Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ‘বলপ্রয়োগে নয়, রাসূল (সা.)এর সুমহান চারিত্রিক গুণাবলীতেই ইসলাম জগতে বিস্তার করেছে’

‘বলপ্রয়োগে নয়, রাসূল (সা.)এর সুমহান চারিত্রিক গুণাবলীতেই ইসলাম জগতে বিস্তার করেছে’

[রাজধানীর অন্যতম বিখ্যাত দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জামিয়া মাদানিয়া বারিধারা’র সাবেক ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, উত্তরা জামেয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়ার প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক ও উত্তরা ১২নং সেক্টর বায়তুন নূর জামে মসজিদের খতীব আল্লামা হাফেজ নাজমুল হাসান কাসেমী শুক্রবার (২৯ অক্টোবর) জুমায় মুসল্লীদের উদ্দেশ্যে যে গুরুত্বপূর্ণ বয়ান করেছেন, বিষয়বস্তুর গুরুত্ব বিবেচনা করে বয়ানের অনুলিপি উম্মাহ পাঠক সমীপে উপস্থাপন করা হল -সম্পাদক]

প্রথমেই মহান রবের দরবারে লাখো কোটি শোকরিয়া যে, তিনি আমাদেরকে পূর্ণ সুস্থতার সাথে জুমুআর নামায আদায় করতে মসজিদে আসার তাওফীক দান করেছেন। মহান রবের এই দয়ার কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আমরা সকলেই হৃদয়ের গহীন থেকে বলি- ‘আলহামদুলিল্লাহ!’

পুরো রবিউল আউয়াল মাস জুড়েই চলছিল রাসূল (সা.)এর সীরাতের আলোচনা। সেই ধারাবাহিকতায় আজকের আলোচ্য বিষয় “খুলুকে আযিম দিয়ে হযরত মুহাম্মদ (সা.) করেছেন ইসলামের বিজয়, আর তাঁর অনুসারীগণ করেছেন বিশ্বজয়”।

প্রথমেই বলে রাখি, উত্তম চরিত্র চার প্রকার। যথা- ১. ইনসাফ; পর্যাপ্ত বা যথাযথ বদলা নেয়া। ২. খুলুকে হাসান; বদলা না নিয়ে ক্ষমা করে দেয়া। ৩. খুলুকে কারীম; ক্ষমার পর তাকে ভালবাসা বা তার সাথে হৃদ্যতার সম্পর্ক রাখা। ৪. খুলুকে আযিম; আপন শত্রুর কল্যাণের কথা চিন্তা করা। আল্লাহ তাআলা হযরত মুহাম্মদ (সা.)কে এই সুমহান মর্যাদার অধিকারী বানিয়ে দুনিয়ায় প্রেরণ করেছেন। সুতরাং মানুষের মধ্যে যে যত আখলাকি কাজ করতে পারবে আল্লাহ তায়ালা তাঁকে ততটাই সেই গুণের কাছাকাছি নিয়ে যাবেন।

এবার আসি মূল আলোচনায়, ইসলামের সাড়ে চৌদ্দশত বছরের ইতিহাস বলে, তলোয়ারের জোরে বিশ্বব্যাপী ইসলামের বিস্তার হয়নি। আর সেটা সম্ভবও না। বিশ্বব্যাপী প্রায় ৫৫টি দেশে ইসলাম কায়েমের সুদীর্ঘ ইতিহাসের এক পিঠ আমরা জানি তো অন্য পিঠ জানি না।

ভারতের বিখ্যাত লেখক ও ঐতিহাসিক সাইয়িদ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) একটি বই লিখেছেন, যার নাম ‘ماذا خسرالعالم بانحطاط المسلمين! ‘মুসলিম উম্মাহর পতনে বিশ্বের কী ক্ষতি হলো?’ সেখানে তিনি প্রমাণ করেছেন, স্পেন ৭০০ বছর মুসলিম তথা আমাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। ধ্যানে, জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, আদর্শ, সততা, উদারতা ও মানবতায় আমরাই সবচে’ সমৃদ্ধ ছিলাম। সেকাল আমাদের সোনালী অতীত, যা নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি।

আরও পড়তে পারেন-

জেনে অবাক হবেন যে, আজকের আধুনিক আমেরিকা মুসলিমদের আবিষ্কার। তা চির উন্নত কর্ডোভার ফসল। বিশ্ব ভ্রমণের ম্যাপটাও মুসলিম তথা আমাদের আবিষ্কার। যুগে যুগে আমরাই বিশ্বকে শাসন করেছি এবং সমৃদ্ধ করেছি। আর সেটা শুধুমাত্র নিজেদের নবীর চারিত্রিক গুণাবলী বা “খুলুকে আযিম” দিয়ে। তৎকালীন পরাশক্তি ‘রোম থেকে পারস্য, সুদূর জাযিরাতুল আরব থেকে সমস্ত ভারতবর্ষ’ আমাদের হাতে বিজিত হয়েছে একমাত্র রাসূলের দেখানো সুমহান চারিত্রিক গুণাবলীর মাধ্যমেই।

তাছাড়া রাসূলের আগমনটাই তো ছিল বিশ্ববাসীর জন্য রহমত। যেমনটা মহান আল্লাহ তায়ালার আসমানী বাণী- ‘وما ارسلناك الا رحمه للعالمين’ আর তাঁর রহমত ও দয়া ছিল সর্বশ্রেণীর মানুষের জন্য। বিশ্বাস না হলে হযরত বিলালে হাবশী (রাযি.)এর ব্যাপারটা চিন্তা করুন! ইসলাম গ্রহণের পর তিনি সাহাবীদের সঙ্গে একই দস্তরখানে বসে খেয়েছেন। খোদ উমর বিন খাত্তাব বলেছেন- “বিলাল আমাদের নেতা”। অথচ বর্তমান মানবাধিকারের ধ্বজাধারীরা এখনও পর্যন্ত সাদা-কালো চামড়ার ভেদাভেদ ভুলে একই সাথে বসে খেতে পারছে না। তাদের বর্ণবাদী আন্দোলন তার সুস্পষ্ট প্রমাণ বহন করে। অথচ আরবে এখনও একই সাথে এক প্লেটে বসে খাবার প্রথা এখনও প্রচলন আছে, যা আমি স্বচক্ষে অবলোকন করেছি। পুরো ইউরোপ-আমেরিকা চ্যালেঞ্জ, এমন নজির কোথাও কেউ দেখাতে পারবে না।

প্রিয় ভাইয়েরা! যারা ইসলাম ও মুহাম্মদের এই হাকীকত জানে না, কেবল তারাই স্লোগান মারে যে, সম্প্রীতির খাতিরে ইসলাম হটিয়ে দাও বিশ্বের বুক থেকে। অথচ মুহাম্মদ বিন কাসিমের মত ১৭ বছরের চির তরুণ শুধমাত্র মুহাম্মদ (সা.)এর খুলুকে আযিম দিয়েই সিন্ধু বিজয় করতে সক্ষম হয়েছে। সেই ঘটনা একটু স্মরণ করি আসুন! সুদূর আরব থেকে যেসব মুসলিম বণিক বা বাণিজ্যিক দল আসতো, শুধুমাত্র তাঁদের উত্তম চরিত্রের কারণেই আমরা আজকের এই ইসলাম পেয়েছি। তাঁদের সততা, আমানতদারিতা, বিশ্বস্ততা ও উদারতা দেখে এদেশের সর্বধর্ম-লোকেরা একটা সময় বলত যে, আমি আপনার বা আপনাদের মত আদর্শবান হতে চাই। তখনই তাঁরা কালেমা পড়িয়ে রাসূলের উত্তম চরিত্রে দীক্ষিত করতেন। যার ফলস্বরূপ আজকের বাংলাদেশ, পাকিস্তান এবং ভারতীয় মুসলিম জনসংখ্যা। কিন্তু রাজা দাহিরের দস্যুবাহিনী একটা সময় লুণ্ঠিত করে মুসলিম বণিকদের এবং বন্দী করে এক মহীয়সী নারীকে।

সংবাদটা হাজ্জাজ বিন ইউসুফের কানে পৌঁছতে বিলম্বিত হল না। তিনি চিঠি লিখে দাবী জানালেন, কয়েদীদের মুক্তি দিয়ে আমার কাছে পাঠিয়ে দিন ও আপনার দস্যুদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিন। রাজা দাহির প্রত্যাখ্যান করলে পরপর তিনটি অভিযান চালান হাজ্জাজ, অতঃপর স্বীয় ভ্রাতুষ্পুত্র ও জামাতা মুহাম্মদ বিন কাসিমকে পাঠালেন সিন্ধু বিজয়ের উদ্দেশ্যে। বলে দিলেন যে, দেখো মুহাম্মদ! মুসলিমদের বাণিজ্যিক পথ সুগম করা আর মুসলিম নারীকে উদ্ধার করা তোমার সবচে বড় কাজ। যদি এতে তোমার জীবন যায়, যাক। কারণ তোমার জীবনের চেয়েও বেশি মূল্য ঐ মুসলিম নারীর। ইসলাম ও মুহাম্মদ (সা.)এর উত্তম আদর্শই ছিল নারীর অধিকার ও সম্মান রক্ষা করা। আর ওই আদর্শ দিয়েই মুহাম্মদ বিন কাসিম সিন্ধু জয় করেছেন।

মুহাম্মদ (সা.)এর খুলুকে আযিম ও চতুরতার বদৌলতেই আব্বাস (রাযি.) ছিলেন উমর বিন খাত্তাবের মন্ত্রী সভায় অধিষ্ঠিত। তিনি সেটা সূরা নাসরের সর্বোত্তম ব্যাখ্যা করে প্রমাণ করেছেন। এর মানেই হল, আমরা যুগে যুগে রাসূলের খুলুকে আযিম দিয়েই বিশ্বজয় করেছি। আর বিন কাসিম ছিলেন সেই ধারাবাহিকতার অপার নিদর্শন। মজার ব্যাপার হল, শুধুমাত্র রাসূলের এই একটা চরিত্রের কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা আমাদের উপর প্রবল আস্থা রাখতো। কেনইবা রাখবে না? সেই রাজার কথা স্মরণ করুন, যে প্রত্যেক রাতে একটা করে সুন্দরী রমণী তুলে নিয়ে যেত ভোগ করার জন্য। তাহলে তার উপর কেন মানুষ আস্থা রাখবে?

রাজা দাহিরের চরিত্রও তো এমনই ছিল। স্বীয় গোত্রের লোকদের কাছে চির গাদ্দার ছিল ওই হিন্দু রাজারা। আর আমরা ছিলাম চির বিশ্বাসী। মনে রাখবেন, এটাই ছিল ইসলাম। আমাদের ইসলাম। এখন অন্তত আমাদের তথা আলেমদের দেখে সেটা শিখতে পারেন! আমাদের খোলাফার সোনালী যুগে চুরি হত না বলে শয়তান চোর সেজে চুরি করতো, যেন রাষ্ট্রের শৃংখলা বিনষ্ট হয়।

আর এখন! খোদ সরকারি কর্মকর্তা থেকে শুরু করে দুদক পর্যন্ত সবাই দুই নাম্বারি করে। মনে রাখবেন, মুহাম্মদ বিন কাসিমের এই জয় তলোয়ারের মাধ্যমে হয়নি। রাসূলের উত্তম চরিত্র দিয়েই হয়েছে। যেটাকে আমি খুলুকে আযিম বলেছি। আর একারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকেরা একটা দীর্ঘ সময় পর্যন্ত বিন কাসিমের মূর্তি বানিয়ে পূজা করতো। তাদের বিশ্বাস ছিল, মানুষ কোনোদিন এতটা সচ্চরিত্রের অধিকারী হতে পারে না। বিন কাসিম নিশ্চয় কোন ফেরেশতা! অথচ বাস্তবতা বলে, তিনি মুহাম্মদ রাসূল (সা.)এর উম্মত ও প্রকৃত অনুসারী। খুলুকে আযিমের অনুসারী।

অনুলিখন- মুহাম্মদ সাইফুল ইসলাম
শিক্ষার্থী, জামিয়াতুন নূর আল-কাসেমিয়া, উত্তরা, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন