Home ইতিহাস ও জীবনী দারুল উলূম হাটহাজারীর নবনিযুক্ত শিক্ষাপরিচালক আল্লামা কবীর আহমদের জীবন বৃত্তান্ত

দারুল উলূম হাটহাজারীর নবনিযুক্ত শিক্ষাপরিচালক আল্লামা কবীর আহমদের জীবন বৃত্তান্ত

- মাওলানা কবীর আহমদ (দা.বা.)।

।। মুনির আহমদ ।।

উপমহাদেশের অন্যতম শীর্ষ দ্বীনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দারুল উলূম হাটহাজারীর মাদরাসার নতুন শিক্ষাসচিব (নাজেমে তালিমাত) হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছেন হযরত আল্লামা কবীর আহমাদ। বুধবার (৭ সেপ্টেম্বর) সকাল সাড়ে ৯টায় প্রতিষ্ঠানটির মজলিসে শূরার বৈঠক শেষে তাঁকে শিক্ষাসচিব তথা নাযেমে তালিমাত পদে নিয়োগ দেওয়া হয়।

হযরত আল্লামা কবীর আহমাদ আরবি ১৩৬৯ হিজরী সনে চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানাধীন চারিয়া গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মুহাম্মদ আব্দুর রহমান (রহ.)। শৈশবেই তিনি পিতাকে হারান। শিশুকাল আপন মাতৃস্নেহেই তিনি অতিবাহিত করেন।

শিক্ষাজীবন: যখন আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.)এর বয়স পাঁচ বছর পূর্ণ হয়, তখন ভোর বেলায় স্থানীয় ফোরকানিয়া মক্তবে পবিত্র কুরআন পড়তেন। পাশাপাশি পারিবারিকভাবে তাঁকে চারিয়া বোর্ড স্কুলে ভর্তি করানো হয়। এখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা শেষ করার পর আপন মায়ের একান্ত ইচ্ছায় তাঁকে ধর্মীয় শিক্ষার জন্য বিখ্যাত জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীতে ভর্তি করা হয়। দারুল উলূম হাটহাজারীতে প্রথমে ভর্তি হয়ে তিনি নাজেরা থেকে শুরু করে মিযান জামাত পর্যন্ত অধ্যয়ন করেন।

এরপর মুফতিয়ে আযম ফয়যুল্লাহ (রহ.)এর তত্ত্বাবধানে পড়াশোনা ও তরবিয়্যাত অর্জনের মহান উদ্দেশ্যে তিনি মেখল হামিউচ্ছুন্নাহ মাদ্রাসায় ভর্তি হন। মেখল মাদ্রাসায় তিনি মিযান জামাত থেকে শুরু করে কাফিয়া জামাত পর্যন্ত চার বৎসর গভীর মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন। মেখল হামিউচ্ছুন্নাহ মাদ্রাসায় চার বৎসর পড়াশোনা কালীন তিনি প্রতি জামাআতে মেধা তালিকায় গৌরবময় শীর্ষস্থান অর্জন করেন।

মেখল হামিউচ্ছুন্নাহ মাদ্রাসায় তাঁর উল্লেখযোগ্য উস্তাদগণের মধ্যে ছিলেন- মুফতিয়ে আযম হযরতম আল্লামা ফয়যুল্লাহ (রহ.), মাওলানা আজিজুল্লাহ বড় হুজুর (রহ.), মুফতি সাইফুল ইসলাম (রহ.), মাওলানা গোলাম কাদের (রহ.), মাওলানা জাফর সাহেব (দা.বা.) এবং মাওলানা মোজাফফর আহমদ (রহ.) প্রমুখ।

মেখল মাদ্রাসা মাদ্রাসায় পড়াশোনা শেষ করে আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.) শরহে জামী জামাত থেকে পুনরায় জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ধারাবাহিকভাবে পড়াশোনা চালিয়ে গেছেন। বিশেষ ওজর ছাড়া একদিনও তিনি দরস কামাই করতেন না। ধারাবাহিক পড়াশোনা চালিয়ে তিনি ১৩৯৩ হিজরী সনে কওমি মাদ্রাসা সিলেবাসের সর্বোত্ত স্তর দাওরায়ে হাদিস (মাস্টার্স) সম্পন্ন করেন। দাওরায়ে হাদীস উত্তীর্ণ হওয়ার পর মুরুব্বী উস্তাদগণের পরামর্শে তিনি উচ্চতর কুরআন গবেষণার উদ্দেশ্যে তাখাসসুস ফিত-তাফসীর বিভাগে অধ্যয়ন করেন।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে তাঁর উস্তাদগণের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছেন- শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল কাইয়্যুম (রহ.), শায়খুল হাদীস আল্লামা আব্দুল আজিজ (রহ.), আল্লামা হামেদ (রাহ.), প্রখ্যাত মুহাদ্দিস আল্লামা আবুল হাসান (রাহ.), পীরে কামেল আল্লামা হাফেজুর রহমান (রহ.), মাওলানা মুহাম্মদ আলী (রহ.), মাওলানা নজির আহমদ আনোয়ারী (রহ.), মাওলানা নাদেরুজ্জামান (রহ.), মুফতিয়ে আযম হযরত আল্লামা শাহ আহমাদুল হক (রহ.), শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.) প্রমুখ।

আরও পড়তে পারেন-

শিশুকাল থেকেই আল্লামা কবীর আহমদ অত্যন্ত সহজ-সরল জীবন-যাপনে অভ্যস্ত এবং পড়াশোনায় গভীর মনোযোগী ছিলেন। তিনি শিশুকাল থেকেই সমবয়সী সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলায় অহেতুক সময় অপচয় করতেন না এবং কোনরূপ খুনসুটিতেও ঘেঁষতেন না। অত্যন্ত নিবৃত্তে থেকে গভীর অধ্যাবসায়ের সাথে পড়াশোনার অভ্যাস সেই শিশুকাল থেকেই তিনি চালিয়ে এসেছেন। দরসের বাইরে তিনি সবসময় উস্তাদ ও মাদ্রাসার জরুরি খেদমত ছাড়া বাকী পুরোটা সময় পড়াশোনা করতেন। সেই ছাত্র জীবন থেকেই তিনি অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত ছিলেন। সুন্নাতের উপর চলতেন। এ কারণে তিনি প্রায় সকল শিক্ষকদের সুনজরে থাকতেন এবং দোয়া পেয়েছেন।

কর্মজীবন: পড়াশোনা শেষ করার পর কর্মজীবনে ১৩৯৪ হিজরী সনে আল্লামা কবরি আহমদ (দা.বা.) সর্বপ্রথম চট্টগ্রামের চন্দনাইশ বশারত নগর মাদরাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এই মাদ্রাসায় তিনি ২ বছর অত্যন্ত সুনামের সাথে পাঠদান করেন। এরপর হাটহাজারী চারিয়া কাসেমুল উলূম মাদ্রাসায় চার বৎসর শিক্ষকতা করেন। চারিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতার সময় ছাত্রদের মাঝে তাঁর সুনাম ও খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে সুবিখ্যাত দ্বীনি প্রতিষ্ঠান আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতার ডাক পান। তখন চারিয়া মাদ্রাসার মুহতামিম সাহেবের কাছ থেকে অনুমতি ও ছাড়পত্র নিয়ে তিনি আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এখানে যোগদান করার পর তিনি ধারাবাহিকভাবে সাত বছর বাবুনগর মাদ্রাসায় অত্যন্ত সুনামের সাথে শিক্ষকতা করেন।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে শিক্ষক হিসেবে যোগদান

জামিয়া আজিজুল উলূম বাবুনগর মাদ্রাসায় শিক্ষকতাকালীন আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.) দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বিখ্যাত ইলমি মার্কাজ উম্মুল মাদারিস জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীর তৎকালীন নতুন মুহতামিম শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর পক্ষ থেকে শিক্ষকতা পদে যোগদানের ডাক পান। এরপর বাবুনগর মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে ছাড়পত্র নিয়ে হযরত খতীবে আজম হযরত সিদ্দিক আহমদ (রহ.)এর ইন্তিকালের দিন ১৯৮৭ সালের ১৯ মে দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় সিনিয়র শিক্ষক পদে আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.) যোগদান করেন। তিনি যখন দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় যোগদান করেন, তখন আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণের মাত্র দুই বছর পূর্ণ হয়েছে।

দারুল উলূম হাটহাজারীতে ১৯৮৭ সালে যোগদানের পর থেকে অদ্যাবধি সুদীর্ঘ ৩৫ বছর যাবত তিনি অত্যন্ত সুনাম ও সুখ্যাতির সাথে উর্দূখানা থেকে শুরু করে ফার্সী, নাহু, সরফ, উলূমে ফিক্বহ, আকাইদ, তাফসীর ও হাদিসসহ সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত পরম্পরা প্রায় সকল কিতাবের দরসদানের সৌভাগ্য অর্জন করেছেন।

দারুল উলূম হাটহাজারী মাদ্রাসায় শিক্ষকতার এই দীর্ঘ সময়ে তিনি প্রতিষ্ঠানটির ছাত্র-শিক্ষক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অত্যন্ত আস্থাভাজন ও জনপ্রিয় হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ব্যক্তি জীবনে তিনি যেকোনরূপ বিলাসিতা পরিহার করে অত্যন্ত সাধাসিধে জীবন যাপনে অভ্যস্ত। সবসময় নিভৃত্বে ও ঝামেলামুক্ত থাকতে পছন্দ করেন। দরসদানের পর বাকী সময় পারিবারিক জরুরত ছাড়া কিতাব মুতালায়াতেই সবসময় মশগুল থাকেন।

দারুল উলূম হাটহাজারীর দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবনে তিনি দরসদান ছাড়াও প্রাতিষ্ঠানিক অন্যান্য অর্পিত দায়িত্বও অত্যন্ত দায়িত্বনিষ্ঠতা ও যোগ্যতার সাথে সম্পন্ন করে আসছেন। দীর্ঘদিন তিনি দারুল উলূম হাটহাজারীর সহকারী হোস্টেল পরিচালক (নায়েবে নাযেমে দারুল ইক্বামা) এবং পরে হোস্টেল পরিচালক (নাযেমে দারুল ইক্বামা)এর দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া ছাত্রদের শৃঙ্খলা রক্ষাসহ বিভিন্ন অর্পিত গুরুত্ব দায়িত্ব অত্যন্ত পারঙ্গমতার সাথে তিনি পালন করে আসছেন। যে কারণে শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর ঘনিষ্ঠ আস্থা অর্জনের সৌভাগ্য অর্জন করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি।

হযরত আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.)এর জামিয়া আহলিয়া দারুল উলূম হাটহাজারীতে দীর্ঘ ৩৫ বৎসর দক্ষতার সাথে পথচলার এ পর্যায়ে প্রতিষ্ঠানটির সর্বোচ্চ প্রশাসনিক কমিটি মজলিসে শূরা তাঁকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পরিচালক (নাযেমে তালিমাত) পদে মনোনীত করেন।

তাসাউফ: হযরত আল্লামা কবীর আহমদ (দা.বা.) ছাত্র জীবনে গভীর অধ্যবসায়ে পড়াশোনার পাশাপাশি আধ্যাত্মিকতায়ও সময় ব্যয় করতেন। ছাত্র জীবনে তিনি নিরহংকারী, সহজ-সরল মাটির মতো জীবন-যাপন এবং ইবাদত-বন্দেগীর প্রতিও সমান মনোযোগী ছিলেন। যে কোন ঝড়ঝাপটা ও প্রতিকূলতায় তিনি ভেঙ্গে না পড়ে সর্বোচ্চ ধৈর্য ও সবরের সাথে চলতেন। ছাত্র জীবনে আধ্যাত্মিকতায় বুৎপত্তি অর্জনের লক্ষ্যে তিনি হযরত আল্লামা আব্দুল ওয়াহাব (রহ.)এর হাতে বায়আত গ্রহণ করেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাসাউফ ও সুলূকের উপর মেহনতের ধারাবাহিকতা এগিয়ে নিতে শায়খুল ইসলাম হযরত আল্লামা শাহ আহমদ শফী (রহ.)এর সাথে তায়াল্লুক করেন।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।