Home ইতিহাস ও জীবনী ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুসলিম: পায়ে ক্রীতদাসের শিকল পরালেও ইসলাম থেকে সরাতে পারেনি খ্রিস্টানরা

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুসলিম: পায়ে ক্রীতদাসের শিকল পরালেও ইসলাম থেকে সরাতে পারেনি খ্রিস্টানরা

‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ’ নামটি আমাদের ১৪৯২ সালে আন্দালুসিয়ার পতনের কথা মনে করিয়ে দেয়, মূলত এই ঘটনার পরেই স্পেনের নেতৃত্বে ইউরোপীয় শক্তিগুলি নতুন ভূখণ্ড আবিষ্কার-এর অভিযান পর্বের সূচনা করেছিল। ক্রিস্টোফার কলম্বাসের তথাকথিত ‘আমেরিকা আবিষ্কারের’ ফলস্বরূপ এই ইউরোপীয় উপনিবেশের পরবর্তী চার শতাব্দী ধরে দাসপ্রথা চলেছিল।

ভারতে যাওয়ার আরও দ্রুত পথ খুঁজেবের করার জন্যই মূলত কলম্বাসকে চাপ দিয়েছিলেন ক্যাস্তিলি ও অ্যারাগন-এর ফার্দিনান্দ এবং ইসাবেলা। ভারতে পৌঁছনোর নতুন রুটের সন্ধানের উদ্দেশ্য ছিল পূর্ব ও পশ্চিম দিক থেকে মুসলমানদের বিরুদ্ধে দ্বিপাক্ষিক আক্রমণের পথ প্রস্তুত করে তোলা।

ওয়েস্ট ইন্ডিজের মুসলিম-দের ক্রীতদাসে পরিণত করার কাহিনী

কলম্বাস ইউরোপ থেকে পশ্চিম দিকে যাত্রা করেছিলেন এই আশায় যে, তিনি পূর্ব দিকে যাত্রা না করেই ভারতকে খুঁজে পাবেন। পূর্ব দিকে এই নৌ অভিযানে অনেক বেশি সময় লেগেছিল এবং এই অভিযান ছিল বিপদে ভরা। কারণ এই রুটের বেশিরভাগই মুসলমানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হত।

আরও পড়তে পারেন-

তবে তিনি ভারত খুঁজে পাননি, পরিবর্তে তিনি ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেছিলেন। ইউরোপ থেকে পশ্চিমে যাত্রা করে ভারতে যাওয়ার পথ খুঁজতে গিয়ে তিনি ক্যারিবিয়ান আবিষ্কার করেছিলেন বলে এই দ্বীপপুঞ্জের নামকরণ করা হয়েছিল, ওয়েস্ট ইন্ডিজ।

ইসলামের ইতিহাসে অনেকগুলি উত্থানের অংশ রয়েছে, যেই সময় মুসলমানরা মহান ও বিশাল সাম্রাজ্যের রাজা বা শাসক ছিলেন। একই ভাবে, এমন কিছু পতনের সময়ও ছিল, যখন মুসলমানদের তাদের জমি-বাড়ি থেকে উৎখাত করা হয়েছিল, পরিবার থেকে দূরে, উপকূলের তাঁদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তাঁদের গায়ে ছাপ মেপে, ক্রীতদাস হিসেবে জাহাজে বোঝাই করে, মেঝেতে নগ্ন অবস্থায় শিকল বন্দি করে রেখে, মারধর ও অত্যাচার করে, তাঁদের দিয়ে পৃথিবীর যাবতীয় নিম্ন মানের কাজ করিয়ে দাসে পরিণত করা হয়েছিল।

আফ্রিকা থেকে ওয়েস্ট ইন্ডিজে আসা মুসলিম

সর্বপ্রথম ১৫১৮ সালের দিকে পর্তুগীজ এবং স্পেনীয় উপনিবেশে দাসেদের নিয়ে আসা হয়েছিল। পরে ইংরেজ, ফরাসি এবং ডাচরা এই বাণিজ্যে যোগ দেয়। আমেরিকাতে পাঠানো তিন জন দাসের মধ্যে অন্তত একজন, অর্থাৎ প্রায় ৩০ শতাংশই মুসলমান ছিলেন। এই দাসদের মধ্যে অধিকাংশই পশ্চিম আফ্রিকার মান্ডিংকা, ফুলা, সুসু, আশান্তি এবং হাউসা উপজাতি থেকে এসেছিলেন, যাদের বেশিরভাগ মুসলমান ছিলেন।

ক্রীতদাস হিসেবে জীবনযাপন করার মাঝেই অল্প কয়েক জন আফ্রিকান তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে লিখে গিয়েছেন, তাঁদের মধ্যে মুসলমানরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ। এই ক্রীতদাসরা সাধারণত আরবী জানতেন এবং তাদের অনেকেই সুন্দর এবং নির্ভুল ভাবে আরবী বর্ণমালা এবং কুরআনের বিভিন্ন অংশ লিখে গিয়েছেন।

তাদের লেখালেখির মাধ্যমে জানা গিয়েছে যে, এই মুসলমানরা কীভাবে গর্বের সাথে এবং দৃঢ় ভাবে ইসলামের প্রতি নিজেদের বিশ্বাস, পরিচয় বজায় রেখেছিলেন এবং প্রতিরোধের চেতনা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। প্রকৃতপক্ষে, আফ্রিকার মান্ডিকাবাসী এই মুসলমানদের মধ্যে অনেকেই দাসপ্রথার বিরুদ্ধে এবং দাস মালিকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে নেতৃত্ব প্রদান করেছিলেন।

জামাইকার আবু বকর

জামাইকার একজন সেটলার ম্যাজিস্ট্রেট, রবার্ট ম্যাডেনের একজন ক্রীতদাস ছিলেন, তাঁর নাম ছিল আবু বকর। টিম্বাকটু শহরের ইসলামিক আইনশাস্ত্রে বিদ্বান এক পরিবারের ছেলে ছিলেন আবু বকর, তিনি আরবীতে দুটি আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। আবু বকরের ইসলামিক শিক্ষা এতই দৃঢ় ও গভীর ছিল যে, যে জামাইকায় ত্রিশ বছরের দাসত্বের পরেও তিনি কুরআনকে আত্মস্থ করেছিলেন।

অন্যান্য হাজার হাজার আফ্রিকান মুসলিম ক্রীতদাসের মতো আবু বকরেরও একাধিক মালিক ছিলেন এবং তাঁকে জোর করে খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়েছিল।তাঁর নতুন নাম হয়েছিল এডওয়ার্ড ডোনেলান, কিন্তু তিনি সারা জীবন ইসলামের প্রতি বিশ্বস্ত ছিলেন। যে অল্প সংখ্যক ব্যক্তি ১৮৩৪ সালে আফ্রিকায় ফিরে আসতে পেরেছিলেন, আবু বকর ছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম।

তাঁর লেখাগুলি থেকে জানা যায়, সেই সময় মুসলিম ক্রীতদাসদের জোর করে খ্রিস্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করা হত। কিন্তু তাঁরা প্রকৃতপক্ষে খ্রিস্টান ধর্মের আড়ালে বরাবরই ইসলাম ধর্ম পালন করে গিয়েছেন এবং আল্লাহের প্রতি তাঁদের বিশ্বাস বজায় রেখেছিলেন।

মনে রাখার মতো কিছু কথা

উপরের বিবরণগুলি দ্বারা এ কথা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, যে হাজার হাজার আফ্রিকান ক্রীতদাসদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে আমেরিকা বা অন্যান্য ইউরোপীয় দেশে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন মুসলমান।অসাধারণ দৃঢ়তার সাথে তাঁরা নিজেদের ধর্মীয় পরিচয় বজায় রেখেছিলেন।

আমরা শিখেছি যে ক্রীতদাস হিসেবে যে মুসলমানদের অন্য দেশে পাঠানো হয়েছিল, তাঁদের অধিকাংশই কুরআনের শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন। ফলে অন্যান্য দেশ বা ধর্মের অশিক্ষিত দাসেরা তাঁদের সহজেই নেতা হিসেবে মেনে নিয়েছিল।

মুসলমানরা যখন শেকলে বন্দি হয়ে পড়েছিল এবং তাদের দাসত্ব করতে বাধ্য করা হয়েছিল, সেই সময়েও এই খ্রিস্টান মালিকরা তাঁদের মন থেকে আল্লাহকে সরাতে পারেননি। জোর করে ধর্মান্তরিত করলেও, এই মুসলমান দাসেরা সর্বদাই আল্লাহের পথে থেকেছেন এবং কখনো তাঁর উপর থেকে বিশ্বাস হারাননি।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।