।। মাওলানা সাঈদ আহমদ ।।
বর্তমান বিশ্বের আলোচিত একটি বিষয় হচ্ছে, وحدة الاديان / التقريب بين الاديان
( interfaith dialogue) তথা আন্তঃধর্মীয় সংলাপ। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে, সকল ধর্মকে এক চোখে দেখতে হবে। কোন ধর্মকে ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা যাবে না কিংবা অগ্রহণযোগ্য বলা যাবে না। মানে আমার/ ইসলাম ধর্মও সঠিক, অন্য ধর্মও সঠিক।
এ জাতীয় বয়ানের প্রবক্তা, সুশীল ও বুদ্ধিজীবিরা বিভিন্ন টকশোতে, জনসভায়, এমনকি সংসদের মতো গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় এর স্বপক্ষে কোরআন থেকে দলিলও দেয়।
তাদের প্রধান দলীল হচ্ছে, لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্যে, আর আমার ধর্ম আমার জন্যে। (সূরা কাফিরুন-৬)
আরেকটি দলিল, فَمَن شَاءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
অতএব, যার ইচ্ছা মুমিন হোক এবং যার ইচ্ছা কাফের হোক। (সূরা কাহাফ-২৯)
আবার ধর্মনিরপেক্ষতাবাদীরাও প্রথম আয়াত আওড়িয়ে বয়ান হাযির করে যে, “তোমার ধর্ম তোমার ব্যাক্তিগত বিষয়, আর আমার ধর্ম আমার ব্যাক্তিগত বিষয়।”
তথা নৈতিক ও শিক্ষাঙ্গন, সামাজিকবন্ধন, অর্থনীতিপ্রণয়ন, আদালত ভবন, রাজনীতির ময়দান, বঙ্গবভন ও রাষ্ট্রীয় ফরমান প্রভৃতি ধর্মমুক্ত থাকবে। এজন্য কেউ কেউ আরো একধাপ এগিয়ে বলে, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার”।
অথচ আয়াতের অর্থ ও মর্ম কীভাবে অপব্যাখ্যা ও বিকৃতি করে তারা এসব বক্তব্য দেয়, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এর চেয়ে আরো মারাত্মক বিষয় হচ্ছে, এটা শিরিক ফিদ্দীন। শিরিকের অনেক প্রকারভেদ আছে, তন্মধ্যে এটি অন্যতম।
এখানে সবচেয়ে যে বড় ভুল বা প্রতারণা করা হয়, তা হল ভিন্ন দুটি বিষয়কে একসাথে মিলিয়ে একাকার করে ফেলা।
একটি হচ্ছে, ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতা।
আরেকটি হল, ধর্মের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা।
কোন ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতা, কখনো উক্ত ধর্মের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা নয়।
আরও পড়তে পারেন-
- প্রাপ্তবয়স্ক নারী-পুরুষের বিবাহ্ সম্পর্কে শরয়ী বিধান
- ইসলামের আলোকে নারীর কর্মপরিধি
- সালাম: উম্মাহর ঐক্য ও সংহতি রক্ষার অন্যতম বাহন
- বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ: বাস্তবতা ও অপপ্রচার
- সকালের ঘুম যেভাবে জীবনের বরকত নষ্ট করে
একটি উদাহরণের মাধ্যমে উভয়ের মাঝে পার্থক্য সুস্পষ্ট করি। দুনিয়াতে পরীক্ষার হলে যেভাবে সঠিক উত্তরদাতার সুযোগ ও স্বাধীনতা রয়েছে, তেমনিভাবে ভুল উত্তরদাতারও সমান সুযোগ ও স্বাধীনতা রয়েছে। কিন্তু পরীক্ষকের কাছে একমাত্র সঠিক উত্তরদাতা স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে। ভুল উত্তরদাতা পরীক্ষার হলে পরীক্ষকের কাছ থেকে সুযোগ ও স্বাধীনতা পেলেও কখনো স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।
এর তরুতাজা একটি উদাহরণ হচ্ছে, কওমী সনদ স্বীকৃতি। স্বীকৃতির পূর্বে কওমী শিক্ষার সুযোগ ও স্বাধীনতা ছিল। কিন্তু উক্ত শিক্ষার (দরকারী স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা থাকলেও) সরকারী স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ছিল না। তেমনি প্রত্যেক ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতা আর ধর্মের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা ভিন্ন বিষয়।
দুনিয়া হল দারুল ইমতিহান বা পরীক্ষার হল। এটাই কুরআনের স্পষ্ট ভাষ্য।
الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا
যিনি সৃষ্টি করেছেন মরণ ও জীবন, যাতে তোমাদেরকে পরীক্ষা করেন- কে তোমাদের মধ্যে সবচেয়ে ভালো আমল করে?(সূরা মুল্ক- ২) এ বিষয়ে অনেক আয়াত রয়েছে।
আল্লাহ তাআলা যেহেতু দুনিয়াকে পরীক্ষার হল বানিয়েছেন, তাই পরীক্ষার হলের মতো সুযোগ ও স্বাধীনতা দিয়েছেন। আর এ সুযোগ ও স্বাধীনতার কথা উল্লেখ হয়েছে কুরআনে কারীমের উক্ত দুই আয়াতে।
فَمَن شَاءَ فَلْيُؤْمِن وَمَن شَاءَ فَلْيَكْفُرْ
মানে এটা হচ্ছে দুনিয়ার পরীক্ষার হলের স্বাধীনতা। ফলে যার ইচ্ছা, সঠিক উত্তর দিয়ে মুমিন হও। আর যার ইচ্ছা, ভুল উত্তর দিয়ে কাফের হও।
لَكُمْ دِينُكُمْ وَلِيَ دِينِ
মানে এটা হচ্ছে পরীক্ষার হলে সঠিক ও ভুল উত্তর দেওয়ার মতো এ দুনিয়াতে তোমাদের ও আমার বা যেকোন ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতা।
এ কারেণেই অন্য আয়াতে ইরশাদ হয়েছে, لا اكراه في الدين
মানে ধর্ম গ্রহণে (পালনে নয়) জবরদস্তি নেই। তথা সঠিক উত্তর দেওয়ার জন্যে জবরদস্তি করা যাবে না। কারন পরীক্ষার হলে আপনাকে সঠিক ও ভুল উত্তর উভয়টির সুযোগ ও স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে।
কিন্তু এ সুযোগ ও স্বাধীনতা মানে কখনো যেকোন ধর্মের স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা নয়। কেননা আল্লাহ তাআলার কাছে কোন্ ধর্ম স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা পাবে, তা সুস্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللَّهِ الْإِسْلَامُ
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ইসলামই (স্বীকৃত ও গ্রহণযোগ্য) দ্বীন-ধর্ম।(সূরা আলে ইমরান ১৯)
وَرَضِيتُ لَكُمُ الْإِسْلَامَ دِينًا ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন-ধর্ম হিসেবে পছন্দ ও নির্বাচন করলাম। (সূরা মায়েদা ৩)
পক্ষান্তরে কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তা আল্লাহ তাআলার কাছে স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা তো পাবেই না, বরং এর পরিণতিও জানিয়ে দিয়েছেন। ইরশাদ হয়েছে,
وَمَنْ يَبْتَغِ غَيْرَ الْإِسْلَامِ دِينًا فَلَنْ يُقْبَلَ مِنْهُ وَهُوَ فِي الْآَخِرَةِ مِنَ الْخَاسِرِينَ.
কেউ ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্ম গ্রহণ করে, তা কখনো গ্রহণযোগ্যতা পাবে না।বরং সে আখেরাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।(সূরা আলে ইমরান ৮৫)।
কেউ যদি ইসলাম ছাড়া অন্য ধর্মের প্রতি অনুরাগী হয়, বা অন্য ধর্মের গ্রহণযোগ্যতা যদি কারো কাছে থাকে, তাহলে তিনি শিরক ফিদ্দীন করছেন। এটা সাধারণ কোন আকিদা নয়; বরং অনেক গুরুত্বপূর্ণ আকিদা। কারণ এটার দ্বারা সে ইসলামের গণ্ডি থেকে বের হয়ে যাবে।
আরো ইরশাদ হয়েছে, إِن تَكْفُرُوا فَإِنَّ اللَّهَ غَنِيٌّ عَنكُمْۖ وَلَا يَرْضَىٰ لِعِبَادِهِ الْكُفْرَ
যদি তোমরা কুফরী কর, তবে আল্লাহ তোমাদের মুখাপেক্ষী না। তিনি তাঁর বান্দাদের কাছে কুফরী পছন্দ করেন না। (সূরা যুমার ৭)।
এত সুস্পষ্ট বিবরণ থাকার পরেও তারা ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতাকে ধর্ম স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা বলে চালিয়ে দিচ্ছে।
সুতরাং “লাকুম দীনুকুম ওলিয়া দীন” বলে প্রত্যেককে যার যার ধর্ম পালনের সুযোগ ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে; স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতা দেওয়া হয়নি।
ধন্যবাদ জানাই মাননীয় সংসদ সদস্য জনাব হারুনুর রশীদকে। তিনি সাহসীকতার সাথে সংসদে এ বিষয়ে দৃষ্টি আকষর্ণ করেছেন। আল্লাহ তাআলা আপনাকে সবার পক্ষ থেকে নেকী ও আজর দান করুন।
– মাওলানা সাঈদ আহমদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।
উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ