Home ইতিহাস ও জীবনী আপোষহীন সিপাহসালার আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী’র বিদায়

আপোষহীন সিপাহসালার আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী’র বিদায়

।। মুহাম্মাদ হাবীব আনওয়ার ।।

সময়টা তখন ২০১৩ ইংরেজি। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের নামে হঠাৎই ইসলাম নির্মূলবাদী নাস্তিক চক্রের আস্ফালন। ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা বন্ধ করে সপ্তাহের পরে সপ্তাহ অবরোধ করে অশ্লীলতার বীজ বপন করে চলছিল। সেই সাথে আল্লাহ, নবী, ধর্ম ও উম্মাহাতুল মুমিন (রাযি.)দের নিয়ে অকাট্য ভাষায় ব্যঙ্গ করা শুরু করে। শহরের প্রধান সড়কগুলোতে নাস্তিকদের আস্ফালনে মুসলিম উম্মাহ আহত হয়। হয় ব্যথিত। আল্লাহ ও তার রাসূলকে নিয়ে কটূক্তি করা হচ্ছে। সবাই পেরেশান। কিংকর্তব্যবিমূঢ়।

ঠিক তখনি শায়খুল ইসলাম আল্লামা আহমদ শফী (রহ.)এর হাত ধরে শাহাদাতের তামান্নায় রাস্তায় নেমে এলেন। বাংলার এক কোণ থেকে গর্জে উঠলেন। ৬ এপ্রিল ঐতিহাসিক লংমার্চ করলেন। যা ছিল ইতিহাসে বিরল। লাখো মানুষ এভাবে সাড়া দিবে, কেউ কল্পনাও করেনি। সেদিন হাটহাজারী ফিরে এলেন আবার পুণরায় আসবেন বলে। ৫ই মে ঢাকা অবরোধ করলেন। নিরীহ মুসুল্লিরা সারাদিনের ক্লান্ত বদনে শাপলার চত্বরে জড়ো হলেন।

রাত ২টা। কেউ ইবাদতে, কেউ ঘুমে। রাতের অন্ধকারে বাতি বন্ধ করে নির্মমভাবে নবী প্রেমিকদের হামলা করা হলো। শহীদ করা হলো। অনেকেই নিরাপদে ফিরলেও ফিরলেন না আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী। মতিঝিল থেকে গ্রেফতার হলেন। দীর্ঘ ২৯ দিন নির্মমভাবে নির্যাতন করা হলো। মুমূর্ষু অবস্থায় তড়িঘড়ি মুক্তিও দেওয়া হলো। বাবুনগরী ফিরে এলেন, কিন্তু জীবনের স্বাভাবিকতা ফিরে পাননি। নির্যাতনের যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

উপমহাদেশের প্রখ্যাত এই হাদীস বিশারদ শায়খুল হাদীস আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী ১৯৫৩ সালে ৮ ই অক্টোবর  চট্টগ্রাম জেলার ফটিকছড়ি থানার স্বর্ণপ্রসবীনি গ্রাম বাবুনগরে জন্মগ্রহণ করেন।

হাটহাজারী মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতা সদস্য আল্লামা সূফি আজিজুর রহমান (রহ.)এর পরশ ও বরকতধন্য এই আলেম পরিবার সারাদেশে ধর্মীয় অনুরাগ, শিক্ষা -দীক্ষায় বেশ প্রসিদ্ধ। আল্লামা আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর শ্রদ্ধেয় পিতা ছিলেন উপমহাদেশের বিশিষ্ট হাদীস বিশারদ, মেশকাত শরীফের ব্যাখ্যাগ্রন্থ তানজিমুল আশতাত এর লেখক, হাটহাজারী মাদরাসার সাবেক মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল হাসান (রহ.)। তার মামা বর্তমান হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের প্রধান উপদেষ্টা ও ভারপ্রাপ্ত আমীর আল্লামা মুহিব্বুল্লাহ বাবুনগরী (হাফি.)। মোদ্দাকথা! পারিবারিক দিক দিয়ে আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন শীর্ষ আলেম ও বুযুর্গ খান্দানের সৌভাগ্যবান ব্যক্তি।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় বাবুনগর আজিজুল উলূম মাদরাসায়। এরপর মাধ্যমিক শিক্ষা হাটহাজারী মাদরাসায় সম্পন্ন করেন। অতঃপর উচ্চ শিক্ষার জন্য পাকিস্তানের করাচিতে প্রসিদ্ধ দীনি প্রতিষ্ঠান বিন্নুরি টাউন গমন করেন। সেখানে বিশ্ববরেণ্য মুহাদ্দিস আল্লামা ইউসুফ বিন্নুরী (রহ.)এর সহচার্যে থেকে হাদীসের উপরে পাণ্ডিত্য অর্জন করেন।

১৯৭৮ ইংরেজিতে দেশে ফিরে শিক্ষকতার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। কর্মজীবনের শুরুতেই নানার প্রতিষ্ঠিত বাবুনগর আজিজুল উলূম মাদরাসায়। এরপর শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর ডাকে সাড়া দিয়ে উপমহাদেশের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা নিকেতন দারুল উলুম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী মাদরাসায় মুহাদ্দিস পদে যোগদান করেন।

আরও পড়তে পারেন-

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ছিলেন ছাত্রবান্ধব শিক্ষক। ক্লাসের প্রতি ছিলেন যত্নবান। কখনো ক্লাস মিস দিতেন না। অসুস্থ অবস্থায়ও নিয়মিত ক্লাস করাতেন। ক্লাসে বলতেন, আমি পড়ানো শুরু করলে সুস্থতাবোধ করি।

আল্লামা বাবুনগরীর সাবলীল উপস্থাপনা, মধুময় বাক্যশৈলী ও সর্ববোধগম্য দরসের (পাঠদানের) ফলশ্রুতিতে স্বল্প সময়ে তিনি ছাত্রদের মন জয় করে সকলের নিকট হয়ে উঠেন একজন আদর্শ উস্তাদ। তাঁর পাঠদানের সুখ্যাতিতে মুগ্ধ হয়ে মজলিসে শূরা তাঁকে হাদীসের সর্বোচ্চ কিতাব সহীহ বুখারীর পাঠ দানের দায়িত্ব ও সহকারী পরিচালক পদে নিয়োগ দেন। শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী. এর মৃত্যুর পরে হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালকের দায়িত্বও গ্রহণ করেন। দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে মৃত্যু অবধি তাঁর মেধা, যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা দিয়ে দক্ষতার সাথে দরসে নিজামির বিভিন্ন কিতাবের পাঠদান ও মাদরাসার সার্বিক উন্নয়নে প্রশংসনীয় ভূমিকা পালন করেছেন।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) ছিলেন একজন আদর্শ, দক্ষ ও বিচক্ষণ আলেম। দাওয়াতের ময়দানে একজন দরদী দায়ী। সমাজসেবার ময়দানে ছিলেন জনদরদী সেবক।

তিনি ছিলেন প্রজ্ঞা সম্পূর্ণ আপোষহীন ও স্পষ্ট ভাষী। আপোষ শব্দ বলতে বাবুনগরীর অভিধানে কোন শব্দ ছিল না। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন মহল থেকে দামি ও মোটা অংকের মাধ্যমে হুজুরকে ভোলানোর চেষ্টা করা হলেও হুজুর কখনো আপোষ করেননি। হুজুর প্রায় সময়ই বলতেন, ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলবো, তবুও বাতিলের সাথে আপোষ করবো না। বাস্তব জীবনেও এর প্রতিফলন দেখিয়েছেন।

সর্বশেষ ২৬ মার্চের পরে যখন হাজার হাজার নেতাকর্মী গ্রেফতার ও নির্যাতনের শিকার হচ্ছিলো, তখন অনেকেই সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু আপোষহীন বাবুনগরী হেফাজতের কমিটি কৌশলগত কারণে কয়েক ঘন্টার জন্য বিলুপ্ত করেছেন, তবুও আপোষ করেননি। হাদিয়া গ্রহণেই ছিলেন সদা সতর্ক। যাচাই-বাছাই ছাড়া হাদিয়া গ্রহণ করতেন না। বিশেষ করে সরকারি চাকরিজীবিদের হাদিয়া গ্রহণে সতর্কতা করতেন।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রাহ.) সর্ববৃহৎ অরাজনৈতিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের আমির, হাটহাজারী মাদরাসার প্রধান শায়খুল হাদীস ও শিক্ষা পরিচালক, নূরানী তালিমুল কুরআন বোর্ড চট্টগ্রামের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব বিচক্ষণতার সাথে অত্যন্ত সুচারুরূপে পালনের পাশাপাশ সারাদেশে অসংখ্য মাদরাসা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেছেন।

গত ২ বছর খুব কাছ থেকে হুজুরকে দেখেছি। আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)এর সদা হাস্যোজ্জ্বল চেহারা, মনকাড়া মুচকি হাসিতে যে কারো মন কাড়তো। তাঁর মন মননে ছিল না কোন বিদ্বেষ। ছিল না কারো প্রতি আক্রোশ বা আক্রমণাত্মক আচরণ। প্রান্তিকতা ও হীনমন্যতার ঊর্ধ্বে ছিলেন তিনি। চিন্তার দৈন্যতা থেকে যোজন যোজন দূরে ছিল তাঁর অবস্থান। সত্যই আকাবীর ও আসলাফের বাস্তব নমুনা ছিলেন আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.)।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী রহ. প্রখর মেধা, তীক্ষ্ণ দৃষ্টি, সূক্ষ্ম চিন্তা ও বহু গুণে গুণান্বিত এক ব্যক্তি ছিলেন। তাঁর ধৈর্য্য, কর্মদক্ষতা এবং স্থিরতা  ছিল পাহাড়ের ন্যায়। পাহাড় যেমন তার আপন স্থানে অবিচল, তদ্রুপ তিনিও ধৈর্য্য ও নিজ কর্মে ছিলেন অটল। যার জ্বলন্ত প্রমাণ, তাঁর দ্বীনী খেদমতের সূচনা এবং শেষ পর্যন্ত বিভিন্ন প্রান্তিকতা ও চতুর্মুখী ষড়যন্ত্র সত্ত্বেও ধৈর্য্যের সাথে দ্বীনের খেদমতে অটল থাকা। যার নজির খুঁজে পাওয়া বিরল। তাঁর অনুপম আদর্শ ও হৃদয়ের স্বচ্ছতা, সততা পথহারা পথিকদের জন্য মাইল ফলক হয়ে থাকবে।

আল্লামা জুনায়েদ বাবুনগরী (রহ.) লেখালেখির ময়দানেও ছিলেন যোগ্য লেখক। তাঁর ক্ষুরধার লেখনির মাধ্যমে উঠেছে ইসলামের সুমহান আদর্শ। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন। যুগোপযোগী প্রবন্ধ নিবন্ধের মাধ্যমে মানুষকে সতর্ক করেছেন।

তিনি লেখালেখির প্রতি সবাইকে উৎসাহ দিতেন। বিশেষ করে তরুণদের প্রতি সবসময় নসিহত করতেন, কলম হাতে নেওয়া। লেখালেখির সাথে সম্পৃক্ত কাউকে পেলে আনন্দিত হতেন। উৎসাহ যোগাতেন। দুআ করতেন। আল্লামা বাবুনগরী মৃত্যুর আগ পর্যন্ত হাটহাজারী মাদরাসার মুখপাত্র মাসিক মুঈনুল ইসলাম এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছেন।

বিদগ্ধ এই মহামনীষী আলেম গত ১৯ আগষ্ট ২০২১ ইংরেজি বৃহস্পতিবার বেলা ১২টায় চট্টগ্রামের একটি বেসরকারি হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন।  আল্লাহ হযরতের কবরকে রহমতের বাগান এবং পরকালে জান্নাতুল ফেরদৌসের উচ্চ মাকাম দান করুন। আমিন।

লেখক: শিক্ষার্থী, হাটহাজারী মাদরাসা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।