Home শিক্ষা ও সাহিত্য ফারেগীন তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামীর মূল্যবান নসীহত

ফারেগীন তরুণ আলেমদের উদ্দেশ্যে মুফতি আবদুস সালাম চাটগামীর মূল্যবান নসীহত

কওমী মাদরাসাসমূহের শিক্ষাবর্ষের সমাপ্তিতে তাকমীল, ইফতা, আদবসহ ফারেগীন শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে দিক-নির্দেশনামূলক মূল্যবান নসীহত করেছেন দারুল উলূম হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান পরিচালক ও মুফতিয়ে আযম হযরত মুফতি আবদুস সালাম চাটগামী। নসীহত অনুলিখন করেছেন- মুফতি হোসাইন আহমদ জাবের। বিষয়বস্তুর গুরুত্ব উপলব্ধি করে ‘উম্মাহ’ পাঠক সমীপে হযরতের এই নসীহতসমূহ উপস্থাপন করা হল। – বিভাগীয় সম্পাদক]

نحمده ونصلي على رسوله الكريم اما بعد

“প্রথমে তোমাদের একটি কথা বলি, যদি তোমরা আল্লাহ তাআলার কাছে কিছু চাও, তাহলে আখেরাতের জিনিসই চাও। আল্লাহ তাআলার রেযা চাও, তাঁর ইলম চাও, তাঁর মুহাব্বাত চাও। জামিয়া নিউ টাউনে আমার একত্রিশ বছর কেটেছে। তিন বছর লেখা-পড়ায় আর আঠাশ বছর উসতায হিসাবে। আস্ত বাংলা মূলকের মধ্যে ওখানে আমি একাই ছিলাম। কোন আত্মীয়-স্বজন ছিল না। কাছের কোন মানুষ-ই ছিল না।

আমরা দরসে মাগরিবের পর মুতালাআ করতাম। এশার পর যার যার রুমে চলে যেতাম। একদিন এশার সময় যার যার রুমে চলে যাব, হঠাৎ একদিন একজন এক এক করে সবাইকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো- দুনিয়াতে তারা কী কী চায়? সবাই যার ইচ্ছা বললো। যখন আমার কাছে আসলো, তখন আমি বললাম, ভাই আমি এই দরসগাহের মতো একটি রুম চাই। যেখানে আলমারি ভর্তি কিতাব থাকবে, আর আমি বসে বসে মুতালাআ করতে পারব!

এই কথাটি বলার সময় আমার মাথায় জামিয়া নিউ টাউনে খেদমত করার ধারণাই ছিল না। কেননা, জামিয়া নিউ টাউনে আমার খেদমত করার কোন কারণই ছিল না। আমার কোন আত্মীয়-স্বজন নেই, যারা আমার জন্য সুপারিশ করবেন। অতপর জুমাদাল উলার পনেরো তারিখ জামিয়া থেকে আমরা ফারিগ হলাম। আমি ইরাদা করলাম যে, দেশে চলে যাব। আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী রাহি. এর কাছে গিয়ে দেশে আসার জন্য ইযাজত চাইলাম। তিনি আমাকে বললেন, “তুমি দু’মাস মাদরাসার খুসুসি মেহমান খানায় থাকো।”

জামিয়া নিউ টাউনে দুটি মেহমান খানা ছিল। একটি ছাত্র ও উসতাযদের মেহমানদের জন্য আর অন্যটি আম মেহমানদের জন্য। আল্লামা বিন্নুরী আরো বললেন, “বাদশাহ খান (মেহমান খানার খাদিম) সকাল-সন্ধ্যা তোমার খাবার পৌঁছে দেবে। দু’মাস পর তোমার ব্যাপারে আমরা কিছু ভাববো।”

তিনি কী ভাববেন তা বলেননি। আমি ভেবেছি হয়ত অন্যকিছু। চারদিন মেহমান খানার বন্ধ রুমে কেটে গেল। হঠাৎ ভাবলাম করাচী চলে যাই। ওখানে আমার একজন দোস্ত একটি মসজিদের ইমাম। তার কাছে চলে যাওয়ার ইরাদা করলাম। বাদশাহ খানকে ডেকে বললাম, আমি আমার এক দোস্তের সাথে দেখা করতে যাচ্ছি। শায়খ বিন্নুরী জিজ্ঞাস করলে তা বলবে, ব্যস আর কিছু বলবে না।

আরও পড়তে পারেন-

করাচীতে দোস্তের কাছে চলে গেলাম। একদিন দু’দিন করে পনেরো দিন থেকে গেলাম। পনেরো নাম্বার দিনে স্বপ্নে দেখলাম যে, আল্লামা বিন্নুরী রহ. আমার গ্রামের বাড়ীতে আমাকে খুঁজতে গেছেন। তখন আমি আমাদের গ্রামের মসজিদে অজু করছি। মুয়াজ্জিন সাহেব এসে আমাকে বললেন, আরে আপনি এখানে! এদিকে আল্লামা বিন্নুরী রহ. আপনার জন্য আপনার ঘরে বসে অপেক্ষা করছেন। যান, তাঁর জন্য খাবার-দাবারের ইন্তেজাম করেন।

অতঃপর দেখলাম যে, আমি ঘরে পৌঁছে গেছি। আল্লামা বিন্নুরী রহ. আমাকে দেখে বললেন, “তুমি কোথায়? তোমাকে আমি নিতে এসেছি”। শায়খ বিন্নুরীর কাছে আমার পিতা দাঁড়িয়ে ছিলেন। আমি শুধু চোখ তুলে তাঁর দিকে তাকালাম। সাথে সাথে আমার পিতা বললেন, তুমি হযরতের সাথে চলে যাও। আমার কোন বাঁধা নেই।

তখন শায়খ বিন্নুরী রহ. বললেন, “তুমি নিউ টাউনে যে খেদমত করতে পারবে, দুনিয়ার কোথাও আর তেমন খেদমত করতে পারবে না। আমি আজ চলে যাচ্ছি, তুমি আগামীকাল রওয়ানা হয়ে যেও। প্রতি বছরের শেষ দিকে বাড়ীতে এসে মা-বাবার খেদমত করতে পারবে”।

অতঃপর দেখলাম, আল্লামা বিন্নুরীকে নৌকায় তুলে দেয়ার জন্য আমাদের বাড়ীর কাছের নদীতে আসলাম। আল্লামা বিন্নুরী রহ. নৌকার ইঞ্জিল স্টার্ট দিয়ে নৌকা নিয়ে চলে গেলেন। আর আমি বাড়ীতে যাওয়ার জন্য ফিরতি পথ ধরলাম। এই অবস্থায় আমার ঘুম ভেঙ্গে গেল। চেয়ে দেখি আমি করাচীতে!

আরে আমি না বাড়ীতে ছিলাম! আল্লামা বিন্নুরী রহ.কে খানা খাওয়ালাম! এখানে কীভাবে এলাম!  অতঃপর আসল ঘটনা স্মরণ হলে আমার দোস্তকে বললাম যে, আজ আমি নিউ টাউন যাব। স্বপ্নের কথা তাঁকে বললাম না। করাচী থেকে নিউ টাউনের দূরত্ব হলো, সাত-আট মাইলের। কিন্তু আমার কাছে গাড়ী ভাড়ার টাকা নেই। দোস্তকেও বললাম না টাকার কথা। কারো কাছে হাতপাতা আমার তবিয়ত বিরোধী। করাচী থেকে হেঁটেই রওয়ানা দিলাম। দশঘন্টা পর জামিয়া নিউ টাউনে পৌঁছলাম।

প্রথমেই দেখা হলো মুফতী অলি হাসান রাহি. এর সাথে। তখন তিনি তিরমিযির দরস দিয়ে মাত্র মাদরাসার দফতরে বসেছেন। আমাকে দেখেই বললেন, “আরে ইয়ার তুমি কোথায় চলে গেলে? আমরা তোমাকে খুঁজে খুুঁজে হয়রান!”

মুফতী ছাহেব রাহি. সবাইকে ইয়ার বলে সম্বোধন করতেন। উনার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে পাকিস্তান বেফাকুল মাদারিসের নাযিম মাওলানা ইদরিস ছাহেব রাহি. দফতরে ঢুকেই আমার হাত ধরে মুফতী ছাহেবকে বললেন, “ও একটা চোর! আমাদেরকে না বলেই কোথায় চলে গিয়েছিল। ওকে ভালভাবে ধরে রাখুন”।

মাওলানা ইদরিস ছাহেব মুফতী ছাহেবকে আরো বললেন,” ওর কদর করো, ও চলে গেলে ওকে আর তোমরা পাবে না”। মাওলানা ইদরিস ছাহেব মুফতী ছাহেবকে আরো বললেন,”আমাকে একটি কাগজ দিন”। মুফতী ছাহেব তাঁকে কাগজ দিলে, মাওলানা ইদরিস ছাহেব আমাকে বললেন,” এখানে দু’লাইনের একটি দরখাস্ত লেখো মাওলানা ইউসুফ বান্নুরী রহ.’র কাছে যে, আমি শুনেছি আপনার মাদরাসায় একজন মুফতীর পদ খালি আছে। আমাকে রাখার জন্য মুনাসিব মনে করলে মেহেরবানি হবে”। মাওলানা ইদরিস ছাহেব বললেন আর আমি লেখলাম। যবান তাঁর কলম আমার। লেখা শেষ হলে তিনি নিজে দরখাস্তের মধ্যে দস্তখত করে মুফতী ছাহেবকে বললেন, “তুমিও এখানে দস্তখত করো”। মুফতী ছাহেব দস্তখত করলে মাওলানা ইদরিস ছাহেব আমাকে বললেন, “এখনি এটা নিয়ে আল্লামা বিন্নুরির কাছে যাও”।

আমি আল্লামা বিন্নুরি রহ.-এর কামরায় গিয়ে দেখি দরজা অর্ধেক খোলা অর্ধেক বন্ধ। আস্তে করে একটি টোকা দিলাম। ভিতর থেকে হুংকার আসলো, কে?

বাঘের বাচ্চা, বাঘের মতোই আওয়াজ!

বললাম, আবদুস সালাম। তিনি বললেন, ভিতরে আস। ভিতরে গেলে আমাকে বললেন,” তুমি কোথায় চলে গিয়েছিলে!? আমি তোমাকে খুঁজছিলাম”। বললাম, এক দোস্তের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলাম, দেরি হয়ে গেছে। অতঃপর দরখাস্ত তাঁর কাছে দিলাম। তিনি বললেন, “ব্যস কাজ তো হয়ে গেল, মুফতী ছাহেব আর বেফাকের নাযিম যেখানে দস্তখত করেছেন, সেখানে আমার বলার আর কী আছে! তুমি এখনি গিয়ে দারুল ইফতায় বসে যাও”।

তাঁর কামরা থেকে বের হয়ে দেখি মাওলানা ইদরিস ছাহেব ও মুফতী ছাহেব আমার জন্য অপেক্ষা করছেন। আমাকে দেখেই তাঁরা জিজ্ঞাস করলেন, “তিনি কী বললেন?”

বললাম, তিনি বলছেন, এখনি দারুল ইফতায় বসার জন্য। তখন মাওলানা ইদরিস ছাহেব মুফতী ছাহেবকে লক্ষ্য করে বললেন, “ও-কে তুমি নিজে তোমার সাথে রেখে সবকিছু শিখিয়ে দেবে”। অতঃপর মুফতী ছাহেব হুজুর আমাকে নিয়ে দারুল ইফতায় গেলেন। তাঁর ডেস্কের পর’ই আমার ডেস্ক বসালেন! আমার ডেস্কের পর অন্যান্য মুফতী ছাহেবদের ডেস্ক!

আছরের পর নিজ রুমে ঢুকে কেঁদে ফেললাম।(এই কথা বলার সময় হুজুর কেঁদে ফেললেন) জামিয়া নিউ টাউনের মতো মাদরাসায় আমার খেদমত করার সুযোগ হলো! এখানে তো আমার কেউ নেই! আমি তো আল্লাহ তাআলার কাছে শুধু একটি কিতাব ভর্তি আলমারি চেয়েছিলাম। তার পরিবর্তে এতো বড় বিনিময় যে পাবো তা-তো কল্পনাও করিনি!

তো ভাই, আল্লাহ তাআলার কাছে কিছু চাইলে আখেরাতের জিনিস চান। বান্দা যখন আল্লাহর কাছে আখেরাতের কোন জিনিস চায়, আল্লাহ তখন হেসে ফেলেন! আরে আমার বান্দা আমার কাছে এতো ছোট জিনিস চাচ্ছে! আল্লাহ তাআলা তখন বান্দার ধারণার বাইরে আরো বড় নিয়ামত দান করেন। সুতরাং আল্লাহ পাকের কাছে তার রেযা, মুহাববাত এবং ইলম চাও।”

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।