Home ইতিহাস ও জীবনী দারুচিনির ইতিহাস: আভিজাত্যের প্রতীক থেকে সাধারণ মসলা

দারুচিনির ইতিহাস: আভিজাত্যের প্রতীক থেকে সাধারণ মসলা

চা থেকে সেমাই, অথবা গরুর কালাভুনা থেকে খাসির রেজালা- সবকিছুতেই দারুচিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ মসলা হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বর্তমান সময়ে দারুচিনির ব্যবহার রান্নাঘর কেন্দ্রিক হলেও, অতীতে এটি ছিল সমৃদ্ধি ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। ইতিহাসের পাতা ঘাঁটলে দেখা যায়, যিশুখ্রিস্টের জন্মের প্রায় দু’ হাজার বছর আগেও মিশরীয়রা দারুচিনির ব্যবহার সম্পর্কে অবগত ছিল।

প্রাচীন মিশরীয়রা দারুচিনির ব্যবহার করত মৃতদেহ মমি করার কাজে। তাছাড়া সুগন্ধি হিসেবেও এর ব্যাপক প্রচলন ছিল। দারুচিনি থেকে তৈরি সুগন্ধি দ্রব্য প্রাচীন গ্রিক ও রোমানরা তাদের পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করত। কিন্তু মজার বিষয় হলো, এই দারুচিনির মূল্য এতই বেশি ছিল যে, সাধারণ জনগণ এটি ব্যবহার করা তো দূরে থাক; ব্যবহারের কল্পনাও করতে পারত না।

ইতিহাসবিদরা বলে থাকেন, তিনশো পঞ্চাশ গ্রাম দারুচিনির মূল্য সে সময়ে পাঁচ কেজি রূপার দামের সমান ছিল। অবাক হচ্ছেন? দারুচিনির বহুমূল্য অবস্থান থেকে আজকের আটপৌরে জীবনযাত্রা অবাক করার মতোই। 

আরও পড়তে পারেন-

দারুচিনির এই আকাশছোঁয়া দামের জন্য অবশ্য ঐতিহাসিকেরা মূলত দায়ী করেন এর দুর্লভতাকে। মনস্তাত্ত্বিক কারণও কিছুটা আছে। দারুচিনির খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহার থাকলেও সবকিছুকে ছাপিয়ে যে বিষয়টি লক্ষণীয় হয়ে ওঠে, সেটি হলো সেসময়ে দারুচিনির সামাজিক অবস্থান ও গ্রহণযোগ্যতা।

একটা সময় এমন ছিল, যখন দারুচিনির জন্য মানুষ মানুষকে খুনও করতো। দারুচিনির জন্য নানারকম ঝামেলা এবং দলাদলি লেগেই থাকত। এমনকি যার কাছে যত বেশি দারুচিনির মজুদ থাকত, তার সামাজিক গুরুত্ব তত বেশি ধরা হতো। আভিজাত্যের প্রতীক হওয়ায় উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তরাও দারুচিনি ব্যবহারের ইচ্ছা পোষণ করত।

Tree
-দারুচিনির চাষ।

দারুচিনির মূল্য নিয়ে রোমান সম্রাট নিরোর একটি গল্প প্রচলিত আছে। নিরো যখন তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী সাবিনার পেটে আকস্মিকভাবে লাথি দেন, তিনি তখন মারা যান। একসময় সম্রাট তার ভুল বুঝতে পারেন এবং অনুশোচনায় তিনি তার এক বছরের সকল দারুচিনির মজুদ পুড়িয়ে ফেলেন। তার এ ‘অভূতপূর্ব ত্যাগ’ থেকে আমরা দারুচিনির তৎকালীন গুরুত্ব ও এর দুর্লভতা অনুধাবন করতে পারি।

ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসারের ফলে উচ্চবিত্তদের পাশাপাশি মধ্যবিত্তদের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাওয়ায় দারুচিনির চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দিনে দিনে এর পর্যাপ্ত যোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে উঠছিল। তবে তৎকালীন বাজারে দারুচিনির অল্প যোগানের জন্য দায়ী ছিল আরবরা, কেননা আরব ব্যবসায়ীরা দীর্ঘ সময় ধরে দারুচিনির বাজারে একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছিল এর উৎস গোপন রাখার মাধ্যমে। 

 Route
-দারুচিনি ব্যবসার পথ।

উৎস বা উৎপাদনস্থল গোপন রাখার জন্য তারা বিভিন্ন রকমের গল্পের অবতারণা করত। সবচেয়ে প্রচলিত গল্পটি বেশ মুখরোচক। সেই গল্পটি আজকের সচেতন পাঠকের কাছে উদ্ভট ও হাস্যকর মনে হতে পারে, কিন্তু আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে এই গল্পগুলো বুনেই আরবরা ইউরোপীয়দেরকে দীর্ঘদিন ধরে দারুচিনির উৎস থেকে বিরত রাখতে সফল হয়েছিল।

আরবরা বলত, দূর পাহাড়ের উঁচু শৃঙ্গে বিশাল ডানাওয়ালা পাখি বাস করত। আর সেই পাখি দারুচিনি সংগ্রহ করে সেগুলো দিয়ে তার বাসা তৈরি করত। কিন্তু সাধারণ মানুষের পক্ষে এত উঁচুতে চড়ে সে পাখির অলক্ষ্যে দারুচিনি নিয়ে আসা সম্ভব হতো না। এজন্য দারুচিনির সংগ্রহকারীরা ষাঁড়ের মাংসকে টোপ হিসেবে ব্যবহার করত। তারা ষাঁড়ের মাংসের টুকরো সেই পাহাড়ের উপর রেখে গোপনে অপেক্ষা করত।

আর যখনই পাখিটি মাংসের টুকরো তার বাসায় নিয়ে রাখত, ঠিক তখনই কিছু পরিমাণ দারুচিনি পাখির বাসা থেকে নিচে পড়ে যেত। কারণ মাংসের টুকরোগুলো ইচ্ছাকৃতভাবেই বড় করে কাটা হতো, যাতে পাখি তার বাসায় মাংস রাখবে, তখন মাংসের ভারে বাসাটির কিছু অংশ খুলে নিচে পড়ে যাবে।

আরও একটি গল্প লোকের মুখে মুখে ফিরত- দূরের কোনো অজানা গহীন জঙ্গলে দারুচিনির বাগান আছে, কিন্তু বিশাল দৈত্যাকার কিছু সাপ সর্বক্ষণ সে বাগান পাহারা দিচ্ছে। তাই তাদের চোখ ফাঁকি দিয়ে দারুচিনি সংগ্রহ করা ছিল এককথায় অসম্ভব ব্যাপার। ইতিহাস ঘাঁটলে এরকম অনেক গল্প পাওয়া যাবে, যার প্রায় সবই অবাস্তব এবং বিভ্রান্তিকর হলেও সবগুলোই ছিল উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।

উৎস গোপন রাখার ক্ষেত্রে আরবরা বরাবরই সফল ছিল। তারা বাণিজ্যের জন্য বিভিন্ন জটিল পথ ব্যবহার করত, যাতে কেউ তাদের ভ্রমণ পরিকল্পনা দেখে উৎস অনুমান করতে না পারে। শ্রীলংকা আগে ‘সিলন’ বা ‘সিংহলি’ নামে পরিচিত ছিল। আরব বণিকরা সেখান থেকে দারুচিনি সংগ্রহ করত এবং মধ্যপ্রাচ্য হয়ে সংগৃহীত দারুচিনি মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া শহরে নিয়ে যেত। আলেকজান্দ্রিয়া থেকে ভেনিসীয়রা এ দারুচিনি সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে দিত। দারুচিনির বিভিন্ন ব্যবহার যেমন, শীতকালে মাংস সংরক্ষণ, সুগন্ধি হিসেবে এর ব্যবহার এবং নানা রকম ঔষধি গুণাবলির কারণে এটি খুব দ্রুতই ইউরোপীয়দের মাঝে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।

আরব ঐতিহাসিকদের থেকে জানা যায়, প্রাচীনকালে ঠাণ্ডা-কাশি সহ গলার জ্বালাপোড়া নিরাময়ের কাজে দারুচিনির ব্যবহার ছিল অত্যন্ত ফলপ্রসূ। ইউরোপীয়রা এর উৎস খুঁজে পাবার জন্য অত্যন্ত উৎসুক ছিল। তেরো-চৌদ্দ শতকে বহু ইউরোপীয় নাবিক বিভিন্ন দিকে যাত্রা শুরু করেন দারুচিনির উৎস খোঁজ করার জন্য। এদের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছিলেন কলম্বাস। একপর্যায়ে কলম্বাস দারুচিনির উৎস পাওয়ার দাবি করেন এবং বেশকিছু নমুনা ইউরোপে পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত কলম্বাসের পাঠানো বস্তুগুলো দারুচিনি ছিল না।

War
-ডাচরা পর্তুগীজদের শ্রীলঙ্কা থেকে বিতাড়িত করে।

পরে অবশ্য অন্য আরেক পর্তুগীজ নাবিক সিলন এর খোঁজ পান এবং ১৫১৭ সালে শ্রীলঙ্কায় ব্যবসা-বাণিজ্যের গোড়াপত্তন করেন। সেইসাথে তারা সেখানে একশো বছর দারুচিনি ব্যবসায় আধিপত্য বিস্তার করতে সক্ষম হন। এভাবে পর্তুগিজরাই প্রথম আরবদের দারুচিনি ব্যবসার একচ্ছত্র আধিপত্য থেকে বিতাড়িত করে।

পর্তুগিজরা প্রথমে শ্রীলংকার রাজাদের সাথে চুক্তি করে এবং তারা শ্রীলংকার উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ব্যবসা-বাণিজ্য করার অনুমতি লাভ করে। আস্তে আস্তে তারা শ্রীলংকার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে থাকে। সেইসাথে তারা শ্রীলঙ্কায় দুর্গ তৈরি করার মাধ্যমে তাদের সংখ্যা ও শক্তি বাড়াতে থাকে। এর ফলে তারা স্থানীয় ব্যবসায়ী ও শ্রীলংকার রাজাদের উপর প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়, এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে তারা তাদের উপর চাপও প্রয়োগ করে। শ্রীলংকার সাধারণ জনগণ, বিশেষ করে দারুচিনি চাষিরা পর্তুগীজদের দ্বারা নানাভাবে নির্যাতিত ও শোষিত হতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের নির্যাতনের সীমা চরম আকারে পৌঁছায়।

প্রচলিত আছে যে, শ্রীলংকা ছাড়া দারুচিনি যেন অন্য কোথাও চাষ না করা যায়, সেজন্য পর্তুগিজরা সর্বদা সতর্ক থাকত। জাহাজে দারুচিনি তোলার সময় কেউ যেন চুরি করে কোনো দারুচিনি গাছের চারা বা বীজ নিতে না পারে, সেজন্য তারা জাহাজের সর্বত্র লবণ ছিটিয়ে দিত। কারণ কেউ যদি চুরি করতে সমর্থ হয়ও, তবে তারা দারুচিনি গাছের চারা বা বীজ ঠিক অবস্থায় নিতে পারবে না। শ্রীলংকার জনগণ শত বছরের নিপীড়ন থেকে অবশেষে মুক্তি লাভ করে ওলন্দাজদের হাত ধরে। তারা ছিল পর্তুগীজদের প্রতিদ্বন্দ্বী, আর এ কারণেই তারা শ্রীলংকার রাজাদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়।

শ্রীলংকার রাজারা ডাচদের সহায়তায় পর্তুগীজদের শ্রীলঙ্কা থেকে বিতাড়িত করে, কিন্তু এরূপ অভূতপূর্ব সামরিক সাফল্য লাভের ফলে ডাচরা শ্রীলঙ্কায় থেকে যায় এবং শ্রীলংকা ব্যবসার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ডাচ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি শ্রীলংকায় ব্যবসা-বাণিজ্যে দায়িত্ব গ্রহণ করে এবং রাজাদের সাথে চুক্তি করে দারুচিনি রপ্তানি করতে থাকে। ওদিকে ইউরোপীয়দের কাছে দারুচিনির চাহিদা প্রতিদিন ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকায় ডাচরা পর্যাপ্ত পরিমাণ দারুচিনি সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে থাকে। তাই তারা সাধারণ দারুচিনি চাষিদের উপর নানারকম চাপ দিতে থাকে উৎপাদন বৃদ্ধি করার উদ্দেশ্যে। ফলস্বরূপ শ্রীলংকার সাধারণ মানুষের ভোগান্তি আরো বাড়তে থাকে।

অবশেষে ব্রিটিশরা দারুচিনি ব্যবসার প্রতি মনোনিবেশ করলে ডাচদের একচ্ছত্র আধিপত্য বাধাপ্রাপ্ত হয়। দারুচিনির বিস্তার ঠেকানোর শত চেষ্টার সত্ত্বেও শেষপর্যন্ত ইংরেজরা ভারতের দক্ষিণের রাজ্য কেরালাতে দারুচিনি চাষ করতে সমর্থ হয়। অন্যান্য জায়গায়ও দারুচিনির চাষ চলতে থাকে, এবং এর সরবরাহ উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পায়। দারুচিনির আকাশচুম্বী দামও অবশেষে কমতে থাকে এবং বাজারে দারুচিনির আরো নানারকম প্রতিদ্বন্দ্বী আবির্ভূত হয়। আর এভাবেই দারুচিনি তার আভিজাত্য হারাতে থাকলে ইউরোপীয় ব্যবসায়ীরা ক্রমশ দারুচিনি থেকে তাদের মনোযোগ অন্যান্য পণ্যের উপর স্থানান্তর করে।

ইউরোপীয় ব্যবসায়ী ও শাসকদের নির্যাতনের ফলে শ্রীলংকার সাধারণ মানুষ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, আবার তেমনি শ্রীলংকার সামগ্রিক অর্থনৈতিক উন্নতি সাধিত হয়েছিল এবং এর ফলে বিশ্ব দরবারে শ্রীলংকা সম্ভাবনাময় বাণিজ্যিক কেন্দ্র হিসেবে উপস্থাপিত হয়। তাছাড়া, ইউরোপীয় শাসক ও ব্যবসায়ীরা তাদের ব্যবসার স্বার্থে শ্রীলংকার বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়ন সাধন করে, এতে শ্রীলংকার অর্থনীতি ক্রমশ উন্নতি লাভ করতে থাকে।

বর্তমানে আমরা যে দারুচিনি ব্যবহার করি, সেটি শ্রীলংকায় উৎপাদিত দারুচিনি নয়, কারণ শ্রীলংকার উৎপাদিত দারুচিনি তুলনামূলকভাবে বেশি মিষ্টি এবং সুগন্ধিযুক্ত। আমাদের নিত্য ব্যবহার্য দারুচিনি মসলা তুলনামূলক সহজলভ্য ও সস্তা; কেননা কালের বিবর্তনে একসময় আভিজাত্যের প্রতীক দারুচিনি তার পুরনো জৌলুস হারিয়ে গ্রিক-রোমানদের পূজার ঘর থেকে আমাদের রান্নাঘরে স্থান করে নিয়েছে। সূত্র: রোআর মিডিয়া।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।