Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ নারীরা এখন পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে

নারীরা এখন পাচারকারীদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে

।। মাওলানা শফিকুল ইসলাম আমিনী ।।

গত ১০ বছরে ভারতে পাচার হওয়া ২,৫০০ নারী দেশে ফিরেছে। ২০ সেপ্টেম্বর দুপুর ১২টায় বেনাপোল চেকপোস্ট দিয়ে ইমিগ্রেশন পুলিশের কাছে ৩৫ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করা হয়। (বাংলাদেশ প্রতিদিন ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২১) নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গত জুন মাসের শেষ দিকে ভারতে বাংলাদেশের এক তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। একটি বেসরকারি সংস্থার অভিবাসন কর্মসূচি থেকে জানা যায়, ২০০৮ থেকে ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত নারী পাচার মামলায় ১২৩২৪ জন ভুক্তভোগীর নাম উল্লেখ করা হয়েছে। (প্রথম আলো, শুক্রবার, ১৮ জুন ২০২১)।

সমাজ বিবর্তনের এ পর্যায়ে এসে নারীরা এখন ভোগ্যপণ্য বা তার চেয়ে অতি ক্ষুদ্র নিষিদ্ধ বস্তুর মতো ভিনদেশে পাচার হচ্ছে, আর যারা এই ঘৃণ্য কর্মকান্ড সম্পাদন করে, তারা আমাদের সমাজের লোক, আমাদের মতোই একজন পুরুষ অথবা নারী। তবে কোন পুরুষ পাচার হয়, সেরকম ঘটনা খুব একটা চোখে পড়ে না, যদি না কোন হতভাগ্য পুরুষ বা তরুণ তার কিডনি অথবা মূল্যবান অঙ্গ হারানোর চক্করে পড়ে।

নারীরা এখন সমাজে অনেকটাই স্বাধীন। শিক্ষা-সংস্কৃতি, পেশা এবং সামাজিক কর্মকান্ডে তারা এখন চোখে পড়ার মতো অংশগ্রহণ করে অবদান রাখছে দেশ-বিদেশের সম্মানজনক এবং উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে নারীরা এখন অনেকটা এগিয়ে, ক্ষমতা বেড়েছে ঢের! কিন্তু আড়ালে-আবডালে, ক্ষমতার অন্তরালে নারীর অপমান-নির্যাতন, নারীর প্রতি অসহিষ্ণুতা মারাত্মক হারে বেড়ে চলেছে। বর্তমান সমাজের অপরাধ বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে অধিকাংশ অপরাধ নারীকেন্দ্রিক। ধর্ষণ, নির্যাতন, ইভটিজিং, স্টেরিওটাইপস, কটাক্ষ, গালি, অসম্মান নারীজাতিকে ক্ষতবিক্ষত করছে। সবশেষ এটাও শুনতে হয় আমাদেরকে! নারীরা, আমাদের মা-বোনেরা দেদারছে পাচার হচ্ছে দু’পয়সা কামানোর লোভে। লালসার শিকার হচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মার্কেটে/বাজারে -বন্দরে, হসপিটালে-ডাক্তারের চেম্বারে। আমরা ভালো হতে পারিনি। সম্মান দিতে পারিনি নারী জাতিকে। কারণ, হয়তোবা অনেকে অনেক কিছু বলবেন! ব্যবচ্ছেদ হবে তাদের সামগ্রিক সম্মান নিয়ে। ঠিক যেমন ধর্ষিতা হওয়ার পর আবার ডাক্তারি পরীক্ষার জন্য হাসপাতালে সম্মান খোয়াতে হয় অথবা কারো কাছে আবার সম্মানহানির কথা বিস্তারিত বর্ণনা করতে হয়। এ বিষয়গুলো একেক জন একেক রকম ভাবে বিশ্লেষণ করে নিজেদের মতো করে। কেউ বলবে ধর্মীয়দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে, কেউ বলবে নারী স্বাধীনতার ঘাটতি নিয়ে, কেউবা বলবে পুরুষদের বিকৃত মানসিকতার ফসল, রাজনীতিবিদরা বলবে গণতন্ত্রের অভাবে নারী পাচার হয়, অর্থনীতিবিদরা বলবে অর্থসংকটের খপ্পরে পড়ে নারীরা বিক্রি হয় বিদেশে, যেন আজব চিড়িয়াখানায় বসবাস আমাদের।

কেউ কেউ আবার ইকোয়ালিটি ইকুইটির জিগির তুলে সমাজে! অথচ নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে আমরা কি কখনও ভেবেছি, আমাদের অবলা সহজ-সরল, মধ্যবিত্ত, নিম্নবিত্ত এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ধনী ঘরের সম্মানিত মা-বোনেরা কী পরিমাণ লাঞ্ছনা-বঞ্চনা ও অপমানের শিকার হয় প্রতিনিয়ত। আজ তাদের অপমান করি আমরা ভাষার মাধ্যমে, দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে, অধিকার হনন এর মাধ্যমে, শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে। যেমন অধিকাংশ সময় নারীর শরীর, সামাজিক অবস্থান, কর্মদক্ষতা, মনস্তত্ত্ব বা যৌনতাকে কটাক্ষ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজের গালিসমূহ আবর্তিত হয়। সমাজে প্রচলিত গালিসমূহের মধ্যে পুরুষের গোপন অঙ্গের চেয়ে নারীর গোপন অঙ্গের প্রতি ইশারা করা হয়। এতে করে পুরুষের বিকৃত বাসনা ফুটে উঠে। মনে করা হয় নারীর যৌন অঙ্গ কেন্দ্রিক শব্দ প্রয়োগে যেন পুরুষের বিজয়। অথচ এই সমস্ত গালি নারীর মর্যাদাকে তছনছ করে দেয়। এর দ্বারা সমাজে নারীর প্রতি সহিংসতা, অবমাননা ও সনাতন দৃষ্টিভঙ্গি- স্টেরিওটাইপস উন্মোচিত হয়। বুনো উল্লাস আর অপমানের মাধ্যমে শ্রদ্ধাশীল নারীসমাজকে হেয় করা হয়। তাই সঠিক কারণ, হেতু এবং প্রতিকারের কথা কেউ ভাবে না। সবাই সহানুভূতি দেখায় নারীকে। লেখালেখি বিতর্ক টকশো এবং আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থের উপরে প্রলেপ দেয়াকেই নারীবাদী এবং নারী অধিকারের রক্ষক হিসেবে মনে করা হয়। অথচ সমাজে নারীর বৈষম্য বাড়ে ভাষার মাধ্যমে, ব্যবহারের মাধ্যমে ও মানসিকতার মাধ্যমে।

আরও পড়তে পারেন-

কোথাও আজ আমাদের নারীরা নিরাপদ নয়। মেয়েদের অভিভাবকরা আজ শঙ্কিত, আতঙ্কগ্রস্ত। কেউ নিশ্চিত বলতে পারছে না আমার মেয়েটি আজ নিরাপদে বাসায় ফিরতে পারবে কিনা। আজকে নারীদের চাকরির ক্ষেত্র বেড়েছে, কিন্তু নিরাপত্তা বাড়েনি। নারীরা যে আশায় আজকে বহির্মুখী, সে আশায় গুড়েবালি। অধিক হারে ব্যবহারবিধি বেড়েছে তাদের। তাই সর্বাগ্রে দরকার পুরুষের মানসিকতার পরিবর্তন। নারীকে ভোগ্যপণ্য হিসেবে না দেখে, মা-বোন-স্ত্রী হিসেবে প্রাপ্য সম্মানটুকু দেয়ার। কারণ নারীর প্রতি সম্মান প্রমাণ বহন করে পুরুষের উত্তম মানসিকতা ও ব্যক্তিত্বের। আর এ পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মানসিক বিকৃতির জন্য দায়ী এই সমাজ, রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের আইন, প্রযুক্তি সর্বোপরি পাশ্চাত্য শিক্ষা ব্যবস্থা। আর এই নারীর প্রতি সম্মান দিয়েছে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন কুরআনে কারীমের মধ্যে।

পবিত্র কুরআনে নিসা (মহিলা) শব্দটি এসেছে ৫৭ বার এবং ইমরাআহ (নারী) শব্দটি এসেছে ২৬ বার, নাযিল হয়েছে বৃহৎ একটি সূরা, নিসা- যেখানে নারীর অধিকার, মর্যাদা, সম্মান ও মূল্যায়ন বর্ণনা করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে- “তোমরা নারীদের সঙ্গে উত্তম আচরণ করো এবং উত্তম আচরণ করার শিক্ষা দাও” এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যে তিনটি জিনিস অধিক ভালবাসতেন, নামায, ফুল ও নারী সেখানে নারী অন্যতম। ইসলাম নারীকে আবদ্ধ করে না। স্বাধীন করে এবং মর্যাদাবান বানায়। ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গি ও কালচার নারীর নিরাপত্তা বিধান করে। অথচ এসব বিষয়ে কথা বলতে গেলে রে রে সাড়া পড়ে যায় চারদিকে।

ধর্মান্ধতা -উগ্রবাদ ও মৌলবাদের ধোঁয়া দিয়ে আজকে আমাদের নারী জাতিকে অন্ধকারে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। বিজ্ঞাপনে- পোস্টারে রাস্তাঘাটে, নির্লজ্জভাবে নারীদের উপস্থাপন করে পুরুষের মানসিকতার বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে। জেন্ডার ডিসক্রিমিনেশন, জেন্ডার স্টেরিওটাইপস এসবের মাধ্যমে তৈরি হয়, ধর্মের অনুশাসন এর মাধ্যমে নয়। আজকের লেখায় ধর্মকে কারো বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেয়া উদ্দেশ্য নয়, উদ্দেশ্য হচ্ছে আমাদের নারী জাতি সঠিকভাবে সম্মান পায়, যে পদ্ধতি, অনুশাসন ও সিস্টেমে তারা বেড়ে উঠলে নিরাপত্তা পাবে, সম্মান পাবে, সেটাই পাঠকের কাছে অনুধাবন করার জন্য রেখে যাওয়া।

সবশেষে ছোট্ট একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে ‘জেন্ডার এডুকেশন’ নামক একটি কোর্সে যখন আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের সবচেয়ে বেশি নাম্বার পেলাম, তখন সবাই আমার কাছে জানতে চাইলো, তুমি কী লিখেছিলে জেন্ডার সম্পর্কে! তখন উত্তরে বলেছিলাম, আমি বেশি কিছু লিখিনি, আমি শুধু আমার বোধোদয় থেকে মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিকতাকে নিজের মতো করে বর্ণনা করেছি মাত্র। তাতেই নাস্তিক্যমনা শিক্ষক আমাকে সর্বোচ্চ নাম্বার দিয়েছেন।

লেখক: শিক্ষক- হাটহাজারী আরবী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম, সহকারী সম্পাদক- মাসিক মুঈনুল ইসলাম। ইমেইল- safiqier.du90@gmail.com

উম্মাহ২৪ডটকম: এসএএম

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।