Home ইসলাম অপরাধ দমনে কোরআন যা বলেছে

অপরাধ দমনে কোরআন যা বলেছে

ড. ইউসুফ আল কারজাভি: ইসলাম শুধু ধর্মবিধান ও আইনের নাম নয়। ইসলাম এমন বিশ্বাস, যা স্রষ্টার অস্তিত্বের বিশদ ব্যাখ্যা দেয়। ইসলাম হলো ইবাদত, যা আত্মার প্রতিপালন করে। ইসলাম এমন চরিত্র, যা অন্তর পরিশুদ্ধ করে। ইসলাম এমন বোধ, যা দৃষ্টিভঙ্গি সঠিক করে। ইসলাম এমন মূল্যবোধ, যা মানবসমাজে সাম্য প্রতিষ্ঠা করে। ইসলাম এমন শিষ্টাচার, যা জীবনকে সুন্দর করে।

বিধি-বিধানসংক্রান্ত কোরআনের আয়াত সংখ্যা খুব বেশি নয়। কোরআনের বেশির ভাগ আয়াতে বিশ্বাস ও অন্তরের অবস্থা, অঙ্গীকার ও হুঁশিয়ারির কথাই বলা হয়েছে। অন্য আইনের উৎসর মতো কোরআন নিছক আইন নিয়ে আলোচনা করেনি; বরং কোরআন একই সঙ্গে আইন, আহ্বান, ব্যাখ্যা, সংশোধন, প্রতিপালন, আশাবাদ ও সতর্কীকরণের উৎস।

দণ্ডবিধিসংক্রান্ত কোরআনের একটি আয়াত : দণ্ডবিধিসংক্রান্ত কোরআনের একটি আয়াত পাঠ করে দেখুন। আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘পুরুষ চোর ও নারী চোর, তাদের হাত কেটে দাও—এটা তাদের কৃতকর্মের ফল এবং আল্লাহর পক্ষ থেকে আদর্শ দণ্ড। আল্লাহ পরাক্রমশালী, প্রজ্ঞাময়। কিন্তু সীমালঙ্ঘন করার পর কেউ তাওবা করলে ও নিজেকে সংশোধন করলে অবশ্যই আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন।’ (সুরা মায়িদা, আয়াত : ৩৮-৪০)

শাস্তির পাশাপাশি সুসংবাদ ও সতর্কতা : এখানে আমরা কঠোর শাস্তির সঙ্গে সুসংবাদ ও হুঁশিয়ারি খুঁজে পাই। যার মাধ্যমে বান্দাকে ভয় দেখানো হয়েছে, আবার তাকে আশাবাদী হওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছে। তাকে উৎসাহিত করা হয়েছে অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর দিকে ফিরে আসতে। তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে আল্লাহর দয়া ও অনুগ্রহের কথা।

ইসলামী আইনের সার্বজনীনতা : উল্লিখিত তিন আয়াতে আল্লাহর গুণবাচক নামের তাৎপর্য নিম্নরূপ—আল্লাহ পরাক্রমশালী যখন তিনি আদেশ ও নিষেধ করেন, তিনি প্রজ্ঞাময় বিধান প্রণয়নের ক্ষেত্রে, ক্ষমাশীল ও দয়ালু যে অনুতপ্ত হয় এবং নিজেকে সংশোধন করে তার জন্য। সৃষ্টিজগতের সার্বভৌমত্ব ও মালিকানা আল্লাহর জন্য, তিনি সর্ববিষয়ে ক্ষমতাবান। এটাই কোরআনের আইন প্রণয়নের রীতি। সুন্নাহও অনুরূপ। কেননা শুধু আইন বাস্তবায়নের মাধ্যমে আদর্শ ইসলামী সমাজ গঠন করা সম্ভব নয়। তার জন্য আইন-কানুনের পাশাপাশি আরো দুটি বিষয় প্রয়োজন। তা হলো—এক. দাওয়াত ও সচেতনতা, দুই. শিক্ষা ও দীক্ষা। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এ বিষয় দুটি আইন-কানুনেরও আগে প্রয়োজন হয়।

আরও পড়তে পারেন-

এ জন্যই মক্কায় ইসলামের যাত্রা শুরু হয়েছিল দাওয়াত ও শিক্ষার মাধ্যমে। অতঃপর মদিনায় হিজরতের পর আইন প্রণীত হয়েছিল, প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। শিক্ষা-দীক্ষার সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার সম্পর্ক আত্মা ও দেহের মতো। মানুষের মানসিক পরিবর্তন ছাড়া শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত কঠিন। যেসব জিনিসের দ্বারা মানুষের আত্মিক ও মানসিক পরিবর্তন আসে, ঈমান তার মধ্যে সর্বোর্ধ্বে। ঈমান গ্রহণের মাধ্যমে মানুষ ভিন্ন মানুষে পরিণত হয়। কেননা ঈমান মানুষকে জীবনের লক্ষ্য এবং তা অর্জনের করণীয় ও বর্জনীয় বাতলে দেয়। যার ভিত্তিতে সে ইহকাল ও পরকালে প্রতিদান লাভ করে।

পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা ইসলাম : ইসলাম এক অবিভাজ্য মৌল। সুতরাং আমরা অপরাধের বিরুদ্ধে লড়াই করতে চাই, তবে শুধু ইসলামী দণ্ড প্রয়োগই যথেষ্ট নয়; বরং দণ্ডবিধি সমাজ সংশোধনের সর্বশেষ এবং চূড়ান্ত ধাপ মাত্র। শাস্তি সে তো সীমালঙ্ঘনকারীদের জন্য। সমাজে সীমা লঙ্ঘনকারীদের সংখ্যা বেশি নয়। ইসলাম শুধু সীমা লঙ্ঘনকারীদের সংশোধনের জন্য আসেনি; বরং এমন সমাজ বিনির্মাণের জন্য এসেছে, যেন মানুষ সীমা লঙ্ঘনের পথে পা না বাড়ায়। ইসলামের দৃষ্টিতে অপরাধ দমনে শাস্তি প্রয়োগই একমাত্র সমাধান নয়; বরং অপরাধ প্রবণতা ও তার পথগুলো বন্ধ করাই মূল সমাধান। এককথায় রোগাক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা করার চেয়ে আত্মরক্ষাই উত্তম।

মানবসমাজের জঘন্য অপরাধ ব্যভিচারের শাস্তি বিষয়ে সুরা নূরে একটি আয়াত আছে। তা হলো—‘ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী—তাদের প্রত্যেককে এক শ কশাঘাত করবে। আল্লাহর বিধান কার্যকর করতে তাদের প্রতি দয়া যেন তোমাদের প্রভাবান্বিত না করে, যদি তোমরা আল্লাহতে এবং পরকালে বিশ্বাসী হও; মুমিনদের একটি দল যেন তাদের শাস্তি প্রত্যক্ষ করে।’ (সুরা নূর, আয়াত : ২)

কিন্তু এই সুরায় এমন একাধিক আয়াত আছে, যা মানুষকে এই অপরাধ থেকে আত্মরক্ষা করতে শেখায়। যেমন—

১. অশ্লীলতা রোধে : ইরশাদ হয়েছে, ‘যারা মুমিনদের মধ্যে অশ্লীলতার প্রসার কামনা করে তাদের জন্য আছে দুনিয়া ও আখিরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি এবং আল্লাহ জানেন, তোমরা জানো না।’ (সুরা নূর, আয়াত : ১৯)

২. পারিবারিক গোপনীয়তা রক্ষায় : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমরা নিজেদের ঘরে ছাড়া অন্য কারো ঘরে ঘরবাসীদের অনুমতি না নিয়ে এবং তাদের সালাম না দিয়ে প্রবেশ কোরো না। এটাই তোমাদের জন্য শ্রেয়, যাতে তোমরা উপদেশ গ্রহণ করো।’ (সুরা নূর, আয়াত : ২৭)

৩. ব্যক্তিগত গোপনীয়তা রক্ষা : ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা, তোমাদের মালিকানাধীন দাস-দাসিরা এবং তোমাদের মধ্যে যারা সাবালক হয়নি তারা যেন তোমাদের ঘরে প্রবেশ করতে তিন সময় অনুমতি গ্রহণ করে : ফজরের নামাজের আগে, দুপুরে যখন তোমরা তোমাদের পোশাক খুলে রাখো, এশার নামাজের পর; এই তিন সময় তোমাদের গোপনীয়তার সময়।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৫৮)

৪. অন্তরের পবিত্রতা রক্ষা : ইরশাদ হয়েছে, ‘মুমিনদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে এবং তাদের লজ্জাস্থান হেফাজত করে। এটাই তাদের জন্য উত্তম। তারা যা করে নিশ্চয়ই আল্লাহ সে বিষয়ে সম্যক অবহিত।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৩০)

৫. ব্যভিচারের প্রলোভন রোধ : ইরশাদ হয়েছে, ‘আর মুমিন নারীদের বলো, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে সংযত করে ও তাদের লজ্জাস্থান সংরক্ষণ করে; তারা যেন যা সাধারণত প্রকাশ থাকে তা ছাড়া তাদের আবরণ প্রদর্শন না করে, তাদের গ্রীবা ও বক্ষদেশ যেন মাথার কাপড় দ্বারা আবৃত করে।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৩১)

৬. চারিত্রিক দুর্বলতা রোধ : ইরশাদ হয়েছে, ‘তারা যেন তাদের গোপন আভরণ প্রকাশের উদ্দেশ্যে সজোরে পদক্ষেপ না করে। হে মুমিনরা, তোমরা সবাই আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন করো, যাতে তোমরা সফলকাম হতে পারো।’ (সুরা নূর, আয়াত : ৩১)

৭. পবিত্র জীবনের সুযোগ লাভ : ইরশাদ হয়েছে, “তোমাদের মধ্যে যারা ‘আয়্যিম’ (সঙ্গীহীন নারী-পুরুষ) তাদের বিয়ে সম্পাদন করো এবং তোমাদের দাস-দাসীদের মধ্যে যারা সৎ তাদেরও। তারা অভাবগ্রস্ত হলে আল্লাহ নিজ অনুগ্রহে তাদের অভাবমুক্ত করে দেবেন। আল্লাহ প্রাচুর্যময়, সর্বজ্ঞ।” (সুরা নূর, আয়াত : ৩২)

আল্লাহ হারাম অবলম্বন পরিহার করার নির্দেশ প্রদানের পাশাপাশি হালাল অবলম্বন গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন। কেননা মানবপ্রকৃতি হলো যখন বৈধ রাস্তা বন্ধ হয়ে যায় তখন সে অবৈধ পথে অগ্রসর হয়। সুতরাং আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের উচিত একই সঙ্গে অবৈধ পন্থা রোধ করা এবং বৈধ পন্থা উন্মুক্ত করে দেওয়া।

‘মালামিহুল মুজতামায়িল ইসলামী আল্লাজি নানশুদুহু’ গ্রন্থ থেকে মো. আবদুল মজিদ মোল্লার ভাষান্তর।

উম্মাহ২৪ডটকম: আইএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।