তাতে কিছুই যায় আসে না। কারণ, ইসলাম বলতে জনগণ এখন বুঝে যে, মসজিদ, মাদ্রাসা, দ্বীন শিক্ষা, পাঁচ স্তম্ভ, দোয়া-দরূদ, পরকাল, বেহেশত-দোজখ ইত্যাদি। এর বেশি কিছু তারা জানে না। রাজনৈতিকভাবে এর বেশি জানাতে হলে আপনাদেরকেই কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে।

আপনার রাজনীতি সম্পর্কে জনগণকে ক্লিয়ার ধারণা দিতে হবে। আপনার রাজনৈতিক কৌশল, কর্মপন্থা ও কর্মসূচী জনগণের কাছে তুলে ধরতে হবে। আপনি যদি ভাবেন যে— জনগণই এসে আপনার দলীয় বা সাংগঠনিক বইপুস্তক পড়ে আপনার ইসলামী আন্দোলন সম্পর্কে জেনে নিবে, তাহলে আপনি ভুল করবেন। আপনার সাংগঠনিক লিটারেচার পড়ার অতো টাইম জনগণের নাই, বুঝছেন? আপনার বক্তব্য আপনাকেই সরাসরি জনগণের কাছে নিয়ে উপস্থিত হতে হবে। দলীয় মনোবৃত্তি ও ক্যাডারভিত্তিক সাংগঠনিক গোঁড়ামির ঊর্ধ্বে উঠে মূলধারার জনগণের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত হতে হবে।

ধর্ম ও আদর্শকে শুধু থিওলজিকাল কিংবা থিওরেট্রিকাল জায়গায় আটকে রাখলে আপনার রাজনীতি বেশিদূর আগাবে না। বিশেষ কোনো আদর্শ বা ধর্ম আপনার রাজনীতির ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু রাজনীতিকে আগায়ে নিতে হলে দরকার প্রয়োগবাদের চর্চা। সময় ও প্রেক্ষাপট বুঝে রাজনৈতিক কলা-কৌশল ও কর্মপন্থা নির্ধারণ করা অত্যাবশ্যক। সেই মোতাবেক জনসমর্থন আদায় করতে হয়। তারপর গিয়ে আপনার রাজনীতি পরিণতি পাবে। এইবার বুঝে দেখেন- আপনার রাজনীতি কতটুকু নাদান ও নাবালক অবস্থায় আছে!

– ত্বরিকুল ইসলাম, রাজনৈতিক বিশ্লেষক, গবেষক ও জাতীয় ইংরেজি পত্রপত্রিকার কলামিস্ট।