Home ইসলাম হিংসার কুফল

হিংসার কুফল

।। মাওলানা মুফতি রাশেদুল ইসলাম ।।

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

(ক,) হিংসাকারী ও বিদ্বেষী লোকের অন্তর হয় ঈমান শূন্য। হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্ণিত রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) এরশাদ করেন- لاَ يَجْتَمِعَانِ فِىْ قَلْبِ عَبْدٍ الإِيْمَانُ وَالْحَسَدُ

কোন বান্দার অন্তরে ঈমান ও হিংসা একত্রিত হতে পারে না’। (ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬; মিশকাত হা/৫২২১)।

অর্থাৎ- একটি অন্তরে হয় ঈমান থাকবে,না হয় হিংসা থাকবে। ঈমানদারের অন্তরে হিংসা থাকবে না, হিংসুকের অন্তরে ঈমান থাকবে না। পরিপূর্ণ মুমিন কখনো হিংসুক নয়, হিংসুক কখনো পূর্ণাঙ্গ মুমিন নয়।

(খ,)”হিংসা” হিংসুকের নেকীগুলিকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেয়,যেমন আগুন শুকনো কাঠকে জ্বালিয়ে ভস্ম করে ফেলে। এভাবে হিংসা হিংসুকের অগোচরে তাঁর পূর্বের কৃত সৎকর্ম সমূহ ক্রমেই নিঃশেষ করে দেয়।

(গ,)হিংসা ও বিদ্বেষ হ’ল অন্তরের বিষয়,তবে ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ও সম্পর্কচ্ছেদ ইত্যাদির মতো বিষফলগুলি প্রকাশ পায় কর্মের মাধ্যমে। তাই অন্তর বিদ্বেষমুক্ত না হলে,কর্ম অন্যায়মুক্ত হয় না।

(ঘ,) হিংসুক অন্যকে ক্ষতি করার আগে সে নিজেকে ক্ষতিগ্রস্ত করে। কেননা শুরুতেই সে হিংসার আগুনে জ্বলতে থাকে। হিংসা দূর না হওয়া পর্যন্ত এটাই তার জন্য দুনিয়াবী স্থায়ী শাস্তি।

(ঙ,) হিংসা ও বিদ্বেষের নিমিত্তে মানুষ সত্যকে সত্যরূপে অনুধাবন করার পরেও, কেবলমাত্র হিংসা-বিদ্বেষের বশীভূত হয়ে তাঁর বিরোধিতায় লিপ্ত হয়। যেমন মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে আল্লাহ্ কুরআনে বলেন-

وَلَمَّا جَآءَهُمْ كِتَٰبٌ مِّنْ عِندِ ٱللَّهِ مُصَدِّقٌ لِّمَا مَعَهُمْ وَكَانُواْ مِن قَبْلُ يَسْتَفْتِحُونَ عَلَى ٱلَّذِينَ كَفَرُواْ فَلَمَّا جَآءَهُم مَّا عَرَفُواْ كَفَرُواْ بِهِۦ ۚ فَلَعْنَةُ ٱللَّهِ عَلَى ٱلْكَٰفِرِينَ

আর যখন তাঁদের কাছে যা আছে আল্লাহর কাছ থেকে তার সত্যায়নকারী কিতাব আসলো; অথচ পূর্বে তারা এর সাহায্যে কাফেরদের বিরুদ্ধে বিজয় প্রার্থনা করত, তারপর তারা যা চিনত যখন তা তাদের কাছে আসল, তখন তারা সেটার সাথে কুফরী করল। কাজেই কাফেরদের উপর আল্লাহর লানত।(সুরা বাক্বারাহ -৮৯)।

আরও পড়তে পারেন-

রাসুল (সাঃ)এর আগমণের পূর্বে ইয়াহুদীরা তাঁদের পূর্ববতী নবীগণ যে নবীর আগমনবার্তা শুনিয়েছিলেন তার জন্য প্রতীক্ষারত ছিল।

তাঁরা দো’আ করত আল্লাহ্ যেন অবিলম্বে শেষ নবী কে পাঠিয়ে কাফেরদের প্রাধান্যতা খতম করে, ইয়াহুদী জাতির উন্নতি ও পুনরুত্থানের সূচনা করেন।

কিন্তু অবাক করার বিষয় হল, যে ইয়াহুদীরা শেষ নবীর আগমন প্রতীক্ষায় দিন গুনছিল, নবীর আগমনের পর বনি ইসরাইলের বংশধর না হওয়ায়, বংশীয় বিদ্বেষের কারণে সেই ইহুদিরাই তার সবচেয়ে বড় শত্রুতে পরিণত হল। (মুসনাদে আহমাদ ৩/৪৬৭)।

ওদিকে আবু জাহল শেষনবী মুহাম্মাদ (সা.)কে সত্য বলে স্বীকার করেও কেবলমাত্র হিংসা-বিদ্বেষের কারণে মেনে নেয়নি, তাঁর বনু মখযূম গোত্রে জন্ম না হয়ে বনু হাশেম গোত্রে জন্ম হওয়ার কারনে।

নিবন্ধের প্রথম অংশ পড়ুন- অন্তরের এক মারাত্মক ব্যাধির নাম ‘হিংসা’

অতএব, একজন মুসলিমের কর্তব্য হ’ল সর্বদা সাদা মনের অধিকারী থাকা। তাঁর অন্তরে যেন কারোর প্রতি হিংসার কালিমা না থাকে।

একবার রাসূলুল্লাহ (সা.)কে জিজ্ঞেস করা হ’ল, শ্রেষ্ঠ মানুষ কে? তিনি বললেন- كُلُّ مَخْمُوْمِ الْقَلْبِ صَدُوْقِ اللِّسَانِ ‘প্রত্যেক শুদ্ধহৃদয় ও সত্যভাষী ব্যক্তি’। লোকেরা বলল, সত্যভাষীকে আমরা চিনতে পারি। কিন্তু শুদ্ধহৃদয় ব্যক্তিকে আমরা কিভাবে চিনব? জবাবে তিনি বললেন, هُوَ التَّقِىُّ النَّقِىُّ لاَ إِثْمَ فِيْهِ وَلاَ بَغْىَ وَلاَ غِلَّ وَلاَ حَسَدَ ‘সে হবে আল্লাহভীরু ও পরিচ্ছন্ন হৃদয়; যাতে কোন পাপ নেই, সত্যবিমুখতা নেই, বিদ্বেষ নেই, হিংসা নেই। (ইবনু মাজাহ হা/৪২১৬)।

হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত হৃদয়ের অধিকারী কে জান্নাতে রসুলের সঙ্গী হওয়ার সংবাদ!

قَالَ أَنَسُ بْنُ مَالِكٍ قَالَ لِي رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : ” يَا بُنَيَّ، إِنْ قَدَرْتَ أَنْ تُصْبِحَ وَتُمْسِيَ لَيْسَ فِي قَلْبِكَ غِشٌّ لِأَحَدٍ فَافْعَلْ “. ثُمَّ قَالَ لِي : ” يَا بُنَيَّ، وَذَلِكَ مِنْ سُنَّتِي، وَمَنْ أَحْيَا سُنَّتِي فَقَدْ أَحَبَّنِي، وَمَنْ أَحَبَّنِي كَانَ مَعِي فِي الْجَنَّةِ “.

হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) আমাকে সম্মোধন করে বললেন, হে আমার প্রিয় বৎস! যদি তোমার সম্ভব হয়, এমনভাবে সকাল-সন্ধ্যায় করবে যে, তোমার অন্তরে কারো প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ থাকবেনা। তাহলে তাই করো। অতঃপর আমাকে বললেন, হে আমার প্রিয় পুত্র! এটি আমার সুন্নাহ্ । যে আমার সুন্নতকে জিন্দা করল সে আমাকে ভালবাসল, আর যে আমাকে ভালবাসল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (তিরমিযী)।

হযরত আনাস ইবনু মালেক (রাঃ) আরো বলেন, আমরা একদিন রাসূলুল্লাহ (ছাঃ)-এর নিকট বসে আছি। এমন সময় তিনি বললেন, يَطْلُعُ عَلَيْكُمُ الآنَ رَجُلٌ مِنْ أَهْلِ الْجَنَّةِ ‘এখন তোমাদের নিকট একজন জান্নাতী মানুষের আগমন ঘটবে’। অতঃপর আনছারদের একজন ব্যক্তি আগমন করল। যার দাড়ি দিয়ে ওযুর পানি টপকাচ্ছিল ও তার বামহাতে জুতা জোড়া ছিল।

দ্বিতীয় দিন ও তৃতীয় দিন রাসূল (সা.) একই রূপ বললেন এবং পরক্ষণে একই ব্যক্তির আগমন ঘটলো। অতঃপর যখন রাসূল (সা.) মজলিস থেকে উঠলেন, তখন আবদুল্লাহ ইবনু আমর ইবনুল ‘আছ তাঁর পিছু নিলেন। …আনাস (রাযি.) বলেন, আব্দুল্লাহ বিন আমর (রাযি.) বলেন যে, আমি তার বাসায় একরাত বা তিন রাত কাটাই। কিন্তু তাকে রাতে ছালাতের জন্য উঠতে দেখিনি। কেবল ফজরের জন্য ওযূ করা ব্যতীত। তাছাড়া আমি তাকে সর্বদা ভাল কথা বলতে শুনেছি।

এভাবে তিনদিন তিনরাত চলে গেলে আমি তার আমলকে সামান্য মনে করতে লাগলাম(كِدْتُ أَنْ أَحْتَقِرَ عَمَلَهُ)। আমি তখন ঐ ব্যক্তিকে বললাম, আপনার সম্পর্কে রাসূল (ছাঃ) এই এই কথা বলেছিলেন এবং আমিও আপনাকে গত তিনদিন যাবৎ দেখছি। কিন্তু আপনাকে বড় কোন আমল করতে দেখলাম না (فَلَمْ أَرَكَ تَعْمَلُ كَبِيْرَ عَمَلٍ)। তাহলে কোন বস্ত্ত আপনাকে ঐ স্থানে পৌঁছিয়েছে, যার সুসংবাদ আল্লাহর রাসূল (সা.) আমাদেরকে শুনিয়েছেন। তিনি বললেন, আমি যা করি তাতো আপনি দেখেছেন।

অতঃপর যখন আমি চলে আসার জন্য পিঠ ফিরাই, তখন তিনি আমাকে ডেকে বললেন, مَا هُوَ إِلاَّ مَا رَأَيْتَ غَيْرَ أَنِّىْ لاَ أَجِدُ فِىْ نَفْسِىْ لأَحَدٍ مِنَ الْمُسْلِمِيْنَ غِلاًّ وَلاَ أَحْسُدُ أَحَداً عَلَى خَيْرٍ أَعْطَاهُ اللهُ إِيَّاهُ ‘আপনি যা দেখেছেন, তাতো দেখেছেন। তবে আমি আমার অন্তরে কোন মুসলিমের প্রতি কোনরূপ বিদ্বেষ রাখি না এবং আমি কারু প্রতি আল্লাহ প্রদত্ত কোন কল্যাণের উপর হিংসা পোষণ করি না’। একথা শুনে আব্দুল্লাহ বিন আমর বললেন, هَذِهِ الَّتِىْ بَلَغَتْ بِكَ وَهِىَ الَّتِىْ لاَ نُطِيْقُ ‘এটিই আপনাকে উক্ত স্তরে পৌঁছেছে। এটি এমন একটি বস্ত্ত যা আমরা করতে সক্ষম নই। (মুসতাদরাকে হাকেম ৩/৭৯, মুসনাদে আহমাদ হা/১২৭২০)।

আল্লাহ্ তা’আলা আমাদের অন্তর গুলোকে পারস্পারিক হিংসা-বিদ্বেষ মুক্ত রাখার তৌফিক দান করুন এবং পরস্পরকে নিঃস্বার্থভাবে ভালোবেসে সাহাবায়ে কেরামের সোনালী যুগের আদলে, শান্তি-শৃঙ্খলা ও সমৃদ্ধ একটি সমাজ গঠন করার তৌফিক দান করুন। আমিন।

– মাওলানা মুফতি রাশেদুল ইসলাম, সিনিয়র শিক্ষক- আল-জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম-হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।