Home ওপিনিয়ন বাবরি মসজিদ: ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কাহিনী

বাবরি মসজিদ: ধর্মনিরপেক্ষ থেকে ভারতের হিন্দু রাষ্ট্র হয়ে ওঠার কাহিনী

বুধবার, ৫ ই আগস্ট, ২০২০ সাল। তিনটি দশক আগেও মাথা তুলে দাঁড়িয়ে থাকা শতাব্দী প্রাচীন একটি মসজিদের জমিতে এই দিনই একটি হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। না, আপনি এই খবর মিস করেননি: কারণ এই ঘটনার প্রতিবাদে সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনও ঝড় ওঠেনি, প্রথম সারির কোনও মিডিয়া, আন্তর্জাতিক রাজনীতিবিদ এমনকী কোনও মুসলিম নেতাও এই ঘটনার সামান্যতম নিন্দা করেননি।

বাবরি মসজিদ ও অযোধ্যার বিতর্ক

ষোড়শ শতকে মুঘল সম্রাট বাবরের নির্দেশে জেনারেল মীর বাকী দ্বারা বাবরি মসজিদটি নির্মীত হয়েছিল। মসজিদের শিলালিপি অনুসারে মদিনাতে ইসলামী প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ৯৩৫ বছর পরে এটি নির্মাণ করা হয়েছিল।

কেউ কেউ যুক্তি দেখান যে, একদা বাবরি মসজিদ যে জমিতে দাঁড়িয়েছিল তা ছিল অযোধ্যা (বা অযোধা) নামক রাজ্যের অন্তর্গত, এবং এই কারণে হিন্দুরা এই জমির মালিকানা দাবি করতে পারেন। তবে, ভারতীয় ঐতিহাসিক কে এম পান্নিক্কর তাঁর এই পৌরাণিক কাহিনীর উৎস সম্পর্কে বিশদ ব্যাখ্যা দিয়েছেন তাঁর “অ্যানাটমি অফ এ কনফ্রন্টেশন: অযোধ্যা অ্যান্ড রাইজ অফ কমিউনাল পলিটিক্স ইন ইন্ডিয়া” বইয়ে।

আরও পড়তে পারেন-

পান্নিক্কর লিখেছেন যে, ১৮৫৫ সালে মূল সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু ছিল হনুমানগড়ির মন্দির, কারণ সেই সময় একটি মুসলিম গোষ্ঠী দাবি করেছিল যে একটি মসজিদ ভেঙে এই হিন্দু মন্দির নির্মাণ করা হয়েছিল। এই মুসলিম দলটি সেই মন্দির দখলের চেষ্টা করলে তাঁদের এমন মারধর করা হয় যে, তাঁরা শেষ পর্যন্ত বাবরি মসজিদে আশ্রয় গ্রহণ করে প্রাণরক্ষা করতে বাধ্য হন। তবে সেই সময় বিজয়ী হিন্দুরা বাবরি মসজিদ নিয়ে কোনও দাবি জানাননি, যার অর্থ হল, তখনও অযোধ্যার পবিত্রভূমিতে মসজিদ নির্মাণের কিংবদন্তী তখনও তাঁরা সত্য হিসেবে মানতে শুরু করেননি। পান্নিক্করের ব্যাখ্যা, “সম্ভবত হনুমানগড়ির মন্দির সম্পর্কে মুসলমানদের দাবির পাল্টা হিসেবে এই পৌরাণিক কাহিনীটি তৈরি করা হয়।”

১৮৫৫ সালে এই মতবিরোধের সত্যাসত্য বিচারের জন্য অযোধ্যার নবাব তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন এবং সেই তদন্তে দেখা গিয়েছিল যে, কোনও প্রাচীন মসজিদের জমিতে হনুমানগড়ি মন্দির নির্মীত হয়নি। এই কারণে, সেই মন্দিরে সংখ্যালঘু হিন্দুদের অবাধে উপাসনা করার অধিকার বহাল ছিল।

অযোধ্যা নিয়ে হিন্দুদের দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত?

মুঘল সম্রাট আকবরের শাসনকালে রচিত আইন-ই-আকবরীতে আবুল ফৈজি লিখেছেন যে, অযোধ্যার প্রতি মুসলমানদের অনুরাগের কারণ হল এর ধর্মীয় তাৎপর্য। মুসলমানরা বিশ্বাস করেন যে, এখানে নবী শিশ (Shīsh) ও আইয়ুবদের (Ayyūb) সমাধিসৌধ রয়েছে, এবং বলা হয় যে নুহ (Nūh) এখানেই বাস করতেন। বাস্তবেও এখানে, “নবী নুহ কা মহল্লা” নামে একটি লোকালয়ের অস্তিত্ব রয়েছে।

“বাবরি মসজিদ: আ হিস্টোরিক বোন অফ কনফ্রন্টেশন” বইয়ে আরশাদ ইসলাম যুক্তি দিয়েছিলেন যে, অযোধ্যার কথা প্রথম তিনটি বেদে লিপিবদ্ধ নেই, এবং “বর্তমান অযোধ্যা রামের জন্মস্থান বলে রামায়ণে যে দাবি বাল্মিকী করেছেন তা অত্যন্ত দুর্বল” এবং “রাম সম্পর্কে এই জনপ্রিয় গল্পগুলির কোনও ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই এবং বিভিন্ন ঐতিহাসিক প্রমাণের সাথে এই দাবির বিরোধ রয়েছে।”

এই মতকে সমর্থন করেছেন রোমিলা থাপার, যিনি লিখেছেন, “আমরা বর্তমানে পবিত্র গ্রন্থ বলতে যা বুঝি, বাল্মীকির রামায়ণ প্রকৃতপক্ষে তা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি উপাখ্যান, একটি গল্প, যা মহাকাব্যের ছাঁচে লেখা হয়েছিল। ”

তাছাড়াও, প্রত্নতাত্ত্বিক সমীক্ষক আলেকজান্ডার কানিংহাম ১৮৬৩ সালে সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলেন যে তিনি, অযোধ্যার ঢিবিগুলিতে বৌদ্ধদের চিহ্ন খুঁজে পেয়েছেন। ইসলামের এই মতের সত্যতা প্রমাণ করেছিল এ.কে. নারিনের খনন কার্য। এর ফলে এমন কিছু নিদর্শন উদ্ধার হয়েছিল যার দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, অযোধ্যার বাসিন্দারা খুব সাধারণ জীবনযাপন করতেন, যা বাল্মিকীর রামায়ণের বর্ণনার সম্পূর্ণ বিপরীত।

আধুনিক ভারত ও বিজেপি-র উত্থান

১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের পরে, প্রাণভয়ে কয়েক লক্ষ মুসলমান ভারত থেকে পাকিস্তানে পালিয়ে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে এক হিন্দু গোষ্ঠী দেশভাগের দু’বছর পরে বাবরি মসজিদের মিম্বারে রাম, সীতা এবং লক্ষ্মণের প্রতিমা স্থাপন করে। এই মসজিদের ৪২১ বছরের ইতিহাস এই দলের কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল না, এবং ১৯৯২ সালে মসজিদটি ভাঙার সময় উন্মত্ত জনতাও সেই কথা মাথায় রাখেনি। মসজিদ ভাঙার পরে গোটা ভারতজুড়ে যে সহিংস বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল তাতে আরও অন্তত ২ হাজার মানুষ মারা গিয়েছিলেন, যাঁদের বেশির ভাগই ছিলেন মুসলিম। এরপরে বিষয়টি নিয়ে দীর্ঘ আইনি লড়াই শুরু হয়।

কয়েক দশক ধরে মামলা চলার পরে অবশেষে ২০১৯ সালের নভেম্বরে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট মসজিদের জমিতে মন্দির নির্মাণের স্বীকৃতি দেয়। ২০২০ সালে আগস্ট মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন সেই নতুন হিন্দু মন্দিরের ভিত্তি স্থাপনের অনুষ্ঠানে যোগদান করার পাশাপাশি সেই পূজোতে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করেন, তখন এই বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, নেহরুর রাজনৈতিক আদর্শ মেনে ভারতীয় সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা লেখা হয়েছিল, তার থেকে সরে এসে হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার কথাই মোদী ঘোষণা করলেন, কোনও শব্দ খরচ না করেই।