Home ইসলাম ‘রহমত-বরকত-নাজাতের মাসেই যাকাত-ফিতরা যথাযথভাবে আদায় করুন’

‘রহমত-বরকত-নাজাতের মাসেই যাকাত-ফিতরা যথাযথভাবে আদায় করুন’

রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান উত্তরা জামিয়াতুন নূর আল কাসেমিয়া ও রওজাতুস সালিহাত মহিলা মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক, প্রখ্যাত আলেম আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী যাকাত এবং সদকায়ে ফিতর আদায়ের গুরুত্ব তুলে ধরে বলেন, নেসাবের অধিক সম্পদশালীদের জন্য যাকাত আদায় করা ফরয এবং প্রতিটি সক্ষম মুসলমানের জন্য ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। পবিত্র মাহে রমযানে বছরের অন্যান্য মাসের তুলনায় ইবাদতের সাওয়াব ৭০ গুণ বৃদ্ধি করা হয়। সুতরাং এই মাসে ফরয যাকাত আদায় করা হলে ৭০ গুণ বেশি সাওয়াব পাওয়া যাবে। তাই যাকাত বাকী না রেখে রমযানে আদায় করতে সকলকে সচেষ্ট থাকতে হবে, যাতে অধিক পূন্য অর্জিত হয়।

তিনি আরো বলেন, ইসলাম হল একটি পরিপূর্ণ জীবন বিধান। মানুষের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনের সকল কর্মকাণ্ডে সঠিক দিক নির্দেশনা রয়েছে ইসলামে। ইসলাম মানুষের মৌলিক অধিকার, সামাজিক সুবিচার এবং মানব সমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠার যেমন ব্যবস্থা করেছে, তেমনি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করে যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ভারসাম্যমূলক অর্থনীতি উপহার দিয়েছে।

তিনি বলেন, ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম স্তম্ভ। ইসলামের অন্যান্য মূল স্তম্ভ নামায, রোযা ও হজ্বের মতোই যাকাত প্রদান করাও ফরয।

তিনি বলেন, যাকাতের শব্দার্থ হচ্ছে বৃদ্ধি, পবিত্রতা, পরিচ্ছন্নতা, বিশুদ্ধতা ইত্যাদি। যাকাত আদায়ের মাধ্যমে সম্পদ পবিত্র, পরিচ্ছন্ন ও বিশুদ্ধ হয় এবং মালের বরকত বৃদ্ধি পায়। আল্লাহ’র অসন্তুষ্টি ও গযব হতে সমাজ মুক্ত ও পবিত্র হয়। এ জন্য যাকাতকে যাকাত বলা হয়।

তিনি বলেন, ইসলামে যাকাত ব্যবস্থার গুরুত্ব অপরিসীম। আল্লাহ্ তাআলার হুকুম মেনে চলার নামই ইবাদত। আর ইবাদতকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। দৈহিক ও আর্থিক। যাকাত হল আর্থিক ইবাদত। আর্থিক ইবাদতের মধ্যে যাকাতের গুরুত্ব সর্বাধিক। নামাযের মতই এটি ফরয। কুরআন ও হাদীসে যাকাত প্রদানের জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, “নামায কায়েম কর, যাকাত দান কর এবং নামাযে অবনত হও তাদের সাথে যারা অবনত হয়।” (সূরা বাক্বারাহ্ ৪৩)। “নামায কায়েম কর, যাকাত প্রদান কর এবং রাসূলের আনুগত্য কর যাতে তোমরা অনুগ্রহ প্রাপ্ত হও।” (সূরা নূর- ৫৬)। বুখারী শরীফে বর্ণিত হাদীসে হযরত রাসূলে কারীম (সা.) ইরশাদ করেছেন, “আল্লাহ্ তাআলা ধনীদের উপর যাকাত ফরয করেছেন। যাতে ধনীদের নিকট হতে সংগ্রহ করে দরিদ্রের মধ্যে বণ্টন করা হয়।”।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী বলেন, আল্লাহ্ তাআলা নিসাব পরিমাণ ধন-সম্পদের মালিকদের উপর যাকাত ফরয করেছেন এবং নির্ধারিত হারে যাকাত প্রদান করা অপরিহার্য করেছেন। আর যাকাত আদায় না করাটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ সাব্যস্ত করেছেন। যাকাতের অর্থ দরিদ্র, দুঃস্থ, ফকীর, মিসকীন, অসহায় মানুষের প্রাপ্য। নিসাবের বর্ধিত সম্পদের আড়াই শতাংশের মালিক এসব গরীব মুসলমানগণ। আর এসব মানুষের দারিদ্রতা বিমোচন ও পুনর্বাসনে ইসলামের যাকাত ব্যবস্থার যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। সুতরাং যারা যাকাত আদায় করছেন, তারা গরীবদের প্রতি করুণা করছেন না, বরং তাদের প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে দিচ্ছেন। এই প্রাপ্য অংশ বুঝিয়ে না দিলে হাশরের ময়দানে কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। তাই পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব করে যাকাত আদায় করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, যেসকল মুসলমানের কাছে নিত্য ব্যবহার্য ও প্রয়োজনীয় সম্পদের অতিরিক্ত সাড়ে সাত তোলা স্বর্ণ বা সাড়ে বায়ান্ন তোলার রূপা বা তার সমপরিমাণ সম্পদের অতিরিক্ত সম্পদ আছে, তার উপর যাকাত ফরয। যার উপর যাকাত ফরয হবে, তাকে সম্পদের আড়াই শতাংশ বা ৪০ ভাগের এক ভাগ যাকাত হিসেবে গরীব-মিসকীনের মাঝে বণ্টন করে দিতে হবে। উদাহরণত: যে কারো কাছে ৮০ হাজার টাকা আছে, তিনি মাত্র ২ হাজার টাকা গরীব-মিসকীনের মাঝে বণ্টন করবেন, বাকী ৭৮ হাজার টাকা তিনি নিজে ভোগ-ব্যবহার করবেন। এমনিভাবে স্বচ্ছল সকল মুসলমানকে ফিতরা আদায় করতে হবে। ফিতরা আদায় করা ওয়াজিব। এবছর জনপ্রতি ন্যূনতম ফিতরা ৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তবে যাদের সমর্থ আছে, তারা অধিক ফিতরাও আদায় করতে পারবেন। তারা খেজুর, কিসমিস দিয়ে হিসাব করে ফিতরা দিবেন। যাদের সমর্থ কম, তারা আটা বা গমের হিসাব মতে জনপ্রতি ৭৫ টাকা ফিতরা দিবেন। ফিতরায় দুইটা উপকার রয়েছে। প্রথমত: এতে গরীব-মিসকিনদের ভরণ-পোষণে কিছু সহযোগিতা হয়, দ্বিতীয়ত: মাহে রমযানের রোযায় নিজের অজান্তে ভুল-ত্রুটি কিছু হয়ে থাকলে তার কাফফারা স্বরূপ ক্ষতিপুরণ আদায় হয়ে যায়। এমনিভাবে যেখানে উশরি জমিন আছে, সেসব জমিনের উৎপাদিত ফসলের ১০ ভাগের এক ভাগ দান করে দেওয়া ফরয। যাকাত ও উশরের বিধানের কথা পবিত্র কুরআন ও হাদীসে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। যাকাত, উশর কোন ট্যাক্স দেওয়া নয়, এটা নিছক ইবাদত।

আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী বলেন, ইসলামের যাকাতের বিধান পালন করা অপরিহার্য। বিধান অনুযায়ী যাকাত প্রদান করলে যেমন মালের পবিত্রতা হাসিল হয়, বরকত হয় এবং সাওয়াব পাওয়া যায়, তেমনি এ বিধান অমান্য বা মালের যাকাত প্রদান না করলে পরকালে কঠোর ও ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে এবং সম্পদ পেরেশানীর কারণ হবে। তথাপি এক শ্রেণীর মুসলমান যাকাত প্রদান করা থেকে বিরত থাকে বা যাকাত প্রদান করাকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে না। কেউ আবার ঢাকঢোল পিটিয়ে সামান্য কিছু গরীব-দুঃখী মানুষকে যাকাত প্রদান করে থাকে। এটি যে লোক দেখানো বা সমাজের মানুষের কাছে দানবীর বা দাতা হিসেবে পরিচিতি লাভের আশায় করা হয়ে থাকে, তাতে কোন সন্দেহ নেই। গচ্ছিত মালের শরীয়তের বিধান অনুযায়ী যত টাকা যাকাত প্রদান করা দরকার তা তারা করে না। যদি সঠিক হিসেব-নিকেশ করে যাকাত প্রদান করা হয়, তবে সমাজের অনেক অসহায়, গরীব, মিসকীন উপকৃত হবে।

তিনি বলেন, দেশের প্রতিটি সক্ষম মানুষ যদি যাকাত, ফিতরা ও উশর যদি নিয়মিত আদায় করে থাকেন, তাহলে এই দেশে কোন দরিদ্রতা থাকবে না, সমাজ থেকে সকল ধরণের অভাব-অনটন দূর হয়ে যাবে। বিশ্বের এক অন্যতম গরিব রাষ্ট্র হলো আমাদের বাংলাদেশ। তারপরও যদি আমাদের দেশের ধনীরা ঠিক মতো যাকাত আদায় করে, তাহলে আমাদের দেশে কোন দারিদ্রতা থাকবে না। সরকারকে অন্য রাষ্ট্রের কাছে হাত পাততে হবে না এবং এতে বাংলাদেশ নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারবে। ইসলামেই একমাত্র দরিদ্রতা বিমোচন করতে পারে, আর সেই দরিদ্রতা বিমোচনের একমাত্র পন্থা হলো যাকাত আদায় করা।

আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী বলেন, ইসলামে যে যাকাত ব্যবস্থা রয়েছে, তার যথেষ্ট অবদান লক্ষ্য করা যায়। দুনিয়ার যাবতীয় ধন-সম্পদের মালিক একমাত্র আল্লাহ্ তাআলা। তিনি মানব জাতিকে নির্ধারিত নিয়মে আয়-ব্যয় করার অধিকার দিয়েছেন। আল্লাহ্ তাআলা কাউকে প্রচুর ধন-সম্পদের মালিক করেন আবার কাউকে রাস্তার ফকীর। মানব জাতিকে পরীক্ষার জন্যই এটি করা হয়ে থাকে। কারণ, এ পৃথিবীটা একটা পরীক্ষাগার সমতুল্য। যারা ধন-সম্পদের মালিক হয়ে থাকে অর্থাৎ সাহেবে নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী হয়, তাদেরকে আল্লাহ্ তাআলার নির্ধারিত বিধান মোতাবেক যাকাত প্রদান করতে হবে। যদি না করে তবে পরকালে কঠোর ও ভীষণ শাস্তি ভোগ করতে হবে। অতএব, আল্লাহর বিধান অমান্য করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার সুযোগ এবং ব্যক্তির ইচ্ছামত আয় ও ব্যয় করার সুযোগ ইসলামে নেই।

তিনি বলেন, পুঁজিবাদী সমাজ ব্যবস্থায় কিছু লোক সমাজের সিংহ ভাগ মানুষকে শোষণ করে তাদের ন্যায্য পাওনা থেকে বঞ্চিত করে বিরাট সম্পদের মালিক হয়ে উঠে এবং নিজের ইচ্ছামত ব্যয় করার অধিকারী হয়। অপর দিকে অন্যেরা হয় বঞ্চিত। ইসলাম যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে সম্পদের সুষ্ঠু বণ্টনের ব্যবস্থা করেছে। ফলে দরিদ্র, দুঃস্থ, সর্বহারা মানুষের অনাহারে মরার সুযোগ নেই, যা পুঁজিবাদী অর্থ ব্যবস্থায় দেখা যায়। পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বিরাট বৈষম্য দেখা যায়। ইসলাম যাকাত ব্যবস্থার মাধ্যমে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা করেছে। ইসলামী অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পুরোপুরি মেনে চললে মানব সমাজে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য থাকতো না। আমাদের সমাজে ধনী-দরিদ্রের যে পার্থক্য সৃষ্টি হয়, তা কেবল পুরোপুরি ইসলামী অর্থব্যবস্থা না মানার কারণে। যেসব লোক নিসাব পরিমাণ মালের অধিকারী, তারা যদি নির্ধারিত নিয়মে সঠিকভাবে যাকাত প্রদান করে, তাহলে সমাজের ধনী-দরিদ্রের এই বিরাট বৈষম্য থাকতো না। তাই ধনী-দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণে ইসলামের যাকাত-সাদকা, ফিতরা, দান ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে।

তিনি বলেন, ধনীদের সম্পদে বঞ্চিতদের অধিকার রয়েছে। আর যাকাতের হকদার হল, দুঃস্থ, গরীব, মিসকীন-অসহায় মানুষ। কিন্তু তাই বলে তাদের প্রতি ধনীদের এটা অনুগ্রহ নয়। কারণ, আল্লাহ্ তাআলা যাকাত ফরয করার মাধ্যমে ধনীদের সম্পদে গরীবদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছেন। বলতে গেলে ধনীদের দায়িত্ব ও কর্তব্য হল, যারা যাকাতের হকদার তাদের কাছে গিয়ে এই অর্থ পৌঁছে দেওয়া। কাজেই যাকাত হল, ধনীদের সম্পদের গরীবদের একটি অংশ, যা প্রদান করা অপরিহার্য।

আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী বলেন, রমজান মাস হলো হামদর্দী ও সাহায্য-সহানুভূতির মাস। তা সমর্থবানদেরকে নিজের আত্মীয়-স্বজন, পাড়াপ্রতিবেশী ও অন্যান্য অক্ষম ও সাহার্য প্রত্যাশীদেরকে সাহায্য করতে হবে, তাদের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করতে হবে। যাদের খাবার নাই, তাদের খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে। যাদের কাপড় নাই কাপড় দিতে হবে। রোযাদারদেরকে ইফতার করাতে হবে। হাদীসে আছে, যে মানুষ রোযাদারদেরকে পেট ভরিয়ে খানা খাওয়াবে, তাদেরকে হাশরের ময়দানে রাসূলুল্লাহ (সা.) হাউজে কাওসারের পানি পান করাবেন। এতে বেহেস্তে প্রবেশ পর্যন্ত তারা আর পীপাসার্ত হবেন না। সরকার এবং কোম্পানিদের উচিত হলো, এই মাসে কর্মচারীদের কাজকে হালকা করে দেয়া। কর্মচারীদের ডিউটি টাইম ৮ ঘন্টার হলে রমযান মাসে রোযা রাখার করণে ডিউটিকে কমিয়ে ৬/৫ ঘন্টা করে দেয়া এবং এটাই হলো সহানুভূতি। এতে তারা আল্লাহর কাছে পুরষ্কৃত হবেন এবং তাদের গুনাহ ক্ষমা করা হবে। ইসলাম এটাই শিক্ষা দিয়েছে। আল্লাহ পাক আমাদের সকলকে রমজানের করণীয় আ’মলসমূহ যথাযথভাবে আদায় করার এবং বর্জনীয় কাজসমূহ তরক করার তাওফীক দান করুক। সরকার, প্রশাসন এবং অন্যান্য সকল মানুষকে পারস্পরিক হামদর্দী ও সহানুভূতিপূর্ণ আচরণ করার তাওফীক দান করুন, আমীন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।