Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং আসমানী অন্যান্য গ্রন্থের মাঝে পার্থক্য

মহাগ্রন্থ আল-কুরআন এবং আসমানী অন্যান্য গ্রন্থের মাঝে পার্থক্য

।। মুফতি আবু সাঈদ ।।

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন মহান আল্লাহ তা‘আলার পক্ষ হতে প্রেরিত গ্রন্থ’। তিনি সর্বমোট একশত চারটি গ্রন্থ’ অবতীর্ণ করেছেন। সেগুলোর মাঝে একশটি গ্রন্থ’কে সহিফা বা ছোট গ্রন্থ’ বলা হয়। বাকি চারটিকে বড় গ্রন্থ’ বলা হয়।

সহিফাগুলোর মধ্যে দশটি হযরত আদম আ. এর ওপর অবতীর্ণ হয়। পঞ্চাশটি হযরত শীছ আ. এর ওপর অবতীর্ণ হয়। ত্রিশটি হযরত ইদরীস আ. এর ওপর অবতীর্ণ হয়। বাকি দশটি হযরত ইবরাহীম আ. এর ওপর অবতীর্ণ হয়।

প্রসিদ্ধ চারটি আসমানী গ্রন্থ
১. তাওরাত অবতীর্ণ হয় হযরত মূসা আ. এর ওপর।
২. যাবুর অবতীর্ণ হয় হযরত দাউদ আ. এর ওপর।
৩. ইনজিল অবতীর্ণ হয় হযরত ঈসা আ. এর ওপর।
৪. সর্বশেষ কুরআন অবতীর্ণ হয় হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর।

একশত চারটি গ্রন্থের মাঝে কুরআন ব্যতীত বাকি একশটি গ্রন্থ’ অবতরণের ধারা ছিল একটু ভিন্ন। অর্থাৎ এগুলোর সবকটিই পুরোটা একসাথে অবতীর্ণ হয়েছে। শুধু ব্যতিক্রম হলো মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন। যা প্রথমে ‘লওহে মাহফুজ’ থেকে দুনিয়ার আসমানে বাইতুল মা’মুরে অবতীর্ণ হয়। এরপর সেখান থেকে মোট তেইশ বৎসরে অবতীর্ণ হয় হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর।

[ দুই ]

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন কোন গোত্র কেন্দ্রিক অবতীর্ণ গ্রন্থ’ নয়। বরং সারা বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ গ্রন্থ’। কিন্তু বাকি সবকটিই ছিল গোত্র কেন্দ্রিক। কোন একটি নির্দিষ্ট গোত্র বা সম্প্রদায়কে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়েছিল। যেমনÑ তাওরাত, যাবুর ও ইনজিল বনি ইসরাঈল (ইয়াকুব আ. এর বংশধর তথা ইহুদি-খৃস্টান)-কে কেন্দ্র করে অবতীর্ণ হয়েছিল।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেন-

تَبَارَكَ الَّذِىْ نَزَّلَ الْفُرْقَانَ عَلٰى عَبْدِهٖ لِيَكُوْنَ لِلْعَالَمِيْنَ نَذِيْرًا.

অর্থাৎ- “তিনি বরকতময়, যিনি স্বীয় বান্দা (মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)-এর ওপর কুরআন অবতীর্ণ করেছেন। যেন তিনি বিশ্বজগতের জন্য সতর্ককারী হতে পারেন।” (সূরা ফুরকান- ১)।

মহান আল্লাহ তা‘আলা আরো ইরশাদ করেন- وَمَا اَرْسَلْنَاكَ اِلَّا كَافَّةً لِلنَّاسِ بَشِيْرًا وَنَذِيْرًا. অর্থাৎ- “আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্য সুসংবাদদাতা এবং সতর্ককারীরূপে প্রেরণ করেছি।” (সূরা সাবা, ২৮ আয়াত)।

হযরত রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন-

كَانَ النَّبِيُّ يُبْعَثُ اِلٰى قَوْمِهٖ خَاصَّةً وَبُعِثْتُ اِلَى النَّاسِ عَامَّةً.

অর্থাৎ- “আমার পূর্বের নবীগণ স্বীয় সম্প্রদায়ের হেদায়াতের জন্য প্রেরিত হতেন। কিন্তু আমি প্রেরিত হয়েছি সমগ্র জগতের জন্য।” (সহীহ বুখারী, হাদীস নং- ৩৩৫)।

উল্লিখিত আয়াত দু’টি ও হাদীস দ্বারা প্রতীয়মান হয় যে, কুরআন যার ওপর অবতীর্ণ হয়েছে তিনি সারা বিশ্বের জন্য প্রেরিত হয়েছেন। নির্দিষ্ট কোন সম্প্রদায়ের জন্য নয়।

সুতরাং বিশ্বনবী মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ’ও বিশ্বগ্রন্থ’। তথা সমগ্র বিশ্ববাসীর জন্য অবতীর্ণ, কোন গোত্র বা সম্প্রদায় কেন্দ্রিক নয়।

[ তিন ]

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ’। এরপর আর কোন আসমানী গ্রন্থ’ অবতীর্ণ হবে না। মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-

مَا كَانَ مُحَمَّدٌ اَبَا اَحَدٍ مِّنْ رِّجَالِكُمْ وَلٰكِنْ رَّسُوْلَ اللهِ وَخَاتَمَ النَّبِيِّيْنَ.

অর্থাৎ- “মুহাম্মাদ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) তোমাদের মধ্যে কোন পুরুষের (বংশীয়) পিতা নন; বরং তিনি আল্লাহর রাসূল এবং শেষ নবী।”

স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- اَنَا خَاتَمُ النَّبِيِّيْنَ لاَ نَبِيَّ بَعْدِيْ. “আমিই সর্বশেষ নবী। আমার পরে আর কোন নবী আসবেন না।” (তিরমিযী, হাদীস নং- ২২১৯)।

মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামই যেহেতু সর্বশেষ নবী, সুতরাং তাঁর ওপর অবতীর্ণ গ্রন্থ’ই সর্বশেষ আসমানী গ্রন্থ’।

আরও পড়তে পারেন-

[ চার ]

মহাগ্রন্থ’ আল কুরাআন একটি পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থ’। যাতে রয়েছে ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, আন্তর্জাতিক বিষয়সমূহের সমাধান এবং আকিদা-বিশ্বাস, ইবাদত-বন্দেগি, দ–শাস্তি, শিষ্টাচার, লেনদেনসহ সকল বিষয়ের শিক্ষা।

মোটকথা, মানবজাতির জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সকল বিষয়ের পরিপূর্ণ সমাধান রয়েছে মহাগ্রন্থ’ আল কুরআনে। এমনকি পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থ’সমূহের অপরাপর শিক্ষাও এ মহাগ্রন্থে বিদ্যমান। বরং এতে তদতিরিক্ত শিক্ষাও রয়েছে। মহান আল্লাহ তা‘আলা ইরশাদ করেন-

اَلْيَوْمَ اَكْمَلْتُ لَكُمْ دِيْنَكُمْ وَ اَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِىْ وَ رَضِيْتُ لَكُمُ الْاِسْلَامَ دِيْنًا.

অর্থাৎ- “আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামত পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং তোমাদের জন্য দ্বীন হিসেবে ইসলামকে পছন্দ করে নিলাম।” (সূরা মায়েদা- ৩)।

ইসলাম যখন পরিপূর্ণ ধর্ম, তাহলে তার ধর্মগ্রন্থ’, আল কুরআনও যে পরিপূর্ণ গ্রন্থ তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিখ্যাত পশ্চিমা লেখক মাইকেল এইচ হার্টের স্বীকৃতি

পশ্চিমা বিশিষ্ট লেখক মাইকেল এইচ হার্ট তার বহুল আলোচিত ‘দি হান্ড্রেড’ নামক গ্রন্থে উক্ত বিষয়টিকে খুবই চমৎকারভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি তার সেই বইটিতে জগদ্বিখ্যাত এমন ১০০ জন মনীষীর জীবনবৃত্তান্ত তুলে ধরেছেন, যারা তার ধারণা মতে- পৃথিবীর ইতিহাসকে সফল কোন কীর্তি দ্বারা ধন্য করেছেন। যাদের মাঝে রয়েছেন বড় বড় বিজ্ঞানী, জেনারেল, সামরিক প্রধান এবং অনেক নবীগণ। কিন্তু তিনি এই একশজনের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্যক্তি হিসাবে আলোচনায় রেখেছেন হযরত মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে। যে কথাটি তিনি সেখানে উল্লেখ করেছেন, তা হলো-

My choice of Muhammad to lead the ranking of the most influetcial personalities in the history will surprise some of the readers.

অর্থাৎ তিনি একজন খৃস্টান-ধর্মাবলম্বী হয়েও তাদের নবী হযরত ঈসা (আ.)এর আলোচনাকে প্রথমে আনতে পারেননি।

তিনি আরো লিখেন, ‘অনেকে হয়তো আমার এ ধারা বর্ণনার ব্যাপারে আশ্চর্যবোধ করে থাকবেন। কিন্তু আমার এমনটি করার কারণ হল আমি দেখলাম, পৃথিবীতে যারাই মনীষী হয়ে ইতিহাসে স্থান পেয়েছেন, আমরা যদি তাঁদের সেই সফল জীবন-গঠনের দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাবো, ‘তাঁরা তাঁদের যুগের ভালো কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কোন অভিজ্ঞ-শিক্ষাগুরুর নিকট থেকে জ্ঞান অর্জন করে নিজেদের জীবনকে সাজিয়েছেন এবং পৃথিবীবাসীকে কীর্তি উপহার দিয়ে পৃথিবীর ইতিহাসে কৃতিত্বের স্থান দখল করেছেন।

কিন্তু জগতবিখ্যাত মনীষীদের মাঝে ব্যতিক্রমধর্মী হলেন একজন। যিনি কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কিংবা কোন শিক্ষাগুরু থেকে জ্ঞান অর্জন করেননি। অথচ তিনি মানবজাতিকে এমন এক আদর্শ শিক্ষা উপহার দিয়ে গেছেন যা আজও কেউ দিতে পারেনি। ভবিষ্যতেও তার কোন সম্ভাবনা নেই। তিনি হলেন ইসলামের নবী ‘মুহাম্মাদ’ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তাই আমি তাঁর জীবনবৃত্তান্ত দিয়েই আমার গ্রন্থ’টি শুরু করতে বাধ্য হলাম।

মোটকথা, মাইকেল হার্ট অকপটে স্বীকার করলেন, ‘মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মানবজাতিকে এমন আদর্শ উপহার দিয়ে গেছেন, ইতিপূর্বে যা কেউ দিতে পারেনি। ভবিষ্যতেও এর কোন সম্ভাবনা নেই। এটাকেই পরিপূর্ণ আদর্শ শিক্ষা বলে। আর এই আদর্শ ও পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাগ্রন্থের নামই হল, মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন।

পবিত্র কুরআনে পূর্বের সকল কিতাবের ইলম সন্নিবেশিত রয়েছে; বরং তদতিরিক্ত আরো বহু জ্ঞান ও শিক্ষা রয়েছে। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনÑ “আমাকে তাওরাতের পরিবর্তে ‘সাত তুয়াল’, যাবুরের পরিবর্তে ‘মিয়ীন’ আর ইনজিলের পরিবর্তে ‘মাসানী’ দান করা হয়েছে। আর মুফাস্সালাতগুলো অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে।

সারাংশ কথা এই যে, পূর্বের সকল আসমানী গ্রন্থ’সমূহের জ্ঞান কুরআনে বিদ্যমান রয়েছে। এ ছাড়া মুফাস্সালাতগুলোকে কুরআনের জন্য অতিরিক্ত ও বিশেষভাবে দান করা হয়েছে।

[ পাঁচ ]

মহাগ্রন্থ’ আল কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং আল্লাহ তা‘আলা নিয়েছেন।
মহান আল্লাহ তা‘আলা বলেনÑ اِنَّا نَحْنُ نَزَّلْنَا الذِّكْرَ وَ اِنَّا لَهٗ لَحٰفِظُوْنَ. অর্থাৎ- “কুরআন আমিই অবতীর্ণ করেছি এবং আমিই এর সংরক্ষণকারী।”

কিন্তু পূর্ববর্তী আসমানী গ্রন্থ’Ñ তাওরাত, যাবুর ও ইনজিলের হেফাজতের দায়িত্ব আল্লাহ তা‘আলা ইহুদি-খৃস্টানদের কাঁধেই সোপর্দ করেছিলেন। তিনি সেগুলোর হেফাজতের দায়িত্ব নিজের ওপর নেননি।

ইহুদি-খৃস্টানরা তাদের ওপর সংরক্ষণের অর্পিত দায়িত্ব যথাযথ পালন করেনি বিধায় সেই গ্রন্থগুলো আজ বিকৃত। সেগুলোর মাঝে আসমানী বিধানের চেয়ে তাদের মনগড়া কথাই অধিক প্রধান্য বিস্তার করে আছে।

অপরদিকে কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব স্বয়ং মহান আল্লাহ তা‘আলাই নিয়েছেন। তাই কুরআন অবতীর্ণের যুগ থেকে অদ্যাবধি প্রায় চৌদ্দশত বছর ঊর্ধ্বকাল অতিবাহিত হচ্ছে, এরপরও ইসলাম-বিদ্বেষীরা শত অপচেষ্টা সত্ত্বেও এই মহাগ্রন্থে বিন্দু পরিমাণও বিকৃতি সাধন করতে পারেনি। একটি নুকতা বা যের, যবর-পেশকে এদিক সেদিক করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও তারা তাদের চেষ্টায় কখনো সফল হবে না। ইনশাআল্লাহ।

মুসলমানগণ যদিও আজ দ্বীনি বিষয় পালনে অনেক গাফেল, তা সত্ত্বেও কুরআন হিফজ করার প্রতিযোগিতায় তারা আজও পূর্ণ সজাগ। আপনি দেখবেন, পৃথিবীর পূর্ব থেকে পশ্চিম, উত্তর থেকে দক্ষিণ, এবং দুনিয়ার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত প্রত্যন্ত অঞ্চলে লক্ষ কোটি আবাল-বৃদ্ধ-বনিতার বক্ষে আল্লাহ তা‘আলা এই মহাগ্রন্থ’ সংরক্ষণ করে রেখেছেন।

– মুফতি আবু সাঈদ, সিনিয়র শিক্ষক- আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম, হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। খতীব- বারীয়া জামে মসজিদ, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।