Home সম্পাদকীয় বাড়ছে সাইবার অপরাধ: সতর্কতা বাড়াতে হবে

বাড়ছে সাইবার অপরাধ: সতর্কতা বাড়াতে হবে

।। আরিফুল ইসলাম ।।

বেশ কিছুদিন আগে আমি বিদেশী বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কলারশিপ বিষয়ক ওয়েবসাইটগুলো নিয়মিত ভিজিট করছিলাম এবং দেখছিলাম কোথায় স্কলারশিপের সুযোগ রয়েছে। কোথাও কোথাও আমার ইমেইল আইডি দিয়ে আমাকে এক্সেস নিতে হতো। কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী হওয়ার সুবাদে যথেষ্ট সতর্কতার সাথেই অনলাইনে ঘাঁটাঘাটি করতে চেষ্টা করতাম। একদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে আমার ইমেইল চেক করতে গিয়ে দেখি স্প্যামবক্সে একটি ইমেইল জমা হয়েছে। ইমেইলের টাইটেলটি ছিলো স্কলারশিপ বিষয়ক, তাই অনিচ্ছা সত্তে¡ও ইমেইলটি খুলে দেখি ভিতরে কি লেখা রয়েছে।

ইমেইলটি মনযোগ দিয়ে পড়ার পর বুঝতে পারলাম, এটি একটি ভূয়া ইমেইল, যা ইউনাইটেড আরব আমিরাত তথা দুবাইয়ের একজন মন্ত্রীর বরাত দিয়ে আমাকে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে মনে হতে পারে, এত বড় একটা স্কলারশিপের সুযোগ হাতছাড়া করে ফেললাম! কিন্তু আসলে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করলে বুঝতে পারবেন স্কলারশিপ কখনো মন্ত্রী মেইল করে অফার করবে না, করলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট বিভাগ কিংবা কোন প্রফেসর অফার করতে পারে। আবার আরেকটি বিষয় চিন্তা করেন, যেখানে মানুষ আবেদন করেই স্কলারশিপ পায় না সেখানে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে আবেদন না করেই কীভাবে স্কলারশিপ পেয়ে গেলাম?

এই যে স্কলারশিপ সংক্রান্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করলাম, কারণ তা থেকে আমি অনেক বড় একটি শিক্ষা পেয়েছিলাম, যা এখনো মেনে চলার চেষ্টা করি। বর্তমান তথ্য প্রযুক্তির দুনিয়ায় অনলাইনে বিচরণ করতে গিয়ে নানান জিনিস মাথায় রাখতে হয়, নাহলে যেকোন সময় মুখোমুখি হতে হয় অপ্রীতিকর অবস্থার।

সাইবার অপরাধ হলো অনলাইন দুনিয়ায় সংগঠিত অপরাধসমূহ। বর্তমানে আমাদের বেশিরভাগ কাজের সাথেই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে অনলাইন বা ইন্টারনেটের যোগসূত্র রয়েছে। আপনি ইমেইল ব্যবহার করেন, ফেসবুক সহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেন, অনলাইনে কেনাকাটা করেন, ব্যাংকিং সার্ভিসসহ অনেক কিছুই ব্যবহার করেন, যা সরাসরি সাইবার দুনিয়ার অংশ। আপনার একটু অসাবধানতা ডেকে আনতে পারে ভয়াবহ বিপদ। তাই এইসব ব্যবহারে হতে হবে সতর্কতার সঙ্গে। অনলাইনে অপরাধের বিভিন্ন প্রকার রয়েছে। তার মধ্যে লোভ দেখিয়ে বা ফাঁদে ফেলে সংগঠিত হয় সবচেয়ে বেশি।

কয়েকটি উদাহরণ দেখলে ব্যাপারটি সহজে বোধগম্য হবে। ধরুন, আপনার ইমেইলে একটি বার্তা আসলো, যেখানে লেখা আছে, আপনি কোন একটি ক্যাম্পেইনে বিজয়ী হিসেবে ১০,০০,০০০ ডলার পুরস্কার পেয়েছেন। এজন্য আপনাকে একটি লিংকে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে গিয়ে পুরস্কারের টাকাটি সংগ্রহ করতে হবে। আপনি কি করবেন? আপনার সব তথ্য প্রদান করে পুরস্কারটির জন্য চেষ্টা করবেন? থামুন! এটা শতভাগ স্প্যাম এবং ফিশিং মেইল। আপনি লিংকে ক্লিক করে তথ্য প্রদান করলেন মানে নিজেই নিজের সব তথ্য লোভের বশবর্তী হয়ে অন্যকে দিয়ে দিলেন। হয়তো সেখানে আপনার স্পর্শকাতর ব্যাংক ইনফরমেশনও ছিলো।

এবার ধরুন ফেসবুকে একটা বিজ্ঞাপন দেখলেন দামি মোবাইল বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৫০০০ টাকায়। কি করবেন? দ্রুত বুকিংয়ের জন্য নিজের তথ্যসহ একটি ফরম প‚রণ করবেন এবং অগ্রিম ৫০০০ টাকা পাঠিয়ে দেবেন, যাতে সেটা হাতছাড়া না হয়! আবারও থামুন! ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করুন। হয়তো আপনি আপনার কিছু তথ্য এবং কিছু অর্থ হারাতে বসেছিলেন। তাই মুখরোচক বিজ্ঞাপন থেকেও সাবধান। বর্তমানে তরুণদের আকৃষ্ট করতে স্মার্টফোন, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ, ক্যামেরা ইত্যাদির ভূয়া বিজ্ঞাপন অহরহ চোখে পড়ে। আবার প্রতিদিনই কেউ না কেউ এইসব চক্রের শিকার হচ্ছে।

এতক্ষণ যেগুলো আলোচনা করলাম সেগুলো সবই ফাঁদে পা দেয়ার জন্য তৈরি করা হয়। এবার আসি আমাদের অসাবধানতার দিকে। আমরা সবাই যে কাজটি করি তা হলো, যেখানে সেখানে আমাদের ফেসবুক, ইমেইলসহ অন্যান্য আইডি লগইন করি। লগইন করাতে কোন সমস্যা নেই; কিন্তু সমস্যা হয় তখনই যখন আমরা লগ আউট না করি। আপনার আইডিতে যদি আমি ঢুকতে পারি তাহলে আমি নিশ্চয় আপনার আইডির অপব্যবহার করতে পারবো।

আরও পড়তে পারেন-

সা¤প্রতিক কয়েকটি গবেষনায় দেখা যায়, দেশে সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছে প্রায় ৬৮-৭০শতাংশ নারী। এই নারীদের মধ্যে ১৫-৩৫ বছর বয়সীদের পরিমাণ প্রায় ৪২ শতাংশ। অর্থাৎ উঠতি বয়সের নারীরা এই অপরাধের শিকার হচ্ছে অধিক পরিমাণে। সাইবার ক্রাইম এওয়ারনেস ফাউন্ডেশনের কয়েকটি রিপোর্ট এবং সাইবার সেলের কিছু পরিসংখ্যান থেকে আমরা দেখতে পারি এই সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৫-১৬ সালের চেয়ে ২০১৯-২০ সালে এই প্রবণতা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে হুমকি দেয়া, হেনস্থা করা, উত্যক্ত করা, প্রতারণা করা ইত্যাদির পরিমাণ বেশি। বিভিন্ন ঘটনায় মামলা করার প্রবণতাও আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রমাণ করে মানুষ আগের চেয়ে বেশ খানিকটা সচেতনও হয়েছে। তবে মামলাগুলোর দ্রুত ও সঠিক নিষ্পত্তি নিশ্চিত করা গেলে এই সাইবার অপরাধ প্রবণতা অনেকটাই কমে আসবে।

এই সমস্যাগুলোর চেয়েও বেশি গুরুতর যেসব সমস্যা এখন চোখে পড়ে তা হলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে গুজব রটানো এবং নারীদের বিভিন্নভাবে হ্যারাস করা। আমরা হুজুগে বিভিন্ন জিনিস শেয়ার করি যার আসলে কোন সত্যতা নেই এবং নিজের অজান্তেই সাইবার অপরাধে জড়িয়ে যাই। কোন জিনিস শেয়ার করার আগে কিংবা কোন মন্তব্য করার আগে অবশ্যই সেই তথ্যটি সঠিক কিনা যাচাই করে নিতে হবে। নারীদের হ্যারাসমেন্টের কথা বলতে গেলে এখন রাস্তায় ইভটিজিংয়ের পরিবর্তে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম তথা ফেসবুকেই বেশি উত্যক্তের শিকার হচ্ছে নারীরা।

সাম্প্রতিক সময়ে আমার পরিচিত এক ছোট বোন এই ধরনের একটি ঘটনার শিকার হয়ে আমার শরণাপন্ন হয়। তার ঘটনাটি ছিলো এরকম, ফেসবুক মেসেঞ্জারে কোন একটি অজ্ঞাত পুলিশ পরিচয়ের আইডি থেকে তাকে মেসেজ পাঠানো হয় তার নামে থানায় একটি মামলা হয়েছে, যার নাম্বার ২৬/২০। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ সে প্রতারণা করে বিপুল অর্থ-সম্পদ হাতিয়ে নিয়েছে। আমার সাথে শেয়ার করার পর প্রথমেই আমার সন্দেহ জাগে মামলার নাম্বার দেখে, সচরাচর মামলার নাম্বার এমন হয় না, পুলিশ কখনো ফেসবুকে মামলা সম্পর্কে জানায় না বরং ফোনে বা সরাসরি ঠিকানায় এসে জানিয়ে যায় এবং মামলার আগে তদন্ত সাপেক্ষে চার্জশিট দাখিল করতে হয়।

এবার সেই পুলিশ পরিচয়ের ব্যক্তিটির সঠিক পরিচয়, পদবী ইত্যাদি জানার চেষ্টা করলাম। সবকিছু জানার পর বুঝালাম, এটি ভূয়া এবং তাকে মিথ্যাভাবে ভয় দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে। তবুও সে নিশ্চিন্ত হতে পারছিলো না। তাই তাকে ৯৯৯ নাম্বারে ফোন দিয়ে বিস্তারিত জানার জন্য পরামর্শ দিলাম। কিছুক্ষণ পর সে জানালো যে, এটি আসলেই ভূয়া এবং থানা থেকে জানানো হয়েছে, সেই অজ্ঞাত নামধারী কোন ব্যক্তি পুলিশের সাথে সম্পৃক্ত নয় এবং তাকে সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করার পরামর্শ দেয়া হয়।

অনলাইনে অনেক বোন হয়তো এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হন, অনেকে হয়তো কাউকে জানান না। আপনারা ভয় না পেয়ে আগে নিজের পরিবারের সাথে বা বন্ধুর সাথে এই বিষয়ে পরামর্শ করুন, দেখবেন উনারা আপনাকে সর্বোচ্চ সাপোর্ট দেবেন। এছাড়া ৯৯৯ নাম্বার সহ অন্যান্য হেল্পলাইনে যোগাযোগ করুন। এছাড়া ডিএমপির সাইবার এন্ড স্পেশাল ক্রাইম ডিভিশনের হটলাইন নাম্বার ০১৭৬৯৬৯১৫২২, ইমেইল czberhelp@dmp.gov.bd Ges Hello CT মোবাইল এপের মাধ্যমেও অভিযোগ জানাতে পারবেন।

আবার আমরা আরেকটা ভুল করি সেটা হলো, সব রকম আইডিতে একই পাসওয়ার্ড ব্যবহার করি, যাতে সহজে মনে রাখতে পারি। এটা আরেক বিপদের লক্ষণ। কারণ কোন কারণে একজন যদি আপনার কোন একটি আইডির পাসওয়ার্ড জেনে যায় তাহলে সে সবগুলো আইডির দখল নিয়ে নিতে পারবে। অনেকেই আবার পাসওয়ার্ড হিসেবে নিজের নাম, মোবাইল নাম্বার, জন্মতারিখ ইত্যাদি ব্যবহার করেন, যা মোটেও নিরাপদ নয়। আপনার পাসওয়ার্ড হওয়া উচিত সহজ, সহজে মনে রাখার মত; কিন্তু যেটা মানুষ সহজে অনুমান করতে পারবে না। যেমন, আপনার মায়ের নামের একটি অংশ, আপনার কোন ক্লাসের রোল বা রেজিষ্ট্রেশন নাম্বারের অংশ সাথে বিশেষ ক্যারেক্টারসমূহ। উদাহরণস্বরূপ- #Reji a@40#90. এখানে যদি কেউ জেনেও যায় রেজিয়া এবং ৪০, ৯০ আছে কিন্তু বিশেষ ক্যারেক্টারগুলোর অবস্থান নিয়ে কনফিউজড হতে বাধ্য হবে। এভাবে চাইলে আমরা কিছুটা সতর্কতা অবলম্বন করতে পারি। সাইবার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী পাসওয়ার্ড হওয়া উচিত ন্যূনতম ৮ ক্যারেক্টার, তবে আমার মনে হয়, ১৩-১৮ ক্যারেক্টারের পাসওয়ার্ড আপনাকে বেশি নিশ্চিন্তে থাকার সুযোগ করে দিতে পারে।

সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে আমরা যেমন সাইবার দুনিয়ায় বিচরণে অভ্যস্ত হচ্ছি, তেমনি অপরাধীরাও তাদের অপরাধ সংগঠনের জন্য এই প্ল্যাটফর্মকে ব্যবহার করছে। সাইবার অপরাধ বন্ধে আইন যতটা কার্যকর তার চেয়ে বেশি জরুরি আমাদের সচেতনতা, যথাযথ জ্ঞান, ব্যবহারের পদ্ধতি সম্পর্কে অবগত হওয়া। পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে সাইবার সচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে বেশ বড় পরিসরেই। প্রতিদিনই বাড়ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহারকারীর সংখ্যা। এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে সচেতনতার আওতায় আনা যদিও সহজ কাজ নয় তবুও ধাপে ধাপে তাদেরকে সঠিক পথে নিয়ে আসার ব্যবস্থা করতে হবে। সাইবার অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠিন অবস্থানও জরুরি, কারণ সঠিক বিচারের আওতায় না আসায় অনেক অপরাধী পুনরায় অপরাধ করার সাহস পায়। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সেইসব অপরাধীকে চিহ্নিত করে শাস্তি প্রদান করা উচিৎ।

লেখক: শিক্ষার্থী, কম্পিউটার বিজ্ঞান ও প্রকৌশল বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।