Home ইতিহাস ও জীবনী আলবানিয়ার বেরাট শহর: পাথুরে টিলার ধাপে ধাপে তূর্কী ইতিহাস

আলবানিয়ার বেরাট শহর: পাথুরে টিলার ধাপে ধাপে তূর্কী ইতিহাস

ওসাম নদীর তীরে দক্ষিণ আলবানিয়ার বেরাট শহর-এর বাতাসে মিশে আছে অটোমান ইতিহাসের গল্প। বলকান উপদ্বীপের ইলিরিয়া ও এপিরাসের মধ্যবর্তী যে পার্বত্য অঞ্চল ওসাম নদী দুইভাগে ভাগ করে প্রবাহিত হয়েছে, সেই অঞ্চলেরই নিরিবিলিতে রয়েছে সমৃদ্ধশালী এই শহর।

সম্ভবত প্রাচীন গ্রিক শহর আন্তিপাত্রিয়ার ধ্বংসাবশেষের উপর ত্রয়োদশ শতকে এই শহরের পত্তন হয়। চতুর্থ শতকে সার্বিয়ানরা এই শহরের নাম রাখে বেলিগ্রাদ, যার অর্থ সফেদ নগরী। যার তূর্কী অপভ্রংশ আজ বেরাট নাম নিয়েছে।

আলবানিয়ার বেরাট শহর-এর ইতিহাস

এই প্রাচীন শহরের পাথুরে অলিগলিতে হেঁটে বেড়ালে মনে হয় মধ্যযুগের রহস্যময় মরীচিকার মধ্যে দিয়ে হেঁটে যাচ্ছি। ওসাম নদীর দুই পারে ধাপে ধাপে দুধসাদা অটোমান তূর্কী প্যাটার্নের বাড়ি থেকে টাটকা রুটি বেক করার গন্ধ ভেসে আসছে। সরু গলির দুপাশে অপুর্ব সুন্দর কারুকাজ করা কাঠের দরজা ইঙ্গিত দিচ্ছে, শহরের পুরনো খবর পাওয়া যাবে তার কাছেও। তুরস্কের বাইরে এমন অপূর্ব তূর্কী সংস্কৃতি ও ইতিহাসের মিশেল দেখা যায় একমাত্র এই শহরেই।

আরও পড়তে পারেন-

প্রাচীন বেরাটের চিত্র পাওয়া যায় মধ্যযুগীয় পর্যটক এভিলিয়া সেলেবির লেখায়। ১৬৭০ শতকে তিনি আলবানিয়ার বুকে এই সমৃদ্ধ শহরের সন্ধান পান। যে শহর তখন শিক্ষা, সংস্কৃতি ও কাব্যে উচ্চস্থান লাভ করেছে।

‘আমি নগরীর মধ্যে প্রবেশ করলাম। বিশাল আকারের এই সমৃদ্ধ নগরী আসলে এক দুর্গের বাইরের সীমানা বরাবর অবস্থিত। নদীর তীর ধরে বিস্তীর্ন এই শহরের উচ্চাংশ আঙ্গুরবাগান, গোলাপবাগান ইত্যাদি দ্বারা সজ্জিত। প্রায় পাঁচ হাজার শ্বেত বর্ণের দ্বিতল গৃহ রয়েছে এই শহরে, যা মোট সাতটি টিলার উপর বিস্তৃত। আরামদায়ক আবহাওয়া ও নদীর নাব্যতায় অপুর্ব এই শহর ও তার মানুষজন।’

ঐতিহাসিকরা বলেন, বেরাট নাকি পৃথিবীর এমন এক প্রাচীনতম শহর যা কখনও জনশূন্য হয়নি। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সার্বিয়ানরা পা রাখে এই শহরে। তাদের কাছ থেকে ১৪১৭ সনে অটোমান তূর্কীরা দখল নেই এই শহরের। তারপর, ইসলামী ধাঁচে গড়ে তোলা হয় এই শহর। অপুর্ব সমস্ত প্রাসাদ, মসজিদ, দরগা, মাদ্রাসা ও হামাম সাক্ষী দেয় অটোমান তূর্কীদের সমৃদ্ধ সংস্কৃতি ও বৈভবের।

আলবানিয়ার বেরাট শহর এর ছবির ফলাফল

বর্তমানে আলবানিয়ার বেরাট শহর-এর মানুষ

২০০৮ সালে ইউনেস্কো বেরাটকে বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন হেরিটেজ সাইটের তকমা দেয়। ইউনেস্কোর মতে, অটোমান তূর্কীদের ইতিহাসের এত সুন্দর সংরক্ষণ এই শহর ছাড়া আর কোথাও দেখা যায় না। এছাড়াও, এই শহরের আরেকটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হল সাধারণ তূর্কী মুসলমান ও আলবানিয়ার খ্রিস্টানরা সৌহার্দ্য ও সৌভাতৃত্ব সহযোগে বসবাস করে। মধ্যযুগীয় পর্যটক সেলেবির লেখাতেও এই সুন্দর সম্পর্কের কথা ছিল।

বর্তমানে, শহরের তিনটি অংশে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির প্রাচীন ছোঁয়া অনুভূত হয়। প্রথমটি কালা দুর্গ ও তার সন্নিহিত অঞ্চল। মূল শহরের থেকে বেশ খানিকটা উচ্চতায় এর অবস্থান। ত্রয়োদশ শতকের নানা প্রাচীন গির্জার দেখা মেলে এখানে। এই অঞ্চল থেকে সম্পুর্ণ শহরের মনোমুগ্ধকর ভিউ পাওয়া যায়।

এর একটু নীচে, ওসাম নদীর দুই পাশে অবস্থিত গোরিকা ও মাঙ্গালাম অঞ্চল। নদীর দক্ষিণ পারের নাম গোরিকা, এই অঞ্চল মূলত প্রাচীন ক্যাথলিকদের বাসস্থান। উত্তর পারে মাঙ্গালাম অঞ্চলে তূর্কী মুসলমানরা বসবাস করেন।

বেরাটে ঘুরতে এলে এই তিনজায়গা আপনাকে অবশ্যই অতীতের গরিমার ও শহরের মূল কাঠামোর সঙ্গে পরিচয় করে দেবে।

মাঙ্গালামের বিখ্যাত মসজিদ সমূহ

মাঙ্গালামের একদম নীচের অংশে রয়েছে সেলজেমান পাশা মসজিদ ওরফে ব্যাচেলর মসজিদ। কথিত আছে, আলবানিয়ায় যখন কমিউনিস্ট ডিকটেটরশিপ চলত, তখন মেয়েদের সাজের সামগ্রী সঞ্চিত করা হত এই মসজিদের পোর্টিকোতে। উনবিংশ শতকের তূর্কী স্থাপত্য ও পশ্চিম ইউরোপের স্থাপত্যের অদ্ভুত মিশ্রণ দেখা যায় এই মসজিদে।

এই মসজিদ থেকে হাঁটতে হাঁটতে আপনি পৌঁছবেন রাজ মসজিদ বা জামিয়া এ এম্ব্রেতিত মসজিদে।

ঐতিহাসিকরা বলেন, পঞ্চদশ শতকে তূর্কী সুলতান দ্বিতীয় বায়েজিদ এই মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা। একই সময় স্থাপিত সুফি দরগা তেকে ই হেলভেতিভ, যা আপনার মনের শান্তির হদিশ দেবে।

এরপর পায়ে পায়ে পাড়ি দিন শহরের প্রধান লিড মসজিদ বা ইজগুরলি মসজিদে। এটিই এই শহরের মূল মসজিদ। কথিত আছে গম্বুজে পারদের পালিশ থাকার কারণেই এর নাম লিড মসজিদ।

সম্পুর্ণ শহরকে এক ছাদের তলায় দেখতে চাইলে অবশ্যই দেখতে যেতে হবে এথনোগ্রাফিক মিউজিয়াম। এ শহরের ইতিহাস থেকে রাজনীতি পর্যন্ত সবকিছুর পরিচয় আপনাকে এই মিউজিয়ামই দেবে।

তবে, পাথুরে অলিতে গলিতে নদীর পাশাপাশি হেঁটে শহর চেনার অভিজ্ঞতা বোধহয় এগুলোর থেকে অনেক মনোগ্রাহী ভাবে হৃদয় স্পর্শ করবে। বাতাসে ভেসে আসবে আজানের সঙ্গে ইতিহাসের ফিসফিস। প্রাচীন আর আধুনিক বেরাট জীবন্ত হয়ে উঠবে আপনার চোখের সামনে।

কীভাবে যাবেন

আলবানিয়ার রাজধানী তিরানা পর্যন্ত ফ্লাইট , তারপর শেয়ার কার বা বাস নিয়ে সরাসরি বেরাট পৌঁছনো যায়। তিরানার একদম দক্ষিণেই অবস্থিত এই শহর।

ভ্রমণের টিপস

বেরাট অত্যন্ত শান্তিপ্রিয় শহর। এখানে মুসলমান ও খ্রিস্টানরা শান্তিপূর্ণ ভাবে বসবাস করে। শহরে নেমে প্রথমেই ইজগুরলি মসজিদের দিকে গেলে আপনি ইসলামের অনেক নিদর্শন দেখতে পাবেন। শহরের মূল রাস্তার নাম রুরা আন্তিপাত্রিয়ার দুপাশে অজস্র সুস্বাদু ও হালাল খাবারের দোকান আপনার জিভের স্বাদ মেটাবে, ঠিক যেভাবে শহরের তূর্কী স্থাপত্য মেটাবে আপনার চোখের খিদে।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।