Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন রাসূল (সা.)এর যুগে কুরআন সংকলন ও ওহীর লিখন পদ্ধতি যেমন ছিল

রাসূল (সা.)এর যুগে কুরআন সংকলন ও ওহীর লিখন পদ্ধতি যেমন ছিল

।। মুফতি আবু সাঈদ ।।

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন, তাওরাত-ইনজিল থেকে ব্যতিক্রমভাবে অবতীর্ণ হয়েছে। যার সূচনা-সমাপ্তির পরিধি ছিল নববী জীবনের প্রায় দুই যুগ সময়কালব্যাপী। পরিবেশ পরিস্থিতির চাহিদাসহ উভয় জাহানের সকল কল্যাণ-বিধান উল্লেখ করে এ গ্রন্থ’ অবতীর্ণ করা হয়।

কিন্তু সেই পরিবেশে কুরআনকে লেখার আকৃতিতে সংকলন করে রাখা অসম্ভব ছিল। কারণ, তখনকার সময় লেখার ব্যবস্থাপনা ছিল বড় দুর্বল। ছাপাখানা ইত্যাদির তো কোন অস্তিত্বই ছিল না। তাই ইসলামের জন্মলগ্ন থেকে আল্লাহ তা‘আলা কুরআন সংরক্ষণের পাত্র বানান মানুষের স্মৃতিশক্তিকে। এছাড়াও সাহাবাগণ কুরআনের অংশকে লিখে রাখার জন্য হাড্ডি, চামড়া, পাথর ইত্যাদি ব্যবহার করতেন।

ওহী অবতরণের সূচনাকালে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কুরআনের শব্দমালাকে পূর্ণ আয়ত্ত করে রাখতে পুনরাবৃত্তি করতে থাকতেন। যাতে ভুলে যাওয়ার কষ্ট থেকে বাঁচতে পারেন। সে প্রেক্ষিতে সূরা ‘কিয়ামা’র ১৬ ও ১৭ নং আয়াত অবতীর্ণ হয়।

لَا تُحَرِّكْ بِهِ لِسَانَكَ لِتَعْجَلَ بِهِ، إِنَّ عَلَيْنَا جَمْعَهُ وَقُرْآنَهُ

“তাড়াতাড়ি ওহী আয়ত্ত করার জন্য আপনি আপনার জিহ্বা তাঁর সাথে দ্রুত সঞ্চালন করবেন না। তা সংরক্ষণ ও পাঠ করাবার দায়িত্ব আমারই।”

এখানে আল্লাহ তা‘আলা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সান্ত¦নার বাণী শুনাচ্ছেন। ওহী অবতরণের সাথে সাথেই কুরআনকে আয়ত্ত করে রাখতে শব্দমালাকে এভাবে পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই। মহান প্রতিপালক আপনার মাঝে এমন স্মৃতিশক্তির প্রকাশ ঘটাবেন, আপনি কখনই ভুলবেন না। বিষয়টির বাস্তব বহিঃপ্রকাশ এমনই ঘটেছিল।
ওহী অবতীর্ণ হওয়ার সাথে সাথেই যেন তাঁর স্মৃতিশক্তিকে এক অদৃশ্যশক্তি আকর্ষণ করত। এভাবেই নবী মহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সীনা মুবারক কুরআনে কারীমের সবচেয়ে বড় সংরক্ষণ স্থান ছিল। যাতে ক্ষুদ্রতম ত্রুটি ও অস্পষ্টতার আশঙ্কা ছিল অসম্ভব।

এতদ্বসত্ত্বেও বছরে বছরে রমযান আসতেই হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামকে কুরআন শোনানোর ব্যস্ততায় লিপ্ত থাকতেন। যে বৎসর মহান প্রভুর সান্নিধ্য লাভ করতে চিরবিদায়ের প্রস্তুতি গ্রহণ করছিলেন, সে বৎসর হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালামের সাথে দুইবার কুরআন শোনাশুনি করেছিলেন।

নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আপন সাহাবাগণকে মহাগ্রন্থের শুধু অর্থ ও তাৎপর্যই শিক্ষা দিতেন না, বরং তাদেরকে তার শব্দমালাও মুখস্থ করিয়ে দিতেন।

সাহাবাদের কুরআনের প্রতি আগ্রহ উদ্দীপনা এতটাই প্রবল ছিল যে, পরস্পরে প্রতিযোগিতা করে আগে বাড়ার সুযোগ খুঁজতে থাকতেন। বড় আশ্চর্যের বিষয় হল, কতিপয় নারী আপন স্বামী থেকে কুরআন শিখে নেওয়াকেই তাঁর বিয়ের মহর হিসেবে গ্রহণ করতেন।

আসলে কুরআনের ভালোবাসা ও তাকে শেখার আগ্রহ তাদেরকে এতটাই আপ্লুত করেছিল যে, কুরআনের আলোতে নিজেদের জীবনকে আলোকিত করতে এমনিভাবে সবসময় পরস্পরে প্রতিযোগিতা করতে থাকতেন।

তাই স্বল্প সময়ের ব্যবধানে জেগে উঠল মহাগ্রন্থের জ্ঞানতাপস সাহাবাদের এক বড় সম্প্রদায়। তাঁদের মাঝে হরযত আবু বকর রাযি., হযরত উমর রাযি., হযরত উসমান রাযি. এবং হযরত আলী রাযি., হযরত তালহা রাযি., হযরত সা’দ ইবনে আবি ওয়াক্কাস রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ রাযি., হযরত হুজাইফা ইবনুল ইয়ামান রাযি., হযরত সালেম রাযি., হযরত আবু হুরাইরা রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাযি., হযরত আমর ইবনে আস রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর রাযি., হযরত মুয়াবিয়া রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাযি., হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে সায়েব রাযি., হযরত আয়েশা রাযি., হযরত হাফসা রাযি. এবং হযরত উম্মে সালমা রাযি. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

আরও পড়তে পারেন-

মোটকথা, ইসলামের ঊষালগ্নে কুরআন মুখস্থের ব্যাপক পরিবেশ গড়ে উঠেছিল এবং তা মুখস্থ করার প্রতি সকলকে উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছিল। সে সময়কার প্রেক্ষাপটের এটাই দাবি ছিল। কারণ, তখনকার সময় কোন প্রকাশনা ও ছাপাখানা ছিল না। এ জন্য শুধু লেখার ওপর ভরসা করে বসে থাকলে কুরআনের ব্যাপকতা সীমাবদ্ধ হয়ে যেতো। ভাটা পড়ত তার যথাযথ সংরক্ষণে।

মহান আল্লাহ তা‘আলা আরব সম্প্রদায়কে এমন ধীশক্তিসম্পন্ন করে পৃথিবীতে পাঠালেন, যা অতুলনীয়। তারা সে যুগের ভাষাজ্ঞানীদের মগজ নিংড়ানো শত সহ¯্র কাব্য ও রচনা স্মৃতিতে ধারণ করে রাখার মতো স্বভাবজাত মানুষ ছিলেন।

বড় বিস্ময়ের ব্যাপার হলো, রোদে পোড়া পল্লীগাঁয়ের সরলমনা সাধারণ মানুষগুলো পর্যন্ত তাদের আপন পরের ঘোড়ার নাম, জাত, বংশ তালিকাসহ স্মৃতির পাতায় অংকন করে রাখত খুব সহজেই!

মহামহিমাময় সত্তা সেই জাতির দ্বারা ওহীর বিদ্যা সংরক্ষণ করে সৃষ্টির মাঝে তাঁর মহান প্রজ্ঞার প্রকাশ ঘটান। সে আরবের রন্দ্রে রন্দ্রে অনুপ্রবেশ ঘটেছিল আল কুরআনের নূরের জ্যোতি ও সত্যশক্তির রশ্মি।

রাসূল (সা.)এর যুগে ওহীর লিখন পদ্ধতি

নববী যুগে শত প্রতিকূলতার মাঝেও আল কুরআনকে আত্মস্থ করার সাথে সাথে তার প্রতিটি অংশকে দোয়াতের কালিতে লিখে রাখার প্রয়োজন ছিল। তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সেই প্রস্তুতিতে বিশেষ দৃষ্টি দেন।

হযরত যায়েদ বিন সাবেত রাযি. বলেন- আমি প্রিয় নবীর ওপর অবতীর্ণ ওহীর লিপিকার ছিলাম। যখন নবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর ওহী প্রেরিত হতো, তিনি তুলনাধিক ঘর্মাক্ত হতেন। তাঁর পবিত্র দেহের ঘাম মুক্তা-দানার ন্যায় চমকাতে থাকত। যখন সে প্রেক্ষাপটের অবসান ঘটত, আমি কোন শুষ্ক হাড্ডি বা লেখার যোগ্য অন্য বস্তু নিয়ে তাঁর সমীপে উপস্থিত হতাম।

রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, আমি লিখতে থাকতাম। সমাপ্তিতে মনে হতো, সেই লিপির ভারে আমি প্রতিবন্ধী হয়ে পড়েছি। আমার পা ভেঙ্গে পড়েছে বা অবশ হয়ে গেছে। চলার স্বকীয়তা চিরতরে বিদায় নিয়েছে।

সারকথা, যখন অবসর হতাম, প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলতেন, (যায়েদ!) ‘পড়ো’। আমি সেই লিখিত টুকরোটি হাতে নিয়ে পড়ে শুনাতাম। তাতে কোন ত্রুটি দেখা দিলে তিনি তৎক্ষণাৎ সংশোধন করে দিতেন। তারপর জনসম্মুখে উপস্থাপন করতেন।

ওহী লেখায় হযরত যায়েদ বিন সাবেত তো ছিলেনই। সেই মহান কাজের গুরু দায়িত্ব আঞ্জাম দিতে আরো যে সকল আদর্শ মনীষীগণ সদা আত্মনিমগ্ন থাকতেন, তাঁদের মাঝে ইসলামের সত্যনিষ্ঠ চার খলিফা: হযরত আবু বকর সিদ্দীক রাযি., হযরত উমর রাযি., হযরত উসমান ইবনে আফ্ফান রাযি., হযরত আলী রাযি., হযরত উবাই ইবনে কা’ব রাযি., হযরত যোবায়ের ইবনে আওয়াম রাযি., হযরত মুয়াবিয়া রাযি., হযরত মুগীরা বিন শু’বা রাযি., হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদ রাযি., হযরত সাবেত বিন কায়েস রাযি. এবং হযরত আবান ইবনে সাঈদ রাযি. বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

উল্লিখিত সাহাবায়ে কেরাম ছাড়াও আরো যাঁদের নাম পাওয়া যায়, যেমনÑ হযরত খালেদ ইবনে সাঈদ, হযরত হানযালা বিন রবী’, হযরত মুয়াইকিব বিন আবি ফাতেমা, হযরত আব্দুল্লাহ আজহারী, হযরত শুরাহবিল বিন হাসানা, হযরত আব্দুল্লাহ বিন রওয়াহা, হযরত আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ, মুয়ায বিন জাবাল, হযরত আবু যায়েদ (রাযিয়াল্লাহু আনহুম আজমাঈন)।

হযরত উসমান রাযি. বলেন- “মহাগ্রন্থ’ আল কুরআনের অংশ বিশেষ যখন অবতীর্ণ হতো, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তখন ইলমে ওহীর লিপিকারদের ডেকে নির্দেশ দিতেনÑ এই অংশকে অমুক সূরার অমুক আয়াতের পরে লিপিবদ্ধ করে নাও।”

এ পদ্ধতি অনুসারে নবুওয়াতের সেই সোনালী যুগে বিক্ষিপ্ত আকারে এক কুরআনী পা-ুলিপি প্রস্তুত হয়েছিল, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা নিজ তত্ত্বাবধানে করিয়ে ছিলেন। সাথে সাথে অনেক সাহাবা (রাযিআল্লাহু আনহুম) নিজেদের মুখস্থের সুবিধার্থে কুরআনের কিছু আয়াত লিখে নিজেদের কাছে রাখতেন।

ইসলামের প্রারম্ভকালে উক্ত পদ্ধতির বেশ প্রচলনও ছিল। যেমন- হযরত উমর ইবনুল খাত্তাব রাযি. ইসলামের সুশীতল ছায়া তলে আশ্রয় গ্রহণের পূর্বে তাঁর বোন ও ভগ্নিপতির নিকট এক ক্ষুদ্র গ্রন্থে কিছু আয়াত লেখা ছিল।

– মুফতি আবু সাঈদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। খতীব- বারীয়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।