Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার (৩)

ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার (৩)

।। মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী ।।

[পূর্ব প্রকাশিতের পর]

পিতা-মাতার সাথে কথা বলার ক্ষেত্রেও সন্তানকে অত্যন্ত আদবের সাথে নম্র স্বরে কথা বলতে হবে। হযরত সাঈদ ইব্নুল মুসাইয়াব (রাযি.) বলেন, কথা বলার পদ্ধতি এমন হবে, যেমন কোন গোলাম তার রূঢ় স্বভাব সম্পন্ন প্রভুর সাথে কথা বলে। আর তাদের সামনে সন্তান নিজেকে অত্যন্ত অক্ষম-হেয় করে পেশ করবে আর তা হবে নম্রতা-ভদ্রতা, আন্তরিক মমতা ও ভালবাসার ভিত্তিতে। তারপরও সন্তানের দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না, মহান আল্লাহর নির্দেশ হল হে সন্তান! তুমি তোমার পিতা-মাতার জন্য এভাবে দোয়া কর! “রাব্বিরহাম হুমা কামা রাব্বায়ানী সাগীরা” হে পালনকর্তা প্রভু! তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশব কালে লালন-পালন করেছে।

প্রিয় পাঠক! একটু ভেবে দেখুন! আল্লাহ রাব্বুল আলামীন পিতা-মাতার খেদমত, তাদের সেবা, তাদের প্রতি ভালবাসা-সম্মান ইত্যাদি যেসব আদর্শের ব্যাপারে আমাদের আদেশ দিয়েছেন, তা থেকে আমরা আজ কতদূরে অবস্থান করছি। সত্যিই কি আমরা তাদের সামনে সম্পূর্ণভাবে নিজেকে পেশ করতে পেরেছি? অথবা কতটুকু করতে পেরেছি তা ভেবে দেখার দায়িত্ব আমাদের সবার।

রাসূলুল্লাহ (সা.) স্পষ্ট করে বলে দিয়েছেন, পিতা-মাতার অবাধ্যতা কবীরা গুনাহ্সমহের অন্যতম। হযরত আব্দুল্লাহ ইব্নে আমর (রাযি.) বলেন, এক বেদুঈন এসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলল, ইয়া রাসূলাল্লাহ্! কবীরা গুনাহ্সমূহ কি? তিনি ইরশাদ করেন, আল্লাহর সাথে শরীক করা। বেদুঈন বলল, অতঃপর কি? তিনি ইরশাদ করেন, অতঃপর পিতা-মাতার সাথে নাফরমানী করা। বেদুঈন বলল, অতঃপর কি? তিনি ইরশাদ করেন, অতঃপর মিথ্যা শপথ করা। (ইব্নে জারীর তাফ্সীরে তাবারীর ৫ম খন্ড ৪২ পৃষ্ঠায় হাদীসটি সংকলন করেছেন)।

আমাদের দেশে এমনিতেই শিক্ষার হার অতি নিম্নে। কাজেই যাদের শিক্ষা-দীক্ষা নেই তাদের কথা না হয় বাদই দিলাম। যেহেতু মহান আল্লাহর আদেশ নিষেধ সম্পর্কে ওরা অনেকাংশেই অজ্ঞ। কিন্তু আমরা যারা জ্ঞানার্জন করেছি তাদের কয়জনকেই বা আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে এসব জ্ঞান দেওয়া হয়েছে?

প্রথম কিস্তি পড়ুন- ‘ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার’

দ্বিতীয় কিস্তি পড়ুন- ‘ইসলামে পিতা-মাতার হক বা অধিকার-২’

মহান আল্লাহর এসব আদেশ-উপদেশ তো বাংলাদেশের পাঠ্য পুস্তক তথা সিলেবাসের অন্তর্ভুক্তও করা যাবে না। যেহেতু আমাদের দেশের শিক্ষাজীবি-বুদ্ধিজীবি (?)দের দৃষ্টিতে এগুলো হল ধর্মীয় ব্যাপার। ওয়াজ-নসীহতে, মাদ্রাসা-মসজিদেই শুধুমাত্র এগুলো আলোচনা হতে পারে। স্কুল-কলেজ বা ইউনিভার্সিটিতে নয়। যৎসামান্য যাই আছে, তাও মনে হয় যেন অত্যন্ত অপারগ হয়ে বড়দের প্রতি সম্মান প্রদর্শনের শিরোনামে নামমাত্র দু’একটি পাঠ্য সিলেবাসের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যদ্দরুণ আজ শিক্ষিত অশিক্ষিত উভয় পরিবারের পারিবারিক আচার-আচরণে উল্লেখ্যযোগ্য কোন ব্যবধান পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এ বাস্তবতাকে অস্বীকার করার মত কোন কৈফিয়ত আছে কি?

মহান আল্লাহ তাআলার কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি এ জন্য যে, তিনি তাঁর অশেষ কৃপা ও অনুগ্রহে আওয়ামী দুঃশাসনের পতন ঘটিয়ে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শেখ মুজিব কর্তৃক গঠিত রামপন্থী দাদাবাবুদের দ্বারা তা’লীম প্রাপ্ত ড. কুদরতে খোদা শিক্ষা কমিশন বা সামছুর রহ্মান শিক্ষা কমিশনের মত জঘন্য ও দ্বীন-ধর্ম বিবর্জিত শিক্ষা কমিশন বাস্তবায়ন থেকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থা আপতত মুক্তি পেয়েছে। কারণ, এ শিক্ষা কমিশন যদি বিগত সরকার বাস্তবায়ন করে নিতে পারত, তাহলে সেই দিন হয়ত বেশী দূরে ছিল না যেদিন দেখা যেত যে, আমাদের মুসলিম সমাজে আর পৌত্তলিক ধুতিওয়ালাদের চাল-চলনে, আচার-আচরণে কোন ব্যবধান নেই।

তবে বর্তমান জোট সরকারকে ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থা অবশ্যই ইসলামী সভ্যতা, কৃষ্টি-কালচার প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত নয়। সুতরাং কালবিলম্ব না করে যত দ্র€ত সম্ভব ইসলামী শিক্ষাবিদ, চিন্তাবিদগণের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো উচিত। যেহেতু শুধুমাত্র আইন প্রণয়নের মাধ্যমেই সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি তথা সমাজ ও রাষ্ট্র বিরোধী কার্যক্রম বন্ধ করা সম্ভব নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত না দেশের জনগণকে আদর্শ ইসলামী শিক্ষার মাধ্যমে মানসিক দিক দিয়ে তৈরী করা হবে।

বিজ্ঞ পাঠক সমীপে আমার জিজ্ঞাসা, বলুন তো! পিতা-মাতার সাথে সৎ ও সদয় ব্যবহার কি শুধুই ধর্মীয় ব্যাপার? আদর্শ পরিবার, সুশীল-সৃজনশীল সমাজ বিনির্মাণে পিতা-মাতার সাথে সদ্ব্যবহার এক বিরাট পদক্ষেপ নয় কি? জানি না বাংলাদেশের জনগণ ফিরআউনী শিক্ষানীতির কবল থেকে কবে রক্ষা পাবে? কবে আমাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।

অন্যদিকে আজ যারা মানবাধিকারের ঝুড়ি নিয়ে বেড়াচ্ছেন, তারা অত্যন্ত সুকৌশলে পাশ্চাত্য দেশসমহের মত মুসলিম দেশসমূহেও বুড়ো-বুড়ীদের জন্য আরামদায়ক জীবন-যাপনের নামে বিশেষ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে। এ পর্যন্ত বেশ কিছু পাশ্চাত্য দেশে তা প্রতিষ্ঠাও লাভ করেছে। সমাজের বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের জন্য উত্তম জীবনোপকরণের সুব্যবস্থা সম্পন্ন বিল্ডিং তৈরী করে সন্তান-সন্ততির চোখের আড়ালে শুধুমাত্র সেবক-সেবিকা দ্বারা যাবতীয় সেবা-যত্নের ব্যবস্থা বাহ্যিক দৃষ্টিতে সত্যিই মনোমুগদ্ধকর ও প্রশংসনীয়। কিন্তু এ ব্যবস্থা মহান আল্লাহর বিধান ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের শিক্ষার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। পবিত্র কুরআনে সন্তানের প্রতি ঘোষণা এসেছে, পিতা-মাতার সাথে উত্তম আচরণ করবে, তোমার কাছে তাদের একজন বা দু’জনই যদি বার্ধক্যে পৌঁছে যায় তাহলে তখন তাদের মনে কষ্ট হয় এমন কথা বলবে না। তাদের ভর্ৎসনা ও তিরস্কার করবে না, বরং তাদের সাথে সম্মানজনক কথা বলবে। তাদের খেদমতে দরদ মাখা বাহু বিছিয়ে দিবে।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, তিন শ্রেণীর লোক কখনোই জান্নাতে যাবে না, তারা হচ্ছে- (১) পিতা-মাতার সাথে সম্পর্কচ্ছেদকারী, (২) দাইয়ছ (অর্থাৎ যে পুরুষ তার স্ত্রী দ্বারা খারাপ কাজ করায়), (৩) পুরুষালী চাল-চলন গ্রহণকারী নারী। (বায্যার, হাকেম, নাসাঈ)।

ইসলাম সর্বদাই প্রেম-প্রীতি ভালবাসায় পরিপূর্ণ পরিবার প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সন্তান তার পিতা-মাতার সেবা-যত্ন করবে, এ অধিকার ইসলাম পিতা-মাতাকে প্রদান করেছে। কিন্তু মানবাধিকারবাদীদের পিতা-মাতার সেই অধিকার খর্ব করে মানবাধিকারের দাবী নিতান্তই হাস্যকর ব্যাপার। তবে হাঁ, যে সমাজ পিতৃ পরিচয়হীন সন্তানে পরিপূর্ণ, শুধুমাত্র সেই সমাজেই এমন ব্যবস্থা কার্যকর হতে পারে। এই সমাজে নয়, যেই সমাজের সন্তান পিতা-মাতার জন্য প্রার্থনা করে- প্রভু হে! আমার পিতা-মাতাকে রহম কর, যেমন করে তারা আমাকে ছোট অবস্থায় লালন-পালন করেছেন। মহান আল্লাহ তো বৃদ্ধ পিতা-মাতার সেবা-যত্নের বিনিময়ে সন্তানকে দুনিয়ার জীবনে সুখ-স্বাচ্ছন্দ ও পরকালে জান্নাতের মত উত্তম পুরস্কারের ঘোষণা করেছেন। সুতরাং এই মানবাধিকারবাদীদের বলতে চাই, যে সমাজের সন্তানেরা পিতা-মাতার মায়া-মমতা, স্নেহ-ভালবাসা থেকে বঞ্চিত হয়ে ক্লাব-রেস্তোঁরা-বার আর ডিস্কো নাচের হল রুমে যৌবনকাল অতিবাহিত করছে, সেই সমাজই আপনাদের জন্য উপযুক্ত স্থান, অবশ্যই বাংলাদেশের মুসলিম সমাজ নয়।

[চলবে]

  • মাওলানা মুহাম্মদ ওমর কাসেমী, উস্তাদুল হাদীস ও ওয়াল ফিক্বহ- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।