Home ইতিহাস ও জীবনী মান্ডু আনন্দের শহরে পরিণত হয়েছিল আলাউদ্দিন খলজির হাত ধরে

মান্ডু আনন্দের শহরে পরিণত হয়েছিল আলাউদ্দিন খলজির হাত ধরে

- মান্ডু জাহাজ মহল।

মান্ডু শহরের অবস্থান হল ভারতের অন্যতম রাজ্য মধ্যপ্রদেশের মালওয়া অঞ্চলের ধর জেলায়। মালভূমির উপরে ২০ বর্গকিলোমিটার জায়গাজুড়ে গড়ে উঠেছিল এই শহর। তবে এই শহরটি শুধুই তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত নয়, এর অবস্থানগত গুরুত্বও রয়েছে। অন্তত ১৫০০ বছর আগে মান্ডু অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ ছিল এবং প্রসিদ্ধ জাহাজ মহল রয়েছে এখানেই।

মান্ডুর বহু নাম

এই শহরের প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় সংস্কৃত শিলালিপিতে, একটি জৈন মূর্তির বিবরণে। ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দের সেই শিলালিপিতে, এই শহরকে উল্লেখ করা হয়েছে মণ্ডপ-দুর্গ হিসেবে। মনে করা হয় সংস্কৃত নাম মণ্ডপের প্রাকৃত রূপ অথবা কথ্য ভাষায় একে মান্ডব বলা হত, এবং সেই নামই পরবর্তী কালেও ব্যবহার করা হয়। আধুনিক যুগে মান্ডব কথাটি আরও ছোট হয়ে মান্ডু-তে পরিণত হয়েছে।

ফিরিশতা, ষোড়শ শতকের এক পার্সী ঐতিহাসিক, উল্লেখ করেছিলেন যে খ্রিস্টাব্দ ষষ্ঠ শতক নাগাদ মান্ডুতে একটি দুর্গ নির্মীত হয়েছিল। এই দুই জায়গা থেকে প্রাপ্ত তথ্যতে জোড়া লাগালে বোঝা যায় যে, ৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে এই দুর্গের অস্তিত্ব ছিল এবং হয়তো আরও আগে এটি নির্মীত হয়েছিল।

আরও পড়তে পারেন-

মান্ডু দখলের লড়াই

মান্ডু সম্পর্কে দ্বিতীয় উল্লেখ পাওয়া যায় ৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ লিখিত আর একটি শিলালিপিতে। রাজস্থান থেকে উদ্ধার হওয়া এই পুঁথিতে উল্লেখ করা হয়েছে, মান্ডুর দুর্গ গুর্জর-প্রতিহার সাম্রাজ্যের সীমান্ত রক্ষায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করত। এই পুঁথিতে, মান্ডুকে উল্লেখ করা হয়েছে মণ্ডপিকা হিসেবে। সেই শতকেরই শেষ ভাগে, মান্ডুর নিয়ন্ত্রণ চলে গিয়েছিল পরমার সাম্রাজ্যের হাতে।

মান্ডুতে উদ্ধার হওয়া একটি সর্প-বন্ধে লিখিত শিলালিপিতে এক জনৈক ব্যক্তির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যাঁর নাম শ্রী-ভট্টরাকা-দেবেন্দ্র-দেব, ইনি সম্ভবত পরমার সাম্রাজ্যের রাজ উদয়াদিত্যের প্রতিনিধি ছিলেন। এই শিলালিপি ১০৬৮ সালে লেখা হয়েছিল। মনে করা হয়, লোহানি গুহা এবং শৈব গুহা, যা প্রকৃতপক্ষে ইউনেস্কো ওয়ার্ল্ড হেরিটেড সাইটের অন্যতম মধ্যপ্রদেশের মান্ডুর মিনারপুঞ্জের একটি অংশ গঠন করেছে, তা প্রকৃতপক্ষে এই পরমারদের রাজত্বকালেই নির্মীত হয়েছিল।

আনন্দের শহর মান্ডু

ত্রয়োদশ শতকের প্রথমার্ধে, মুসলিম সেলার মালওয়া অঞ্চল আক্রমণ সফল হয় এবং ভিলসা ও উজ্জয়িনী নগরী তারা দখল করে। মুসলিম সেনা এবং পরমারদের পক্ষে একটি শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। তার ফলে মান্ডু শেষ পর্যন্ত পরমারদের শাসনেই থেকে যায়, তবে এই সাম্রাজ্যের সূর্যাস্ত তখন আসন্ন। ১৩০৫ সালে, দিল্লির সুলতান, আলাউদ্দিন খলজি মান্ডু আক্রমণ ও দখল করেন। এই সময়ে মান্ডুর নামকরণ করা হয়েছিল শাদিয়াবাদ, যার অর্থ হল ‘আনন্দের শহর’।

এরপরে যখন দিল্লির সুলতানি সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়, তখন মালওয়ার শাসক, দিলাওয়ার খান গোরি, এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে নিজেকে স্বাধীন বলে ঘোষণা করেন ১৪০১ খ্রিস্টাব্দে। দিলাওয়ার এই সময়ে মালওয়ারের রাজধানী দৌর থেকে সরিয়ে মান্ডুতে নিয়ে যান। শহর এই নতুন মর্যাদা পাওয়া পরে, দিলাওয়ারের রাজত্বকালে এখানে বহু নতুন স্থাপত্যের কাজ হয়। এছাড়াও, দিলাওয়ার খান এই শহরের দুর্গ ব্যবস্থাকে আরও মজবুত করে তোলেন। মান্ডুতে নতুন স্থাপত্য নির্মাণের কাজ দিলাওয়ারের উত্তরাধিকারী, হোসাং শাহ চালিয়ে নিয়ে যান। তাঁর আমলে নির্মীত উল্লেখযোগ্য স্থাপত্যকার্যগুলির মধ্যে অন্যতম হল জামি মসজিদ এবং হোসাং শাহের সমাধি।

হোসাং শাহের পরে শাসনভার ন্যস্ত হয় তাঁর পুত্রের কাঁধে। কিন্তু এক বছরের মাথায় তাঁকে বিষ প্রয়োগ করে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকারী, মাহমুদ খান এরপরে সিংহাসনে আরোহণ করেন এবং তিনিই ছিলেন মালওয়ার প্রথম খলজি শাসক। প্রায় তিন দশক ধরে তিনি রাজত্ব করেন, মাহমুদের পরে রাজা হন তাঁর পুত্র, গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ শাহ।

মান্ডুর জাহাজ মহল

মান্ডুর অন্যতম বিখ্যাত স্থাপত্যকার্য হল জাহাজ মহল, এটি নির্মাণ করেছিলেন গিয়াসুদ্দিন ইওয়াজ শাহ। জাহাজ মহল আবার জাহাজ প্রাসাদ নামেও বিখ্যাত। এই নামকরণের কারণ হল, দুই দিকের জলসীমান্তের মাঝে এক ফালি জমিতে এই প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়েছিল। ফলে একে দেখতে অনেকটা সমুদ্রে ভাসমান জাহাজের মতো মনে হয়।

লোকগাঁথা অনুসারে, গিয়াসুদ্দিন অত্যন্ত বিলাসী প্রকৃতির ছিলেন, এবং তিনি জাহাজ মহল নির্মাণ করেছিলেন নিজের অবসর সময় কাটানোর জন্য। এই দুর্গের মধ্যে তাঁর হারেমে অন্তত ১৫ হাজার মহিলা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেককে নিয়ে আসা হয়েছিল সুদূর তুরস্ক এবং অ্যাবিসিনিয়া থেকে।

মুঘলদের অধীনে মান্ডু

১৫৬১ সালে, মান্ডু দখল করে নেন মুঘলরা, এবং মালওয়ার শেষ স্বাধীন শাসক. বাজ বাহাদুর, শহর ছেড়ে পালিয়ে যান। এরপরে মান্ডু আর কোনও স্বাধীন রাজ্যের রাজধানী ছিল না, ফলে এই শহর তার গৌরব হারায় এবং তার পতন শুরু হয়। তবে, মুঘল বাদশাহরা এই শহরটি খুবই পছন্দ করতেন। বাদশাহ আকবর চার বার এই শহরে এসেছিলেন। তাঁর পুত্র জাহাঙ্গিরও মান্ডুতে সাত মাস কাটিয়েছিলেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।