Home মহিলাঙ্গন মহিলাদের মসজিদে গমন ও সালাত আদায় প্রসঙ্গে শরীয়তের বিধান

মহিলাদের মসজিদে গমন ও সালাত আদায় প্রসঙ্গে শরীয়তের বিধান

- মাওলানা সাঈদ আহমদ।

।। মাওলানা সাঈদ আহমদ ।।

সহীহ হাদীসে মহিলারা মসজিদে যেতে চাইলে অনুমতি দেয়ার জন্য বলা হয়েছে। যেমন সহীহ মুসলিমসহ অনেক হাদীসগ্রন্থে এসেছে, আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, তোমাদের স্ত্রীরা যদি (জামাআতে নামায পড়ার জন্য) মসজিদে আসার অনুমতি চায়, তবে তোমরা বাধা প্রদান করো না। (মুসলিম, হা. ৪৪২)।

তবে বিভিন্ন সহীহ ও নির্ভরযোগ্য হাদীসে পরিষ্কারভাবে বলা হয়েছে, মহিলাদের জন্য মসজিদ অপেক্ষা ঘরে নামায আদায় করা উত্তম। যেমন, হযরত উম্মে হুমাইদ আস-সায়িদী রাযিআল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, একবার তিনি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিকট এসে আরয করলেন, হে আল্লাহর রাসুল! আমি আপনার পিছনে নামায আদায় করা উত্তম মনে করছি।

নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উত্তরে বললেন-قَدْ عَلِمْتُ أَنَّكِ تُحِبِّينَ الصَّلَاةَ مَعِي، وَصَلَاتُكِ فِي بَيْتِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي حُجْرَتِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي حُجْرَتِكِ خَيْرٌ مِنْ صَلَاتِكِ فِي دَارِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي دَارِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ، وَصَلَاتُكِ فِي مَسْجِدِ قَوْمِكِ خَيْرٌ لَكِ مِنْ صَلَاتِكِ فِي مَسْجِدِي، قَالَ: فَأَمَرَتْ فَبُنِيَ لَهَا مَسْجِدٌ فِي أَقْصَى شَيْءٍ مِنْ بَيْتِهَا وَأَظْلَمِهِ، فَكَانَتْ تُصَلِّي فِيهِ حَتَّى لَقِيَت اللهَ عَزَّ وَجَلَّ .

আমি ভালো করেই জানি, তুমি আমার পিছনে নামায আদায় করা উত্তম মনে করছো। কিন্তু তোমার জন্য তোমার একান্ত রুমে নামায আদায় করা অন্য রুমে আদায় করার চেয়ে উত্তম। আর তোমার ঘরের কোনো রুমে নামায আদায় করা বাড়িতে (সামনের রুমে) আদায় করার চেয়ে উত্তম। আর তোমার বাড়িতে নামায আদায় করা এলাকার মসজিদে আদায় করার চেয়ে উত্তম। আর তোমার এলাকার মসজিদে নামায আদায় করা আমার পিছনে (মদিনা শরীফে) নামায আদায় করার চেয়ে উত্তম। বর্ণনাকারী বলেন, এরপর ঐ সাহাবিয়া মহিলার নির্দেশে তার ঘরের একেবারে ভেতরে অন্ধকার কুঠরিতে নামাযের জন্য জায়গা বানানো হয়। আর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি সেখানেই নামায আদায় করতে থাকেন। (মুসনাদে আহমাদ ২৭০৯০, হাফেয ইবনে হাজার রহ. ‘ফাতহুল বারী’ গ্রন্থে বলেন, এর সনদ হাসান। আরো দেখুন, আনীসুস সারী ফী তাখরীজি ফাতহিল বারী’ ৫/৩৭৮৪-৮৬)।

আরও পড়তে পারেন-

একই মর্মের হাদীস হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.ও রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন। (আবু দাউদ হা. ৫৭০, মুসতাদরাকে হাকিম ৭৫৭, সনদ সহীহ বা হাসান)।আম্মাজান উম্মে সালামাহ রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, .خَيْرُ مَسَاجِدِ النِّسَاءِ قَعْرُ بُيُوتِهِنَّমহিলাদের ঘরের ভেতরাংশ হচ্ছে তাদের নামাযের জন্য উত্তম স্থান। (মুসনাদে আহমাদ হা. ২৬৫৪২ ও ২৬৫৭০, সহীহ ইবনে খুযায়মা হা. ১৬৩৮, আবু দাউদ হা. ৫৬৭, হাদীসটি সহীহ। আরো দেখুন, ইবনু আব্দিল বারের আত-তামহীদ ২৩/৩৯৮-৪০১)।লক্ষ্য করুন! উল্লিখিত হাদীসসমূহে মহিলাদেরকে মসজিদে না যাওয়ার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। নবী-যুগে মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার তাগিদ তো দূরের কথা, উৎসাহও ছিল না। কারণ উৎসাহ কিংবা তাগিদ ছিল এমন কোনো বর্ণনা পাওয়া যায় না। বরং কেবল অনুমতি ছিল; তাও আবার একটি হাদীসে অনুমতির সাথে সাথে মসজিদে না যাওয়ার প্রতিও উৎসাহিত করা হয়েছে।

যেমন ইবনে ওমর রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, لَا تَمْنَعُوا نِسَاءَكُمُ الْمَسَاجِدَ، وَبُيُوتُهُنَّ خَيْرٌ لَهُنَّ.তোমাদের মহিলাদেরকে মসজিদে যেতে বারণ করো না; তবে তাদের (নামাযের জন্য মসজিদের জামাআত থেকে) তাদের ঘর উত্তম। (আবু দাউদ হা. ৫৬৭, সনদ সহীহ; বযলুল মাজহূদ ৩/৪১৭, আত-তামহীদ ২৩/৩৯৫)।

উল্লেখ্য, মহিলাদের মসজিদে যাওয়ার এই অনুমতিটাও অনেক শর্ত সাপেক্ষে, যা হাদীস থেকে গৃহীত। যথা- ক. সাজগোজ করে বের হতে পারবে না। খ. ঝনঝনানিপূর্ণ অলঙ্কার পরে বের হতে পারবে না। গ. সুগন্ধি লাগিয়ে বের হতে পারবে না। ঘ. হেলেদুলে চলতে পারবে না। ঙ. পুরুষদের ভিড় এড়িয়ে রাস্তার একপাশ হয়ে চলবে। চ. যুবতী মহিলা হতে পারবে না, বরং বৃদ্ধা ও আশঙ্কামুক্ত মহিলা হতে হবে। ছ. সবচে’ বড় বিষয় হল, তাদের এ বের হওয়াটা ফেতনার কারণ হতে পারবে না। (দেখুন, তুহফাতুল আহওয়াযী, মুবারকপুরী ২/৪৮০, মাআরিফুস সুনান, বানূরী ৪/৪৪৫-৪৭)।ইমাম ইবনু আব্দিল বার রহ. বলেন, ইবনে ওমর রা.এর হাদীস থেকে একথা প্রমাণিত যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহিলাদেরকে শুধু রাতের সময় মসজিদে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন; দিনের বেলায় নয়। তাও আবার সাথে এটাও বলে দিয়েছেন যে, (রাত্রেও মসজিদের জামাআত থেকে) তাদের ঘর তাদের জন্য উত্তম। (আত-তামহীদ, ইবনু আব্দিল বার ২৩/৩৯৫, ৩৯৬, ৪০২)।আজও এসব শর্ত পাওয়া গেলে মহিলারা মসজিদে যেতে চাইলে অনুমতি দেওয়ার অবকাশ আছে।

কিন্তু নবী-যুগের পর যখন উক্ত শর্তগুলো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হতে থাকে, তখন সাহাবায়ে কেরাম তা উপলব্ধি করতে পেরে মহিলাদের মসজিদে গমনের উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে দিয়েছেন। আর এটা তো স্বতঃসিদ্ধ কথা যে, নবীজির কথা কিংবা চাহিদা সাহবায়ে কেরামের চাইতে বেশি কেউ বুঝেছে বলে দাবি করা কিংবা তাদেরকে আদর্শ মনে না করা নিতান্ত মূর্খতা বৈ কিছু নয়।

নিম্নে কয়েকজন সাহাবায়ে কেরামের বক্তব্য বক্তব্য উল্লেখ করা হল:

১. সহীহ ‘বুখারী’তে এসেছে, হযরত আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন,لَوْ أَدْرَكَ رَسُولُ اللهِ مَا أَحْدَثَ النِّسَاءُ لَمَنَعَهُنَّ الْمَسْجِدَ كَمَا مُنِعَتْ نِسَاءُ بَنِي إِسْرَائِيلَ.যদি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বর্তমানকালের মহিলাদের অবস্থা দেখতেন, তাহলে অবশ্যই তাদেরকে মসজিদে আসতে নিষেধ করতেন। যেভাবে নিষেধ করা হয়েছিল বনি ইসরাঈলের মহিলাদেরকে। (সহীহ বুখারী হা. ৮৬৯, মুসলিম হা. ৪৪৫)।

২. আবু আমর শাইবানী বলেন, আমি আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.কে দেখেছি, তিনি জুমার দিন মহিলাদেরকে মসজিদ থেকে বের করে দিতেন। অন্য বর্ণনায় এর শেষে একথাও রয়েছে যে, এবং তিনি বলতেন, আপনারা বের হয়ে যান। আপনাদের ঘরই আপনাদের জন্য উত্তম। মুসনাদে মুসাদ্দাদ, সূত্রে- হাফেয ইবনে হাজার রচিত আল-মাতালিবুল আলিয়াহ, হা. ৬৮৫, তিনি বলেন, সনদ সহীহ। দ্বিতীয় বর্ণনাটি দেখুন, মুসান্নাফ আব্দুর রায্যাক হা. ৫২০১, আল-মু’জামুল কাবীর, তাবরানী হা. ৯৪৭৫ ও ৯৪৭৭, মাজমাউয যাওয়াইদ ২/৩৫)।

৩. হযরত ইবনে ওমর রা. তাঁর পরিবারের মহিলাদেরকে দুই ঈদের নামাযে যেতে দিতেন না। (মুসান্নাফ ইবনে আবী শাইবাহ হা. ৫৮৪৫)।

উপরোল্লিখিত হাদীস ও বর্ণনাসমূহের প্রতি লক্ষ্য করে হাদীস ও ফিকহের ইমামগণ বলেছেন, মহিলাদের জন্য মসজিদে নামায আদায় করার চেয়ে ঘরে নামায আদায় করা উত্তম।

এমনকি যে সমস্ত আহলে হাদীস ভাইয়েরা মহিলাদেরকে মসজিদে আসার জন্য উদ্বুদ্ধ করেন- তাদের প্রিয় ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বদ্বয় কাযী শাওকানী ও ওবায়দুল্লাহ মুবারকপুরী রহ. পর্যন্ত বলেছেন, وصلاتهن على كل حال في بيوتهن أفضل من صلاتهن في المساجد.

মহিলাদের জন্য সর্বাবস্থায় মসজিদে নামায আদায় করার চেয়ে ঘরে নামায আদায় করা উত্তম। (নায়লুল আওতার ৩/২৫৮, মিরআতুল মাফাতীহ ৩/৫০৬)। কিয়ামতের দিন সাত শ্রেণীর ব্যক্তিকে আরশের নীচে ছায়া দান করা হবে। তাদের মধ্যে এক প্রকার হচ্ছে এমন ব্যক্তি, যার অন্তর মসজিদের সাথে যুক্ত থাকে। উক্ত হাদীসের ব্যাখ্যায় হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-.وتخرج خصلة ملازمة المسجد؛ لأن صلاة المرأة في بيتها أفضل من المسجدতবে এ ফযীলত মহিলাদের জন্য নয়।

কারণ তাদের জন্য মসজিদের চেয়ে ঘরে নামায আদায় করা উত্তম। (ফাতহুল বারী ২/১৪৭)।বলাবাহুল্য, এ বিধান হচ্ছে স্বাভাবিক ও সাধারণ অবস্থায় প্রযোজ্য। তবে কেউ যদি প্রয়োজনে বাহিরে যান, তিনি কাযা না করে যেখানেই সুযোগ হয় সেখানে আদায় করবেন।

এ জন্য গাড়ি বা রেল স্টেশনে, হাসপাতালে ও রাস্তার পাশে মসজিদগুলোতে মহিলাদের অযু-নামাযের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা দরকার।

– সাঈদ আহমদ, সিনিয়র শিক্ষক, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।