Home লাইফ স্টাইল ইসলাম ও নিউট্রিশনাল কিটো ডায়েট: সম্পর্ক কোথায়?

ইসলাম ও নিউট্রিশনাল কিটো ডায়েট: সম্পর্ক কোথায়?

বর্তমানে মানুষের স্বাস্থসচেতনাতার সঙ্গে বেড়েছে নানারকম ডায়েটের হিড়িক! এই খাবারে প্রোটিন আছে, ওই খাবারে ভিটামিন। আয়রন কম শরীরের? অবশ্যই অ্যাভোক্যাডো ও খেজুর খেতে হবে! খাবারের পুষ্টিমূল্য নিয়েই মাতামাতিও যে বেড়েছে তার প্রমাণ উপরোক্ত মন্তব্যগুলো। সোশ্যাল মিডিয়া ও ইন্টারনেটের সাইটগুলোতেও পাল্লা দিয়ে প্রচার বেড়েছে নানারকম ডায়েট ও খাদ্যতালিকার।

এই ডায়েট নিয়ে মাতামাতির তালিকার মধ্যে সবার উপরে যেটা রয়েছে সেটা হল কিটো ডায়েটের মাধ্যমে শরীরকে নীরোগ রাখা ও ওজন কমানো। মজার ব্যাপার হল, সৃষ্টির শুরু থেকেই ইসলাম ধর্মে নানা ধরনের খাদ্যাভ্যাসের কথা বলা হয়েছে। এর সঙ্গে নিয়মিত উপবাসের উপকারিতা সম্পর্কেও আমাদের প্রিয় নবী শিক্ষা দিয়েছেন। এই খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে অনেকগুলোই কিটো ডায়েটের সঙ্গে মেলে।

আরও পড়তে পারেন-

পশ্চিমা সমাজে কিটো ডায়েট

কিন্তু পশ্চিমা সমাজের কাছে কয়েকদিন আগে পর্যন্তও সেগুলো গ্রাহ্য হত না। আজ, হঠাৎ করে সকলের কাছে উপবাস ও কিটো ডায়েটের গুরুত্ব এমন বেড়ে গিয়েছে যে সেগুলো যেন সদ্য আবিষ্কৃত হয়েছে!

আসলে ব্যাপারটা অন্য। যত দিন যাচ্ছে, স্ট্যান্ডার্ড আমেরিকান ডায়েট-এর অপরকারিতা আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কিন্তু আমাদের লাইফস্টাইলের সঙ্গে এই ডায়েট এমনভাবে জড়িত যে চট করে বাতিল করে দেওয়া বেশ কঠিন। সেইজন্যই বিকল্প ডায়েটের প্রতি মানুষের ঝোঁক বাড়ছে।

সেইজন্যই, এই নতুন বছরের রমজানে আমার একটি লক্ষ্য রয়েছে। এই একটি মাস আমি একটি বিশেষ খাদ্যতালিকা মেনে চলব। এর ফলে আমার শরীরে কিটোসিসের মাধ্যমে বাড়তি কার্বোহাইড্রেট কম হবে, শরীর শক্তি উৎপন্ন করবে বাড়তি ফ্যাটের দহন করে। এর ফলে আমি আরও সুস্থ সবল হয়ে উঠব।

এটা শুনেও অনেকের মনে হতে পারে যে আমিও হয়ত চটজলদি রোগা হওয়ার ফাঁদে পা দিলাম। কিন্তু আসলে এই ধরনের খাদ্যের অভ্যাস বহু আগে থেকেই আমাদের ধর্মে হালাল। আমাদের প্রিয় নবী এটিকে সুন্নাহ বলে মনে করতেন। এই ধরনের খ্যাদ্যাভ্যাসের মাধ্যমে নিজেকে মানুষ হিসাবেও উন্নত করে তোলা যায়।

অহেতুক অবৈজ্ঞানিক উপায়ে উপবাস না করে যদি এই অভ্যাস মেনে সঠিক উপবাস করি তাহলে আল্লাহর উপাসনাতেও ক্লান্তি আসবে না।

রমজানের মুসলমানদের উপবাস সংক্রান্ত নানাপ্রকার ভুল তথ্য

রমজানের উপবাসের সময় কখনও না কখনও আমাদের সকলকেই এতক্ষণ উপবাস করে থাকার অপকারীতা সম্পর্কে নানা মতামত শুনতে হয়।

এমনকি অনেক বিজ্ঞ মানুষকেও আমি বলতে শুনেছি যে রমজানের এই নিরম্বু উপবাসের কারণে মুসলমানদের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ওজন বেড়ে যায় বেশ অনেকখানি।

কিন্তু সম্প্রতি প্রায় ৭০-এর বেশি রিসার্চে দেখা গিয়েছে রমজানের সময় সঠিক উপবাসের ফলে মুসলমানদের ওজন ও শরীরের ফ্যাটের পরিমাণ বেশ অনেকটাই কমে গিয়েছে। এই উপবাসের মাধ্যমে আমাদের শরীর কিন্তু কিটো ডায়েটের মূল ধর্ম অনুসারে কাজ করে।

সুতরাং বলা যায়, আমাদের বর্তমান জীবনের ওজন সংক্রান্ত সমস্যার সহজ সমাধান আমাদের ধর্মবিশ্বাসের মধ্যেই রয়েছে।

রমজানের মাস আসলে নিজের শরীরকে নীরোগ ও সুস্থ করে তোলার মাস। কিন্তু যেহেতু এতে শান্ত হয়ে আল্লাহকে উপাসনার উপর জোর দেওয়া হয় তাই বাকি বিশ্বের কাছে এটি এখনও সেভাবে গ্রাহ্য হয় না।

আমাদের শরীরের কার্যকলাপ সম্পর্কে ধারণা

আমাদের দেহ মূলত কার্বোহাইড্রেট থেকে শক্তি সঞ্চয় করে। রোজকারের খাদ্যের মধ্যে বেশিরভাগ কার্বোহাইড্রেট সমন্বিত খাদ্য আমরা গ্রহণ করি।

যেহেতু আমাদের খাবারগুলির বেশিরভাগই শর্করাজাতীয় তাই দিনের মধ্যে যাই খাই না কেন, সেটা সেই কার্বোহাইড্রেট ইনটেকের মধ্যে পড়ে। এর মধ্যে সবটা ব্রেন ও মাংসপেশি ব্যবহার করতে পারে না। বাড়তি শর্করা তাই লিভারে বা এমনি শরীরে ফ্যাট হিসাবে জমা হয়।

সুতরাং, আমরা যদি শর্করা জাতীয় খাদ্যাভ্যাস ত্যাগ না করতে পারি তাহলে আমাদের শরীরে সঞ্চিত কার্বোহাইড্রেটের পরিমাণ বাড়বে।

অর্থাৎ আমরা আস্তে আস্তে ডায়াবেটিস ও ওবেসিটির দিকে এগবো।

অপরদিকে , যদি কার্বোহাইড্রেট গ্রহণ আস্তে আস্তে কমিয়ে দিই। তাহলে শরীর প্রথমে শক্তির জন্য জমে থাকা কার্বোহাইড্রেট ব্যবহার করবে। তারপর ধীরে ধীরে যে শর্করা ফ্যাটে পরিণত হয়েছে সেগুলোকে ভেঙ্গে শক্তি উৎপন্ন করবে। শারীরবৃত্তিয় প্রক্রিয়া ফ্যাটকে ভেঙে কিটোন নামক একটি পদার্থ তৈরি করে। এই কিটোনের মাধ্যমে শক্তি উৎপন্ন হয়। রক্তে এই কিটোনের সঠিক উপস্থিতিকেই ‘নিউট্রিশনাল কিটোসিস’ বলা হয়।

এই কিটোসিসের ফলে শরীর আস্তে আস্তে সাম্যাবস্থায় আসে। ওজন কমতে থাকে। এনার্জির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়, মানুষের মগজ আরও ক্ষমতাশীল হয়ে ওঠে।

উপবাসের মাধ্যমে আমরা একটি নির্দিষ্ট সময়ে ও নির্দিষ্ট পরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করি, এর ফলে এই কিটোসিস পদ্ধতি তরান্বিত হয়। এটাই কিন্তু কিটো ডায়েটর মূল কথা।

মহান নবী রাসুল(সাঃ) খাদ্যগ্রহণ ও খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যা বলেছেন

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাশাআল্লাহ বেশি খাওয়া ও খাবারের অপচয়ের বিরোধী ছিলেন।

আনাস ইবনু মালিক (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, আবূ ত্বলহা (রাঃ) উম্মু সুলাইমকে বললেনঃ আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর দুর্বল কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলাম তিনি ক্ষুধার্ত। তোমার নিকট (খাবার) কিছু আছে কি? তখন উম্মু সুলাইম কয়েকটি যবের রুটি বের করলেন। তারপর তাঁর ওড়না বের করে এর একাংশ দ্বারা রুটিগুলো পেঁচিয়ে আমার কাপড়ের মধ্যে গুঁজে দিলেন এবং অন্য অংশ আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে আমাকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট পাঠালেন।

তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মু সুলাইমকে ডেকে বললেনঃ তোমার কাছে যা আছে তা নিয়ে আস। উম্মু সুলাইম ঐ রুটি নিয়ে আসলেন। তিনি আদেশ করলে তা টুকরা করা হলো। উম্মু সুলাইম ঘি (বা মধুর) পাত্র নিংড়িয়ে তাকেই ব্যঞ্জন বানালেন। তারপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাশাআল্লাহ, এতে যা পড়ার পড়লেন। এরপর বললেনঃ দশজনকে আসতে অনুমতি দাও।

তাদের আসতে বলা হলে তারা তৃপ্ত হয়ে আহার করল এবং তারা বেরিয়ে গেল। আবার বললেনঃ দশজনকে অনুমতি দাও। তাদের অনুমতি দেয়া হলো। তারা আহার করে তৃপ্ত হলো এবং চলে গেল। এরপর আরো দশজনকে অনুমতি দেয়া হলো। এভাবে দলের সকলেই আহার করল এবং তৃপ্ত হল। তারা মোট আশি জন লোক ছিল।

অর্থাৎ এই হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি যে প্রিয় নবী সবসময় অল্প পরিমাণ খাদ্যগ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন।

অন্য হাদিস

আরেকটি হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি, ক্বাতাদাহ (রহঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ আমরা আনাস (রাঃ)-এর কাছে ছিলাম। তাঁর সঙ্গে তাঁর বাবুর্চিও ছিল। তিনি বললেনঃ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর সঙ্গে মিলিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত পাতলা নরম রুটি এবং ভুনা বকরীর গোশত খাননি। [৫৪২১, ৬৪৫৭]

প্রিয় নবী আরও বলেছেন যে একজন মানুষের শরীরের একের তিন অংশ খাদ্য, একের তিন অংশ পানি ও একের তিন অংশ বাতাস দিয়ে পূর্ণ থাকা উচিত। নয়তো সেই মানুষ দাম্ভিক হয়ে যায়। তিনি শিরদাঁড়া সোজা রেখেও খাদ্য গ্রহণ করতে বলেছেন।

এই হাদিস থেকে আমরা জানতে পারি,

কোনো কিছুর ওপর হেলান দিয়ে খাওয়া নিষিদ্ধ। হেলান দিয়ে খাওয়ার ফলে পেট বড় হয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, এটি দাম্ভিকতার আলামত। আবু হুজাইফা (রা.) থেকে বর্ণিত, আমি রাসুল (সা.)-এর দরবারে ছিলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে বলেন, আমি হেলান দেওয়া অবস্থায় কোনো কিছু ভক্ষণ করি না।’ [বুখারি, হাদিস : ৫১৯০; তিরমিজি, হাদিস : ১৯৮৬]

সুতরাং

আমাদের ধর্মের ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন হয়তো আমেরিকান স্ট্যান্ডার্ড ডায়েটের থেকে অনেকটা আলাদা হবে। আমাদের আধুনিক জীবনযাত্রার সঙ্গে হয়তো চট করে মিলবে না সেই অভ্যাস। কিন্তু যদি আল্লাহর প্রতি আমাদের বিশ্বাস থাকে। এছাড়া যদি নিজেদের ইমানের সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জীবনযাপনের জিম্মাও আমরা নিতে চাই। তাহলে অবশ্যই প্রিয় নবীর দেখানো পথে আমাদের খাওয়ার অভ্যাস নিয়ে যাওয়া উচিত।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।