Home ইতিহাস ও জীবনী কারাকোরাম শহর: মোঙ্গল রাজধানীর কেন্দ্রে ছিল রুপোর গাছ-সোনার সাপ

কারাকোরাম শহর: মোঙ্গল রাজধানীর কেন্দ্রে ছিল রুপোর গাছ-সোনার সাপ

কারাকোরাম শহর ছিল ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর, কারণ এটি ছিল মোঙ্গল সাম্রাজ্যের রাজধানী। চেঙ্গিস খান এই শহরের স্থাপনা করলেও এই শহরের উন্নতি তাঁর আমলে হয়নি। চেঙ্গিস খারনে উত্তরাধিকারী ওগেদেই খানের শাসনকালে এর উন্নতি শুরু হয়। তাঁর আমলেই কারাকোরাম মোঙ্গল রাজত্বের যথার্থ রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

ত্রয়োদশ শতাব্দীর বিশ্বে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল কারাকোরাম। এক সময়ে শহরটি ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল এবং পরবর্তী বহু শতকে এর প্রকৃত অবস্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। কিন্তু অবশেষে কারাকোরামের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা প্রত্নতাত্ত্বিক ও সুস্পষ্ট ঐতিহাসিক বিবরণ থেকে এই শহর তার জীবদ্দশায় কেমন ছিল, সেই কাল্পনিক চিত্র আঁকতে সক্ষম হয়েছেন।

কারাকোরাম শহর-এর প্রাথমিক ইতিহাস

উত্তর-মধ্য মোঙ্গলিয়ার ওরখন উপত্যকায় অবস্থিত একটি ঐতিহাসিক শহর ছিল কারাকোরাম। এছাড়া খারা-খোরিন, হর হোরিন, খারাখোরাম ও কোরা কোরাম ইত্যাদি নামেও এর পরিচিতি ছিল। মোঙ্গলরা আসার আগেই এখানে বসতি স্থাপন হয়েছিল। প্রত্নতাত্ত্বিক তথ্য অনুসারে, এই শহরে প্রথমে যাযাবরা তাঁবু খাটিয়ে থাকত। অষ্টম থেকে নবম শতাব্দীর মধ্যে, ব্রোঞ্জ যুগের স্টেপ সোসাইটির উইঘুর বংশধররা এই শহরের প্রথম পত্তন করেন।

পরবর্তী কালে ১২২০ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিস খান প্রথম কারাকোরামে স্থায়ী বসবাসের যোগ্য শহর স্থাপন করেছিলেন। এর আশেপাশের জমি কৃষিকার্যের জন্য যথেষ্ট উর্বর ছিল না। তবে চেঙ্গিস খান কেন এই শহরকে রাজধানী হিসেবে নির্বাচন করেছিলেন, তার পিছনে অন্য কারণ ছিল। মোঙ্গলিয়া দিয়ে যাওয়া বিখ্যাত সিল্ক রোডের উত্তর–দক্ষিণ এবং পূর্ব–পশ্চিমের সংযোগ কেন্দ্রে এই শহর অবস্থিত ছিল। বলা যায়, ব্যবসায়িক দিক থেকে এই শহরের উন্নতি লাভের প্রচুর সম্ভাবনা ছিল। চেঙ্গিস খান তাঁর চিন অভিযানের মূল কেন্দ্র হিসেবেও এই শহরকেই ব্যবহার করেছিলেন।

কারাকোরাম শহরে খানেদের প্রাসাদ

চেঙ্গিস খান কারাকোরাম শহরের স্থাপনা করলেও এই শহরের উন্নতি তাঁর আমলে হয়নি। চেঙ্গিস খানের উত্তরাধিকারী ওগেদেই খানের শাসনকালে এর উন্নতি শুরু হয়। তাঁর আমলেই কারাকোরাম মোঙ্গল রাজত্বের যথার্থ রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়।

মোঙ্গলরা ১২৩৫ সালে জিন সাম্রাজ্যকে ধ্বংস করে। তারপরেই কারাকোরামে বিভিন্ন নির্মাণের কাজ শুরু হয়। এখানে মহান খান-দের বসবাসের জন্য গ্রানাইটের ভিতের উপরে ৬৪টি কাঠের কলামের এক প্রাসাদ নির্মাণ করা হয়। শহরের সুরক্ষার জন্য এর চারপাশে কাদামাটির দেওয়াল বানানো হয়।

১২৬৪ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এই মোঙ্গল রাজত্বের রাজধানী হিসেবে পরিচিত ছিল। এরপর কুবলাই খান তার রাজধানী খানবালিকে নামক শহরে স্থানান্তরিত করেন। মোটামুটি এর তিন বছরের মধ্যেই কারাকোরাম সম্পূর্ণ রূপে পরিত্যক্ত এক শহরে রূপান্তরিত হয়। এরপর যুয়ান বংশের শেষ সম্রাট বিলিক্ত খান ১৩৬৮ সালে বেজিং থেকে বিতারিত হয়ে কারাকোরামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে জানা যায়। তিনি কারাকোরাম শহরের কিছু অংশের পুনর্নির্মাণ করেন। পরে মোঙ্গলদের হাত থেকে থেকে চিনের ক্ষমতা দখল করে মিং রাজবংশ। তারা চতুর্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে কারাকোরাম শহর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে।

আরও পড়তে পারেন-

কারাকোরাম শহর-এর রুপোর গাছ

মধ্যযুগের বিভিন্ন পর্যটকদের সত্যিই ধন্যবাদ প্রাপ্য, কারণ তাঁদের লেখা ছাড়া রাজধানী কারাকোরামের জমজমাট অবস্থার বিবরণ পাওয়া সম্ভব ছিল না। এমনই এক উল্লেখযোগ্য লেখক হলেন মোঙ্গল রাজসভায় আসা ফ্রান্সের রাজা নবম লুই-এর দূত, উইলিয়াম অফ রুব্রুক।

উইলিয়ামের বর্ণনা থেকে জানা যায়, চতুর্থ মহান খান মঙ্গকে খানের শাসন কালের আমলে প্যারিসের এক স্বর্ণকার ছিলেন উইলিয়াম বুশিয়ার। তিনি কারাকোরাম শহরে খান-দের রাজমহলের সামনে একটি রুপোর গাছ বানিয়েছিলেন। এই গাছের তলদেশে চারটি রুপোর সিংহ ছিল, যাদের মুখ দিয়ে মারে’র (এক প্রকারের ঘোড়া) দুধ বেরত। আর এই গাছের চারপাশে চারটি সোনা দিয়ে বাঁধানো সাপ জড়ানো ছিল, তাদের প্রতিটির মুখ দিয়ে বিভিন্ন পানীয় বেরত।

উইলিয়াম তাঁর লেখায় জানিয়েছিলেন যে, এই শহরে ১২টি মন্দির, দুটি মসজিদ এবং একটি চার্চ ছিল। কারাকোরাম শহরের ধর্মীয় বৈচিত্রের উল্লেখ এই লেখায় পাওয়া যায়।

মোঙ্গল রাজধানী কারাকোরাম শহরের পুনরাবিষ্কার

কারাকোরাম শহর ধ্বংসের পর, একদা মোঙ্গলদের মহান এই রাজধানীর কথা মানুষের স্মৃতি থেকে ধীরে ধীরে লুপ্ত হয়। ১৮৮৯ সালে এই অঞ্চলে কর্মরত দুই রাশিয়ান প্রাচ্যবিদ এই শহরের অবস্থান আবার খুঁজে পান। পরবর্তী শতাব্দীতে এই অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিকরা খনন কার্য শুরু করেছিলেন।

অন্যান্য জিনিসের সাথে এই খনন কার্যের ফলে মাটির জিনিস তৈরির ভাঁটি, ধাতব সামগ্রী নির্মীণের কারখানা এবং একটি মুসলিম সমাধি ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়। যে প্রত্নতাত্ত্বিকরা ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দের সমসাময়িক সময়ে এই স্থানে খনন কার্য চালিয়েছিলেন, তাঁরা নিশ্চিত ছিলেন যে খান-দের রাজ প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পেয়েছেন। তবে বর্তমানের প্রত্নতাত্ত্বিক খননের ফলে প্রমাণ মিলেছে যে, এই তত্ত্ব সম্ভবত ভুল। যাকে রাজপ্রাসাদের ভগ্নাবশেষ বলে ভাবা হয়েছিল,সেই ভগ্নস্তুপটি প্রকৃতপক্ষে কোনও মন্দিরের অংশ ছিল বলে অনুমান করা হয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।