Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘উত্তম আদর্শ নিয়ে মহানবী (সা.)এর আগমন এবং নারী জাতির অধিকার ফিরে পাওয়া’

‘উত্তম আদর্শ নিয়ে মহানবী (সা.)এর আগমন এবং নারী জাতির অধিকার ফিরে পাওয়া’

।।আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী ।।

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (১৫ অক্টোবর) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের হুবহু অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

বায়তুন নূর জামে মসজিদের সম্মানিত খতিব আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী জুমার বয়ানে বলেন, এখন রবিউল আউয়াল মাস। এমাসেই জুলুম, নির্যাতন, অন্যায়-অত্যাচার ও পাপাচারের আঁধার মাড়িয়ে নূরের সিতারা হয়ে এধরায় আগমন করেন বিশ্ব মানবতার মুক্তির দূত হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সা.)। তিনি বিশ্বকে মুক্তি দিয়েছেন কুফুর ও শিরক থেকে, অবহেলিত ও চির লাঞ্ছিত নারীকে মুক্তি দিয়েছেন যুলুম-নির্যাতন ও নিপীড়ন থেকে। অতঃপর বিশ্বকে দেখিয়েছেন সুমহান উত্তম আদর্শ।

আল্লামা নাজমুল হাসান কাসেমী জুমার বয়ানে হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) জীবনাদর্শের তিনটি পর্যায়ের বর্ণনা দেন।

(১) মহানবীর আগমনকালে বিশ্ববাসীর আদর্শিক বিশ্বাস কোন স্তরে ছিল?

তিনি বলেন, তৎকালীন পরাশক্তি রোম ও পারস্য দুই ধরনের বিশ্বাস লালন করতো।
১. রোমবাসীরা আগুন প্রজ্জ্বলিত করে যুগযুগান্তর আগুনের পূজা করতো।
২. পারস্যবাসীরা বলতো, إن الله ثالث ثلاثة
তিন খোদায় বিশ্বাসী ছিল তারা। আশ্চর্যের ব্যাপার হল এই, ইয়াহুদীরা মূসা আ. এর অনুসারী হয়েও বলতো, “وقالت اليهود عزير بن الله” তথা উযাইর আ. আল্লাহর পুত্র। খ্রিস্টানরা ঈসা আ. এর অনুসারী হয়েও বলতো, “وقالت النصارى مسبح بن الله” তথা ঈসা আ. আল্লাহর পুত্র।

অথচ আল্লাহ নিজেই কুরআনে বলেছেন, “لم يلد ولم يولد” তথা- “তিনি কাউকে জন্ম দেননি, কারো থেকে জন্ম নেননি।” মহানবী সাঃ পৃথিবীতে আগমন করে বিশ্ববাসীকে এই কুফর ও শিরক থেকে মুক্ত করে আলো ও তাওহীদের পথ দেখান। তাদেরকে তিনি শোনান لا الاه الا الله এর বাণী। এই মর্মে যে আল্লাহ ছাড়া আর কোন ইলাহ নাই।

(২) মহানবীর আগমনকালে নারীর বঞ্চিত অধিকার ফিরে পাওয়া।

তৎকালীন মানবতার ধ্বজাধারীদের নববর্ষ উদযাপন হত না যতক্ষণ না নারীকে উলঙ্গ করে স্টেডিয়ামে ছেড়ে দিত আর হিংস্র হায়েনারা জনসম্মুখে উল্লাস করে তাদেরকে অত্যন্ত নিষ্ঠুর ও নির্দয়ভাবে প্রকাশ্যে যৌন নিপীড়ন করতো।

তৎকালীন চিকিৎসা বিজ্ঞান নারীকে মানুষই মনে করত না। বলতো, নারী দেখতে কেবল মানুষের মত আসলে তারা মানুষ না। এইজন্যে তাদের কোন অধিকার নেই।

এমনকি আধুনিক বিশ্বও নারীকে এক মোহময় মায়াজালে আবদ্ধ করে স্রেফ ভোগ করে যাচ্ছে, কোনপ্রকার সম্মানজনক ও ন্যায্য অধিকার দিতে পারেনি একমাত্র ইসলাম ছাড়া। আসুন এবার বঞ্চিত নারীর ফিরে পাওয়া অধিকারের কয়েকটা উদাহরণ দিই!

ইসলাম এসে বলেছে নারীরা মায়ের জাতি। সুতরাং ” الجنة تحت اقدام الجامعات” অর্থাৎ মায়ের পায়ের নিচে সন্তানের বেহেশত। এমনকি যারা একদিনও দুধ পান করিয়েছেন তাঁরাও মা। তাঁদেরও সম্মান নিশ্চিত করেছে ইসলাম। শুনিয়েছে ” حرمت عليكم” এর শাশ্বত বাণী।

এমনকি নারীকে দিয়েছে বাবা, স্বামী এবং ছেলের সম্পদে বৈধ অধিকার এবং নিজের অধিকার ফিরে পেতে হস্তক্ষেপ করার এখতিয়ার। কখনো মেয়ে হিসেবে, আবার কখনো স্ত্রী, আবার কখনো মা হিসেবে। তাও পুরোটাই দিয়েছে নিজের সেইফটি বা বোনাস হিসেবে। আসলে ইসলামে পারিবারিক ব্যবস্থায় নারীর যেসব অধিকার ও নিরাপত্তা ব্যবস্থা সুনিশ্চিত করেছে, তারপর এসবের কোনোটাই নারীর দরকার ছিল না।

আরও পড়তে পারেন-

কারণ নারী অসুস্থ হলেও তাঁর দায়ভার নিবে বাবা, স্বামী কিংবা ছেলে। এদের কেউ না থাকলে রাষ্ট্র নিবে। এমনকি রাষ্ট্র নিতে বাধ্য। এখানেই শেষ নয়, বিয়ের সময় মোহরও দেওয়া হবে নারীকেই। এটাও তাঁর অধিকার। অথচ আপনারা যৌতুক প্রথাকে সিস্টেম বানিয়ে বলছেন, হুজুর এসব করতে হয়! যৌতুকের জন্য স্ত্রীদের মারধরও করেন। লজ্জা হওয়া উচিৎ আপনাদের। কারণ ইসলাম এসব শেখায়নি।

বাস্তবতা হচ্ছে, ইসলাম নারীকে এতটাই অধিকার দিয়েছে যে, নারী যদি এক টাকাও না কামায় তবুও নারীর অনাহারে বা সুবিধা বঞ্চিতভাবে পড়ে থাকার কোনই আশঙ্কা নেই। স্বামী, ভাই, বাবা এবং রাষ্ট্রের উপর তাঁর অধিকার সর্বদা বহাল থাকবে। আর নারীর এসব অধিকার নিশ্চিত করেছেন কেবলই মুহাম্মদ (সা.) এবং তাঁর আনীত আল্লাহপ্রদত্ত ইসলাম ধর্ম।

(৩) মহানবীর সুমহান উত্তম চরিত্র।

মুহাম্মদ (সা.) মানবতাকে মুক্তি দিয়েছেন অন্ধকার থেকে, আর নারীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন তাঁর প্রাপ্য মর্যাদা ও অধিকার। আর তিনি নিজেও ছিলেন উত্তম চরিত্রে অধিষ্ঠিত। তাঁর চরিত্রের বিশালতা আকাশ ও জমিনের ব্যপ্তির চেয়েও বিস্তৃত ছিল। সুবহানাল্লাহ। সাহাবীরা বলেছেন, দখিনা বাতাসের চেয়েও বেশি আমাদের নবীর উদারতা। যেমন-

এক বেদুইন রাতে নবীর বিছানায় ঘুমিয়ে বিছানা নষ্ট করে ফেললেন, অতঃপর ভয়ে পলায়ন করে নিজ তরবারি রেখেই চলে যান। অতঃপর তরবারি নিতে আসলে দেখেন আল্লাহর রাসূল সাঃ নিজ হাতে তা পরিষ্কার করছেন। লোকটা এতে হতবিহ্বল হয়ে যান। তখন রাসূল সাঃ তাকে দেখে বললেন, আমাকে রাতে বলেননি কেন এই কথা! তাহলে আমি বিছানা পরিষ্কার করে দিলে আপনি শান্তিতে ঘুমাতে পারতেন। এখনতো মনে হচ্ছে আপনি রাতে ঘুমাতে পারেননি। আমাকে ক্ষমা করে দিবেন। এটা আমার ত্রুটি।

ফহেত মক্কার পর এক মহিলা রাসূলের ভয়ে মক্কা ছেড়ে পালাতে চাইলে তিনি মহিলার বোঝা বহন করে দেন। মহিলা তাঁর আচরণে মুগ্ধ হয়ে বলেন, আব্দুল্লাহর পোলা যদি তোমার মত হতো, তাহলে আমার মক্কা ছাড়তে হত না। তখন মুহাম্মদ সা. বলেন আম্মাজান! আমিই সেই মুহাম্মদ, যার ভয়ে আপনি পালিয়ে যাচ্ছেন।

ঘুমন্ত রাসূলের তলোয়ার নিয়ে জনৈক কাফের তাঁকে মারতে চাইলে তিনি তাওয়াক্কুলের পরিচয় দিয়ে বলেন, আল্লাহ আমাকে বাঁচাবেন। অতঃপর ঐ কাফের ব্যার্থ হলে তাকে ক্ষমা করে দেন আল্লাহর পিয়ারা রাসূল।

মূলত এটাই ছিল আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের সবক। যেমনটা আল্লাহ কুরআনে বলেছেন, “ومن يتوكل على الله فهو حسبه” অর্থাৎ যে আল্লাহর উপর ভরসা করে আল্লাহই তাঁর জন্য যথেষ্ট।”

কেউ যদি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল রাখতে ব্যর্থ হয়, তাহলে আল্লাহ তাঁর ক্ষমতা দেখান যেমনটা দেখিয়েছেন এই একবিংশ শতাব্দীতে। তাও সামান্য এক করোনা দিয়ে। যেখানে আপনারা সবাই ব্যার্থ সেখানে শুধু আমরা সফল হয়েছি। সেই কঠিন সময়ে আমাদের হাতিয়ার ছিল কেবলই তাওয়াক্কুল। করোনার দূর্যোগেও আমরা মাদরাসা খুলেছি এবং বিশ্বকে দেখিয়েছি যে, আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুলের কারণেই তিনি আমাদের বাঁচিয়েছেন এবং রক্ষা করেছেন। করোনার প্রাদুর্ভাবের মূল সময়েও আমাদের কোন ছাত্রের কিছুই হয়নি। যেটা বিশ্ব কোনোদিন ভাবতে পারেনি আর পারবেও না। ইনশাআল্লাহ।

আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে রাসূল (সা.)এর সঠিক সুন্নাহর প্রকৃত অনুসারী হওয়ার এবং জীবনের সকল স্তরে মহান আল্লাহর উপর পরিপূর্ণ তাওয়াক্কুল নিয়ে চলার তাওফীক দান করুক। আমিন।

অনুলিখন: সাইফুল ইসলাম

শিক্ষার্থী, জামিয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়া, উত্তরা, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।