Home ইতিহাস ও জীবনী অনন্তের ঠিকানায় প্রিয় আল্লামা কাসেমী: আমার বেদনাবিধুর দিনগুলো

অনন্তের ঠিকানায় প্রিয় আল্লামা কাসেমী: আমার বেদনাবিধুর দিনগুলো

।। খন্দকার মনসুর আহমদ ।।

আমার প্রাণপ্রিয় হযরত আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীর তিরোধানের পর প্রায় দুইমাস অতিবাহিত হলো। এখনও প্রতিদিন তাঁর জন্য আমার হৃদয় কাঁদে। বার বার পাঠ করি ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিঊন। ব্যথিত হৃদয়ে তাঁকে প্রতিদিন চর্চা করি। আমার মত এমন হাজার হাজার ছাত্র আছে হুজুুরের। বোধ করি তাদেরও একই হাল। তাই অতীতের দিনগুলোর দিকে একটু ফিরে যেতে চাই।

জানি, আমার এ লেখা হুজুরের ভক্তদেরকে নতুন করে কাঁদাবে। তবু আমি আমার বেদনার কিছু বৃত্তান্ত বন্ধুদের আগ্রহে নতুন করে তুলে ধরতে চাই। হুজুরের জন্য যদি অন্তরে শোক ও বেদনা জাগে তবে তাতে লাভ বৈ লোকসান নেই।

[ এক ]

১২ই ডিসেম্বর গভীর রাত। কাজ সেরে বাংলা বাজার থেকে ফিরছি। বারিধারা নতুন বাজারে এসে আমি থমকে দাঁড়াই। কারণ আমার পরমপ্রিয় ও পরম¯েœহশীল উস্তাদ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী হাসপাতালের আইসিউতে রয়েছেন। তাঁর অবস্থা খুবই আশঙ্কাজনক। জানিনা আগামী কালের প্রভাত আমাদের জন্য কী সংবাদ বয়ে আনবে। কী আছে আমাদের ভাগ্যে। আমার হৃদয়ে বঞ্চনার নানা অভিঘাত। হুজুর এ সময়ে এমন একটি পর্যায়ে পৌঁছে যাবেন তা আমার চিস্তায় স্থান পায়নি। এখন রাত যতই গভীর হোক আমাকে আল্লামা কাসেমী হযুরের কাছে যেতে হবে। আমি ইউনাইটেড হাসপাতালে যাওয়ার উপায় খুঁজতে লাগলাম।

একটি প্রাইভেট কারে টুপিওয়ালা মানুষদের দেখতে পেয়ে অনেকটা দিশেহারার মত সেদিকে ছুটে গেলাম। কাছে গিয়ে বললাম : আপনারা হয়ত ইউনাইটেড হাসপাতালে যাচ্ছেন। আমি আল্লামা কাসেমী হযুরের ছাত্র অমুক। আমাকে আপনাদের সাথে নিয়ে যান। চালক জানালেন: এই গাড়ি- তো রওনা দিয়েছে চট্টগ্রামের উদ্দেশে, ইউনাইটেড হাসপাতালের উদ্দেশে নয়। আমার নাম শুনে চিনতে পেরে গাড়ির ভেতরকার একজন শায়খতুল্য তরুণ আলিম হাত বাড়িয়ে দিয়ে বললেন: মনসুর ভাই কেমন আছেন? তারপর তিনি বললেন- আমার নাম মাহবুবুর রহমান। এখন আমাদেরকে এই গাড়ি নিয়ে জমিয়তের সভা ধরতে চট্টগ্রামে যেতে হচ্ছে। আমি ‘আচ্ছা’ বলে হতাশ হয়ে বারিধারা মাদরাসায় চলে এলাম।

কুদরতের খেলা বোঝা বড় দায়! কিছুক্ষণ পর গাড়িটি বারিধারা মাদরাসায় ফিরে এলো এবং মাহবুব ভাই এসে জানালেন, তিনি হাসপাতালে গিয়ে হুযুরের সর্বশেষ অবস্থার খবরটা জেনে যাবেন। আমাকেও তার গাড়িতে করে হাসপাতালে নিয়ে যাবেন। মহান আল্লাহ তাঁর বান্দার অন্তর্গত বেদনার প্রতি কতখানি লক্ষ রাখেন দুশ্চিন্তার এই রাতে তা নতুন করে অনুধাবন করলাম। তারপর বারিধারার তরুণ শিক্ষক মাওলানা ইয়াসিনকে- যিনি একটু আগে হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন- সঙ্গে নিয়ে আমরা রওনা দিলাম। জানি- হুজুর হাসপাতালের নিবিড় পর্যবেক্ষণ বিভাগে। তাই তাঁকে দেখা হয়ত সম্ভব হবে না। তবু আমরা যাই। কারণ তখন এটাই ছিলো আমাদের আত্ম-সান্ত্বনার একমাত্র উপায়।

হাসপাতালে পৌঁছার পর হযুরকে দেখতে না পারলেও সেই গভীর রাতে আমরা একটি ছোট্ট মজলিসে হুযুরের জন্য হৃদয় দিয়ে দোয়া করি। হযুরের সুস্থতার জন্য পাকিস্তানের বিখ্যাত আলিম ও রাজনীতিবিদ মাওলানা ফজলুর রহমানের পাঠানো একটি মূল্যবান দুয়ার কপিও পাই হুযুরের সৌভাগ্যবান খাদেমদের নিকট। সে দুয়াটিও পাঠ করার সৌভাগ্য হলো। অন্তরে কিছুটা হলেও সান্ত¡না এলো। মনে একটু আশা জাগলো। কিছুকালের জন্য হলেও হযরতকে ফিরে পাবার জন্য আমরা মহান আল্লাহর নিকট করুণ মিনতি জানাতে থাকলাম। তারপর হযুরের প্রাণের পুস্পোদ্যান জামিয়া মাদানিয়ায় ফিরে এলাম। এখানে ছাত্র-শিক্ষকগণের নিয়মিত দোয়া দুরুদের আমল চলছিল।

আজ শেষরাতে তাহাজ্জুদের পর শুরু হলো দুয়া। হযুরকে ফিরে পাওয়ার জন্য ছাত্র-শিক্ষকগণের করুণ ফরিয়াদ। দুয়া পরিচালনা করছিলেন জামিয়া মাদানিয়া বারিধারার শাইখে ছানী আল্লামা উবাইদুল্লাহ ফারুক হাফিযাহুল্লাহ। গভীর মর্মবেদনা নিয়ে কেঁদে কেঁদে বার বার তিনি উচ্চারণ করছিলেন : ইয়া আল্লাহ আমাদের হুজুরকে আমাদের মাঝে ফিরিয়ে দিন! মসজিদ ও মসজিদ-চত্বরে কান্নার রোল পড়ে যায়। এভাবে দোয়া দুরুদসহ সম্ভাব্য সব ধরনের চেষ্টা-তদবীর চলছিলো।

কিন্তু আহকামুল হাকিমীনের ফায়সালা ছিলো- তিনি তাঁর প্রিয় বান্দাকে এই ক্লেদাক্ত ভূখণ্ডে আর রাখবেন না। আমাদের মত স্বার্থপর মানুষদের কাছে রেখে তাঁর মহান মর্যাদার হানি হতে দেবেন না। অবশেষে মহামহীমের সে কঠিন ফায়সালার বাস্তবায়ন ঘটে গেলো। ১৩ই ডিসেম্বর দুপুরবেলা সেই সংবাদ শুনতে হলো- আমাদের প্রিয় রাহবর জাতির পরম মমতাতাবান অভিভাবক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী মহান বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না লিল্লাহি রাজিঊন।

[ দুই ]

জামিয়া মাদানিয়ায় শোকাহত মানুষের বিপুল ভিড়। আমিও বুকভরা বেদনা নিয়ে হযরতের শবদেহের কাছে যাই। তাকে সালাম জানাই। জীবদ্দশায় যেমন হুযুরের উজ্জ্বল চেহারায় নূর খেলা করতো, ইন্তেকালের পরও তেমন তাঁর চেহারা ছিলো নুরানি। দীপ্তিমান চেহারায় তাঁকে দেখে মনে হচ্ছিলো যেন কোন রাজপুত্র ঘুমিয়ে আছেন। এতো লাশ নয়, এতো এক তরতাজা শ্বেত পদ্ম। এতো এক শুভ্র আলোর মিনার। রাত তিনটায় যখন ভিড়টা কমে এসেছে তখন আরেকবার আমার প্রিয় হযরতের কাছে যাই। ‘বাজি কেমন আছো’র? সেই সুমধুর সুর আজ আর নেই।

[ তিন ]

১৪ই ডিসেম্বর প্রভাত। আমি আবার আমার প্রাণপ্রিয় উস্তাদজির শবদেহের পাশে দাঁড়াই। জামিয়ার প্রতিটি প্রাণ আজ বিষাদগ্রস্ত। সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে হযরতের শবদেহবাহী গাড়ি বাইতুল মুকাররম অভিমুখে যাত্রা করে। মুহতারাম উস্তাদ হযরত মাওলানা মকবুল হুসাইন হাফিযাহুল্লাহ এর স্নেহানুকূল্যে লাশ অনুসারী গাড়িবহরের একটিতে তাঁর সাথে অধমের স্থান হয়। সাতটার দিকেই গাড়ি বাইতুল মোকাররমে পৌঁছে যায়।

বেশকিছুক্ষণ পর শুরু হয় দেশের শীর্ষ উলামায়ে কেরামের বেদনাভরা স্মৃতিচারণ ও শোকাহত অভিব্যক্তি। সময়ের অভাবে সেখানে বক্তব্য দিতে পারেন নি অনেক বিশিষ্ট আলেমে দীন। লক্ষ লক্ষ জনতার অংশগ্রহণে এই জানাযাসভা যেমন ছিলো তাৎপর্যপূর্ণ, ঠিক তেমনিভাবে হযরতের উত্তম আখলাক ও উদার নীতির প্রতিফলনও এই শোকসভায়ও ছিল লক্ষযোগ্য। দেশের কর্ণধারদের নানাবিধ অনাচার ও কূপমণ্ডুকতার কোন প্রতিবাদ এ সভায় হয় নি। উদার দৃষ্টিতে সবকিছু বিচার করা হয়। সর্বত্র উত্তম আখলাকের পরিচয় দেওয়া হয়। এমনকি ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ ও সরকারের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু সহযোগিতার জন্য তাদের প্রশংসা করা হয় এবং কৃতজ্ঞতা জানানো হয়। এমনই ছিলো আল্লামা কাসেমীর আদর্শ। উদার নীতি।

তিনি অপরাধীকে উদারচিত্তে ক্ষমা করে দিতেন এবং তার কল্যাণ কামনা করতেন। হযরতের অসংখ্য উত্তম গুণের মধ্যে এটি ছিলো একটি বিশেষ গুণ, যা শত্রুকেও প্রভাবিত করতো। তার জানাযা-সভায় তাঁর সে আদর্শেরই প্রতিফলন ঘটলো।

এমন একজন মহান মানুষ কোন দেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া সে দেশের জন্য কত বড় শূন্যতা এবং কত বড় বেদনাদায়ক ব্যাপার তা বোধবান ব্যক্তিমাত্রই অনুধাবন করতে পারেন। কিন্তু জাগতিক কোন মোহের কারণে যাদের বোধ-শক্তি শেষ হয়ে যায় অথবা একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে, তারা এ ধরনের বিরলপ্রজ মহা মনীষীদেরকেও অবমূল্যায়ন করতে পারে। এতে খুব বেশি হতাশ হওয়ার কিছু নেই। কারণ ইতিহাসের সত্য এটাই। ক্ষমতার অন্ধ মোহ মানুষকে যেকোন ধরনের নিকৃষ্ট কাজে প্রস্তুত করতে পারে। সে কারণে দেশের একজন মহান পুরুষকে হারিয়ে লাখো বিবেক যখন কাঁদছে তখন একশ্রেণির মানুষ চর্চা করেছে তাদের হীন রাজনৈতিক স্বার্থ। পা পাড়িয়েছে লাখো জনতার কাটা ঘায়ে নুন সিটানোর মত অমানবতার পথে। মহান আল্লাহর দরবারে এদের হেদায়াত কামনা করি।

হযরত কাসেমীর বিদেহি আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে সব যুলুমের পরও আজ এদের হেদায়েতই কামনা করছি। ওয়া ইলাল্লাহিল মুশতাকা।

[ চার ]

জানাযা শেষে হযরতের লাশ নিয়ে আমাদের গাড়িবহর ছুটলো জামিয়া সুবহানিয়ার উদ্দেশে। শবদেহের অনুসারী গাড়িবহরে ভক্তদের কেউ কেউ তখন বলছিলেন ‘আমরা তাঁর অনুসারী- তাঁর জীবনে ও মরণে। তিনি তাঁর জীবদ্দশায় যেমন আমাদের পথপ্রদর্শক ছিলেন, তেমনি তার অন্তর্ধানের পরও তার পেছনেই চলছি।’ শতাব্দীর এক বিরলপ্রজ ক্ষণজন্মা মহান পুরুষকে তাঁর শান্তির ঠিকানায় পৌঁছে দিতে শোকসন্তপ্ত হৃদয় নিয়ে আমরা এগিয়ে গেলাম। লাখো জনতার ভিড় ঠেলে আমাদের গাড়ি-বহর খুব ধীরে ধীরে এগিয়ে গেলো হযরতের শবদেহবাহী গাড়ি অনুসরণ করে। একসময় ভিড়ের সমানা পেরিয়ে গাড়িবহর গতি লাভ করে। অবশেষে পৌঁছে যায় জামিয়া সুবহানিয়ার শোকাহত প্রাঙ্গণে।

কবর খনন সম্পন্ন হয়ে আছে বেশ আগেই। সেখানে গিয়ে দেখি অসংখ্য শোকাহত মানুষ পূর্ব থেকেই অপেক্ষমাণ। বাতাসে কান্নার ধ্বনি। আমরা সন্তর্পণে নির্ধারিত গোরস্তানের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। সুহৃদ মাওলানা মামুনুল হকসহ বিশিষ্ট ও একান্ত কাছের ব্যক্তিবর্গ মরহূমের দাফন কর্মে সরাসরি অংশ গ্রহণ করেন। মামুন ভাই কবরেও অবতরণ করেন। আমরা দুর্বলরা তিন তিন মুষ্টি মাটি দিয়ে দাফন কর্মে শরীক হবার সান্ত্বনাটুকু গ্রহণ করি।

এভাবেই আমাদের বহু আশা ও আবেগের কেন্দ্র পরম আস্থা ও ভালোবাসার প্রতীক আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী তার আখেরাতের শয্যায় শায়িত হলেন। পরম প্রশান্তির নিদ্রায় নিদ্রিত হলেন আমাদের রাহবর, জাতির পরম মমতাবান অভিভাবক। বেদনা ও ভালোবাসার অশ্রুু দিয়ে আমরা পাঠ করলাম ‘বিসমিল্লাহি আলা মিল্লাতি রাসূলিল্লাহ’ ‘বিসমিল্লাহি আলা সুন্নাতি রসূলিল্লাহ’। এভাবে আমরা সুবহানিয়ার জমিনে রেখে আসি আমাদের শতাব্দীর ইতিহাসের এক গৌরবদীপ্ত অধ্যায়কে। আমাদের সকল অঙ্গনের দিকনির্দেশক মহান পুরুষকে।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লাহর হে প্রিয় বন্ধু! হে মহান অলী! দুর্গম পথের হে ক্লান্তিহীন অভিযাত্রী! এবার একটু শান্তিতে ঘুমাও! ক্লেদান্ত ও বিষাক্ত পৃথিবীর সব ক্লেদ ও বিষ-নিশ্বাস থেকে এখন তুমি মুক্ত। তোমার সমাধি হোক বেহেশতের সুরভিত উদ্যান। বুকভরা বেদনা নিয়ে আমার হৃদয় থেকে তোমার জন্য আমার প্রার্থনা হলো-

‘হে আল্লাহ তুমি তাকে ক্ষমা কর
তার প্রতি দয়া কর!
তাকে স্বস্তিতে রাখ!
তাকে মাফ কর!
তাকে স¤œানিত আতিথ্য দান করো!
তার স্থান প্রসারিত করো!
তাকে পানি বরফ ও বৃষ্টি দ্বারা ধুয়ে দাও!
তাকে গোনাহ-খাতা থেকে পরিরচ্ছন্ন করো!
যেভাবে তুমি সাদা কাপড়কে ময়লা থেকে পাক-সাফ করে থাকো!
তাকে দান করো তুমি তার ঘরের চেয়ে উত্তম ঘর
তার পরিবারের চেয়ে উত্তম পরিবার
তার সহধর্মিনীর চেয়ে উত্তম সহধর্মিনী ।
দান করো তাকে জান্নাত
নিরাপদে রাখো তাকে কবরের আযাব থেকে
আর দোযখের আযাব থেকে। [উৎস: মুসলিম, হাদীস : ৯৬৩]

[ পাঁচ ]

আমাদের সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসে। দেহগুলো অসাড় হয়ে আসে। কান্নার ধ্বনিতে তখনও বিষণ্ন চারপাশ। গাছের পাতাগুলোকে কেমন যেন বিবর্ণ দেখাচ্ছে। আকাশ আজ শোকে স্তব্ধ। বাতাস থেমে গেছে অনেক আগেই। এক বিপুল বিষণœতা চারদিকে। শূন্যতার হাহাকার প্রতিটি হৃদয়ে। ঠিক তখন সেই অন্ধকারে আল্লামা কাসেমীর উজ্জ্বল মুখ যেন মুচকি হাসি দিয়ে বলে উঠলো- ‘আপনারা অনেক কষ্ট করে এসেছেন। অনেক ক্ষুধার্ত আপনারা! মেহেরবানি করে কেউ খাবার না খেয়ে যাবেন না।

দোয়ার পর আমি একুট বেরিয়ে যেতে চাইছিলাম। মসজিদ পর্যন্ত যেতেই কানে বেজে ওঠে পরমপ্রিয় কাসেমী হজুরের ¯েœহমাখা ধমক। আমি ফিরে আসি এবং কাউকে কিছু জিজ্ঞেস না করে আমার হুজুরের মেহমান খানায় প্রবেশ করে নিজের বিষণ্ন মুখে কিছু তুলে দেই। একটু পর খাদ্যগ্রহণের জন্য যখন এগিয়ে যাই তখন সহপাঠীদের কয়েকজনকে দেখে আমি বলে উঠি ‘মেযবান নেই কিন্তু তাঁর মেহমানদারি চলছে পুরোদমে।’ হায়! প্রিয় আল্লামা কাসেমী হুজুর! পৃথিবীতে থাকতে আপনাকে চিনিনি। কদর করিনি। কদরে নিয়ামত বা‘দে যাওয়াল! এ-ইতো চিরাচরিত নিয়ম।

খাদ্যগ্রহণের পর আবার প্রিয় আল্লামা কাসেমীর সেই সনাতন প্রশ্রয়ের ধারায় বারিধারার শ্রদ্ধেয় উস্তাদগণের গাড়িতে আমার স্থান হয়। কাসেমী আখলাকের অন্যতম প্রতীক আমার পরম ¯েœহশীল উস্তাদ আল্লামা মকবুল হোসাইন দা.বা. আমাকে আমার গন্তব্যের কাছে নামিয়ে দেন। একটি বিপুল শুন্যতার হাহাকার নিয়ে আমি এক বিজন প্রান্তরে ফিরে এসে আমার শোক ও বেদনার গল্প লিখতে বসি।

সত্যিকার অর্থেই আল্লামা কাসেমীর অন্তর্ধান আমাদের জাতীয় জীবনের এক বেদনাবিধুর অধ্যায়। হযরতের জীবন বিচিত্র কর্মচাঞ্চল্য ও হৃদয়ছোঁয়া আখলাকে আলোকোজ্জ্বল হয়ে আছে। তিনি তার মহত্ত্ব ও নানাবিধ গুণের বদৌলতে লাখ লাখ মানুষের হৃদয়ের গভীরে জায়গা করে নিয়েছেন।

জানাযার বিশাল জনসমুদ্রে সর্বশেষ সে কথাই অত্যন্ত হৃদয়স্পর্শীভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বামপন্থী ইসলামবিদ্বেষী সংবাদপত্রগুলো লাখ লাখ মানুষের জানাযা আদায়ের এতবড় সংবাদটি দায়সারা ভাবে প্রকাশ করে । ইত্তেফাক ও নয়া দিগন্ত কিছুটা দায়িত্বশীলতার সাথে সংবাদটি পরিবেশন করে। সবচেয়ে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়ে বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করে দৈনিক ইনকিলাব। প্রথম পৃষ্ঠার ডান দিকে জানাযা নামাযে অংশ নেয়া মুসল্লিদের একটি বড় অংশকে ধারণ করে বেশ বড়সড় একটি ছবিসহ সুন্দর উপস্থাপনায় আল্লামা কাসেমীর জানাযার সংবাদ পরিবেশন করে।

[ ছয় ]

আজ আমাদের সান্ত্বনার বিষয় হলো আল্লামা কাসেমী রহ.মানুষের বিপুল ভালোবাসা ও আস্থা নিয়ে হকের উপর প্রতিষ্ঠিত থেকে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন। হাদীসের বর্ণনামতে এই ভালোবাসা বড় মূল্যবান। পরকালীন মকবুলিয়তেরও দলীল। হাদীসের দীপ্ত ঘোষণা- ‘তোমরা পৃথিবীতে আল্লাহর সাক্ষী।’আরও সান্ত¡নার বিষয় হলোÑ হুজুরকে আল্লাহ ফিতনামুক্ত অবস্থায় পৃথিবী থেকে তুলে নিয়েছেন।

রসূলে পাক সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার একটি দুয়ায় মহান আল্লাহর নিকট মিনতি জানিয়েছিলেন- ‘হে আল্লাহ! যখন তুমি মানুষকে ফেতনায় ফেলতে চাইবে,তখন আমাকে ফেতনামুক্ত অবস্থায় তুলে নিবে।’ রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এই দুয়া হয়ত আমাদের প্রিয় কাসেমী হুজুরও করেছিলেন। তাই ক্লেদাক্ত পৃথিবীর কোনো কাদা আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমীকে স্পর্শ করতে পারেননি। আলহামদুলিল্লাহ।

ভোগবাদী রাজনীতির নানা দুরভিসন্ধি থাবা বিস্তারের কোন সুযোগ পায়নি। একান্ত আলাপচারিতায় আমাকে হুজুর নিজেই জানিয়েছিলেন ‘আমাদেরকে [হুমকিস্বরূপ] বলা হচ্ছে: কবে মাদরাসা ছেড়ে যাচ্ছেন আপনারা।’ অক্টোপাশের উদ্ধত বাহু বার বার হুজুরের দিকে এগুতে চেয়েছে, আলহামদুলিল্লাহ পারেনি। বানরদল ভেঙচি কেটেছে কিন্তু কাছে আসতে পারেনি। মহান আল্লাহ তার নির্ধারিত সময়ে তাঁর প্রিয় বান্দাকে নিজ রহমতের কোলে তুলে নিয়েছেন।

[ সাত ]

জামিয়া মাদানিয়া বারিধারায় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. এর জীবন ও চিন্তাধারা শীর্ষক আলোচনাসভায় দেশের শীর্ষ আলিমগণ তাদের হৃদয়-নিংড়ানো যেসব অভিব্যক্তি ও বক্তব্য প্রকাশ করেন, তা থেকে এদেশের রাজনীতিবিদদের শেখার অনেক কিছু আছে। আল্লামা কাসেমীর প্রতি তাঁরা যেভাবে তাঁদের গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা নিবেদন করেন তা এককথায় নজিরবিহীন।

দেশের বরেণ্য আলেমসমাজ আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. এর জীবন ও চিন্তাধারার নানা দিকের ওপর যে আলোকপাত করেন, তা থেকে বিশেষ ভাবে ইসলামী রাজনীতিবিদগণের শিক্ষা গ্রহণ করার অনেক কিছু রয়েছে। তাঁর রাজনৈতিক আদর্শের যে দিকটি বিশেষভাবে আলোচনায় এসেছে,তাহলো তার দৃঢ়তাও আপোসহীনতা। বাতিলের কোন হুমকি-ধমকিকে তিনি পরোয়া করেন নি আলাপ ‘মাদরাসার ভূমি হাতছাড়া হয়ে যাবে’। এমন হুমকির জবাবেও হুজুর বলেছেন: মাদরাসা তো হক প্রতিষ্ঠার জন্যই, সুতরাং সেই হকের জন্য যদি মাদরাসা ছেড়ে যেতে হয় যাবো, তাতে কিছু যায় আসেনা।

এ বিষয়ে সবচেয়ে গোছালো সুন্দর ও জোরালো বক্তব্য রাখেন আমাদের প্রিয় সাথি মাওলানা মামুনুল হক হাফিযাহুল্লাহ। তিনি চমৎকারভাবে অল্প সময়ের ভেতর আল্লামা কাসেমীর রাজনৈতিকদর্শন তুলে ধরেন এবং অত্যন্ত আবেগঘন স্মৃতিচারণ করেন ।

[ আট ]

সত্যি, আল্লামা কাসেমীর তিরোধানে আমার হৃদয়টা চুরমার হয়ে গেছে। তবে আমি তা অন্যদের মত করে প্রকাশ করতে পারিনা। আমার বেদনা বেশি জাগে একাকিত্বে। হঠাৎ মনে পড়ে- একি! হুজুর সত্যিই নেই! হুজুরের এত তাড়াতাড়ি চলে যাওয়ার কী প্রয়োজন ছিলো। বলা নেই কওয়া নেই হুজুর এমন হঠাৎ করে চলে যেতে পারলেন! ইন্নালিল্লাহ…।

এ তো কঠিন অভিমান হুজুরের! হৃদয় কেঁদে ওঠে। চোখের পাতা ভিজে যায়। আমার মত এমন হাজার হাজার আছে হুজুুরের ছাত্র। তাদের মনেও একই যাতনা। একই হাহাকার। একই শুন্যতাবোধ। আমার স্বপ্নগুলো থমকে দাঁড়ায়। কানে বাজতে থাকে সর্বশেষ দীর্ঘ আলপচারিতার কথাগুলো। তিনি সেদিন সবশেষে তাঁর এক মহান উস্তাদের দুটি মূল্যবান বাণী উল্লেখ করলেন। তাহলো-‘ইস্ যামানা মে মরদম ছাযি কি ছবছে যেয়াদাহ জরুরত হ্যায়!’- এই যুগে যোগ্য ব্যক্তি গড়ার প্রয়োজনীয়তা সর্বাধিক। অপরটি হলো ‘তাকছীমে কার হোগা না কেহ তাকসীমে ফিক্র- ‘কর্মের ভাগাভাগি হবে, চিন্তার নয়।’ মানে আমাদের মাঝে দীনের কাজে পার্থক্য ও বিভিন্নতা থাবে, তবে চিন্তা থাকবে সবার এক ও অভিন্ন।’

আল্লামা কাসেমীর এক মহান উস্তাদ দারুল উলূম দেওবন্দের বিশ^বিখ্যাত আরবি আদিব আল্লামা ওয়াহিদুয্যামান কিরানভির এই জীবনদর্শন আল্লামা কাসেমী তাঁর হৃদয়ে ধারণ করেছিলেন সযতেœ। একান্তে আমার সাথে হুজুরের সর্বশেষ দীর্ঘ আলাপচারিতায় তাঁর সর্বশেষ কথা হলো এই দুই বাক্য। হুজুুরকে প্রায় ঘণ্টা খানেক ‘একান্তে আমার দখলে’ রাখার পর খাদেম এসে যখন তাঁকে নিয়ে যাচ্ছিলেন তখন হুজুর কিছুটা ক্লান্ত কণ্ঠে চলতে চলতে ঐ বাক্য দুটো উচ্চারণ করেছিলেন। তারপর হাতের ইশারায় বিদায় দিয়ে বলেছিলেন, আজ এপর্যন্তই থাক।

এটা বিগত সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ের ঘটনা। শুক্রবার বাদ জুমা। আর কেউ ছিলেন না। আমি একাই ছিলাম হুজুরের কাছে। ব্যাস জ্ঞানের ঐ নির্ঝর থেকে মুখোমুখি আলাপে এ-ই আমার সর্বশেষ সুধাপান। বাক্য দুটো বলে হুযুর বললেন: কথাগুলো সংরক্ষিত হয়ে গেলে ভালো হতো! আমি বললাম- জি হুজুর! ইনশাআল্লাহ সংরক্ষিত হয়ে যাবে।

কিছু স্বপ্ন ও বেদনা ছিলো হুজুরের অন্তরে। বেশকিছুকাল আগের কথা। হুজুর গুলশান লেকপার মসজিদে [সুহৃদ মাওলানা মাসঊদ আহমদের মসজিদে] এ‘তেকাফরত ছিলেন। আমি তাঁর সাক্ষাতে গিয়ে বিনীতভাবে সামান্য হাদিয়া পেশ করেছিলাম। তখন তিনি বলেছিলেন: ‘বাজি! তোর হাদিয়া লাগবেনা। আমার অন্তরে কিছু ব্যথা আছে তুই সেগুলো লিখবি।’ হুজুরের জীবদ্দশায় হযুরের ‘বেদনা’ লিখে হুজুরকে না দেখানোর বেদনায় আমি আজ মর্মাহত। আরেকবার বলেছিলেন- ‘বেটা! এক রমযান হজুরের সাথে থাক্। এখন বুঝবি না’। তা-ও থাকা হলো না।

এক আশ্চর্য আত্মমগ্নতা আমাকে গ্রাস করেছিলো। সেই গাফলতের ভেতর দিয়েই আমার প্রিয় আলো নিভে গেলো। আমার প্রিয় হযরত না ফেরার দেশে চলে গেলেন। এ হলো আমার ঔদাসিন্যের সর্বোচ্চ শাস্তি। এখন আমার সামনে শুধুই অন্ধকার। তবে তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শই এখন আমার সবচে বড় সান্ত¡না। আমরা তাঁর রেখে যাওয়া আদর্শের উপর চলতে পারলেই তাঁর আত্মা খুশি হবে।

[ নয় ]

আল্লামা কাসেমী রহ. এর ঋণ আমরা কখনও শোধ করতে পারবোনা। আসুন আমরা সবাই তাঁর জন্য অন্তত এক খতম করে কোরআন শরীফ তিলাওয়াত করি এবং সর্বদা তাঁকে আমাদের দুয়ায় স্মরণ রাখি। বিশেষত: উপরে বর্ণিত মুসলিম শরীফের দুয়াটি সবাই অন্তত একবার পাঠ করি। অবশেষে মহান আল্লাহর নিকট হৃদয়ের একান্ত মিনতি- তিনি যেন আমাদের পরমপ্রিয় ও পরমশ্রদ্ধেয় আল্লামা নূর হোসাইন কাসেমী রহ. কে পরিপূর্ণ মাগফিরাত দান করেন। তাঁর পরিপূর্ণ রহমতের কোলে আশ্রয় দেন। তাঁর জীবনের সব খিদমত উত্তম কবুলিয়তে ভূষিত করেন। তাঁকে নবী-রসূল আলাইহিমুস সালামগণের সঙ্গি করে জান্নাতের অতি উচ্চ মাকাম দান করেন। আর আমাদেরকে চিরকাল তার দেখানো হকের পথে পরিচালিত করেন। আমীন। ছুম্মা আমীন।

লেখক: মুহাদ্দিস, জামিয়া আরাবিয়া বাইতুস সালাম উত্তরা, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।