।। মাওলানা মুফতি রাশেদুল ইসলাম ।।
ইসলামের সোনালী যুগে মুসলমানদের উন্নতি ও বিশ্ব জয়ের মূলে কারণ ছিল তাদের পারস্পরিক মুহাববত -ভালোবাসা ও হিংসা বিদ্বেষমুক্ত হৃদয়ের সৃদৃঢ় বন্ধন। তারা অন্যের দুঃখ-বেদনাকে নিজের সাথে ভাগ করে নিতেন অন্যের জন্য সেটাকেই ভালবাসতেন, যেটা নিজের জন্যে ভালবাসতেন। এ বিষয়ে মক্কার মুহাজির মুসলমানদের জন্য মদীনার আনছারগণের অনন্য ত্যাগের দৃষ্টান্ত বিশ্ব ইতিহাসে অমর হয়ে আছে। এমনকি যুদ্ধের ময়দানে মৃত্যুপথ যাত্রী তৃষ্ণার্ত মুসলিম সৈনিক, পানিপ্রার্থী অন্য সৈনিকের স্বার্থে নিজে পানি পান না করেই প্রাণত্যাগ করে মানবতার চরম দৃষ্টান্ত দেখিয়ে গিয়েছেন। ইতিহাসে যার কোন নজির নেই। আর এমন না হবেই বা কেন? কারণ রাসুলের সুহবতের বরকতে তাঁদের অন্তর ছিল সকল প্রকার হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত।
“তবিবে কূলুব”কথা অন্তরের চিকিৎসক রাসুলুল্লাহ্ (সাঃ) অন্তররোগের যে সিকিৎসা দিয়েছেন, তাঁরা তা সাদরে গ্রহণ করে নিয়েছেন। এবং সে অনুযায়ী আমল করাটাকেই নিজেদের সবচেয়ে বড় কর্তব্য মনে করেছেন।
অন্তর ধ্বংসকারী কিছু দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করে রাসূল (সাঃ) হাদিসে এরশাদ করেন-
অনুবাদ : হযরত আনাস বিন মালেক (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, তোমরা পরস্পরে বিদ্বেষ করো না, হিংসা করো না, ষড়যন্ত্র করো না ও সম্পর্ক ছিন্ন করো না। তোমরা পরস্পরে আল্লাহর বান্দা হিসাবে ভাই ভাই হয়ে যাও’।(বুখারী,হা,৬০৭৬)
উক্ত হাদীছে মানবতাকে হত্যাকারী কয়েকটি দুরারোগ্য ব্যাধির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, যা ইসলামী সমাজকে ভিতর থেকে ধ্বংস করে দেয়। এখানে এমন চারটি ব্যাধির উল্লেখ করা হয়েছে যা মূলতঃ একটি থেকে সৃষ্টি হয়ে থাকে। আর তা হ’ল ‘হিংসা’। এই মূল বিষবৃক্ষ থেকেই বাকী গুলোর কাঁটাযুক্ত ও যন্ত্রণাদায়ক ডাল-পালা গজায়।
ইসলামী পরিভাষায় “হাসাদ” বা হিংসা বলা হয়-
‘আল্লাহ্ অন্যকে যে নেয়ামত দান করেছেন, তা তাঁর কাছ থেকে বিলুপ্ত হয়ে হিংসুক নিজের জন্য কামনা করা। আর হিংসুক হল-
হিংসাকৃত ব্যক্তির নে‘মত ধ্বংসের আকাংখী’।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
আর যখনই কোন অন্তরে হিংসা স্থান পেয়ে যায়, সাথে সাথে সেখানে বিদ্বেষ জম্ম নেয়।সে তখন সর্বদা ঐ ব্যক্তির মন্দ কামনা করতে থাকে। যেমন মুমিনদের বিরুদ্ধে মুনাফিকদের আচরণের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ বলেন-
‘যদি তোমাদের কোন কল্যাণ অর্জিত হয়, তাতে তাঁরা (মুনাফেক) অসন্তুষ্ট হয়ে যায়। আর যদি তোমাদের কোন অকল্যাণ হয়, তাতে তারা আনন্দিত হয়। (আলে ইমরান ৩/১২০)।
বস্তুত: এ দু’টি বদস্বভাবের মধ্যে ঈমানের কোন অংশ নেই। কারণ, সে ব্যক্তিই পূর্ণাঙ্গ মুমিন,যে সর্বদা অন্যের কল্যান কামনা করবে। যেরকম ভাবে সে নিজের কল্যান কামনা করে থাকে। রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) বলেন-
তোমাদের কেউ পরিপূর্ণ মুমিন হতে পারবে না, যতক্ষণ না সে তার ভাইয়ের জন্য ঐ বস্তু ভালবাসবে, যা সে নিজের জন্য ভালবাসে’।[বোখারী, মুসলিম]
হাদিসে রাসুল (সাঃ) “হিংসা”কে পূর্ববর্তী উম্মতের সংক্রমিত রোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন-
হযরত যুবায়ের ইবনুল ‘আওয়াম (রাঃ) হ’তে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন, دَبَّ إِلَيْكُمْ دَاءُ الأُمَمِ قَبْلَكُمُ الْحَسَدُ وَالْبَغْضَاءُ هِىَ الْحَالِقَةُ ‘তোমাদের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করবে বিগত উম্মতগণের রোগ। আর তা হ’ল হিংসা ও বিদ্বেষ। যা মুন্ডনকারী। لاَ أَقُوْلُ تَحْلِقُ الشَّعْرَ وَلَكِنْ تَحْلِقُ الدِّيْنَ ‘আমি বলছিনা যে চুল মুন্ডন করবে, বরং তা দ্বীনকে ছাফ করে ফেলবে’। অর্থাৎ ক্ষুর ও ব্লেড যেমন চুল ছাফ করে দেয়। হিংসা ও বিদ্বেষ তেমনি দ্বীনকে বিদূরিত করে দেয়।( তিরমিযী; মিশকাত হা/৫০৩৯)।
সমাজের শান্তি শৃঙ্খলা বিনষ্টের মূলেই এই হিংসা-বিদ্বেষ। যে সমাজে হিংসার প্রচার-প্রসার যত বেশী, সে সমাজে অশান্তি ও শৃঙ্খলা ঠিক ততটাই বেশী। কারণ, সমাজে কল্যাণ ও শান্তি ততক্ষণ বিরাজ করে, যতক্ষণ না সেখানে হিংসার প্রসার ঘটে। হররত যামরাহ বিন ছা‘লাবাহ (রাঃ) হতে বর্ণিত,রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এরশাদ করেন-
‘মানুষ অতক্ষণ কল্যাণের মধ্যে থাকবে, যতক্ষণ তারা পরস্পরে হিংসা না করবে’।(ত্বাবারাণী হা/৮১৫৭; ছহীহাহ হা/৩৩৮৬)। [পরবর্তী পর্বে সমাপ্য]
– মাওলানা মুফতি রাশেদুল ইসলাম, সিনিয়র শিক্ষক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ