Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ শুধু মানুষই নয়, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর ফানুস-আতশবাজি

শুধু মানুষই নয়, পশুপাখি ও পরিবেশের জন্যও ক্ষতিকর ফানুস-আতশবাজি

।। সাদিয়া আফরিন শায়লা ।।

প্রতি বছরের মতো এবারও দেশের মানুষ নতুন বছরকে বরণ করে নিয়েছে আতশবাজি ফাটানো ও ফানুস উড়ানোর মাধ্যমে। তবে, আনন্দঘন এই রাত কারো কারো জন্য পরিণত হয় বিষাদে। গত রাতে ফানুস উড়ানোর সময় দুর্ঘটনাক্রমে আগুন লাগে রাজধানীর মাতুয়াইলের একটি বাড়ির ছাদে। পরে জানা যায়, ঢাকার যাত্রাবাড়ী, ডেমরা, লালবাগ, সুত্রাপূর ও খিলগাঁও এলাকাসহ বেশ কয়েকটি এলাকায় ফানুস থেকে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। অথচ উৎসব আয়োজনে ইদানিং ফানুস উড়ানোর যে ‘ট্রেন্ড’ চলছে তা কিন্তু বেশিদিনের নয়।

বাংলাদেশে উৎসব-আয়োজনে ‘স্কাই ল্যানটার্ন’ বা ফানুস উড়ানোর চল শুরু হয় বৌদ্ধ-ধর্মাবলম্বীদের প্রবারণা পূর্ণিমা বা আশ্বিনী পূর্ণিমা উৎসবের মাধ্যমে। বৌদ্ধধর্ম মতে, আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতে রাজত্ব, রাজ্য, ভোগ, ধন-সম্পদের মায়া ত্যাগ করে সংসার পরিত্যাগ করেন গৌতম বুদ্ধ। তার মধ্যে বুদ্ধের গুণাবলী রয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করতে নিজের চুলের গোছা কেটে আকাশের দিকে নিক্ষেপ করেন তিনি। ধর্মমতে, সেই চুল দিয়েই স্বর্গে ‘চুলামনি চৈত্য’ নির্মিত হয়, যার পূজায় নিবেদিত থাকেন স্বয়ং স্বর্গের দেবতারাও।

সেই চৈত্যের পূজা করার জন্যেই মূলত আকাশে ফানুস উড়ান বুদ্ধভক্তরা। পরম শ্রদ্ধায় ফানুস তৈরি করে, ধর্মীয় গ্রন্থ পাঠ করে খালি পায়ে ফানুস উড়ান তারা। তবে, ধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে এই চল এখন পুরো দেশব্যাপী সকল ধর্মের মানুষের মাঝেই দেখা যায়। বিশেষ করে ইংরেজি নববর্ষ ও সাকরাইন উৎসবে উৎসবমুখর পরিবেশে ফানুস উড়ানো হয়। ফানুস একটি নিরীহ গোছের উৎসব অনুষঙ্গ হলেও এর রয়েছে বহুমুখী ক্ষতিকর দিক।

ফানুস মূলত ছোট আকারের একটি হট এয়ার বেলুনের মত কাজ করে। ফানুসে থাকা মোমবাতি একে বাতাসে উড়তে সাহায্য করে। ওজনে হালকা হওয়ায় আগুন না নেভা পর্যন্ত বেশ উঁচুতেই উড়তে পারে একটি ফানুস। একটি ফানুস ৩ হাজার ফুট উচ্চতায় ৬ থেকে ২০ মিনিট পর্যন্ত উড়তে পারে। কিন্তু মাটিতে পড়ার সাথেসাথেই যে আগুন নিভে যাবে তা কিন্তু নয়। ফলে এই ফানুস গাছপালা বা মাটিতে থাকা দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে এসে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

ফানুসের কারণে অতীতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাও ঘটেছে। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ২০১৩ সালে যুক্তরাজ্যের স্মেথউইক প্লাস্টিক রিসাইক্লিং প্ল্যান্টের অগ্নিকাণ্ড। ফানুস থেকে লাগা সেই আগুন নেভাতে ২০০ দমকলকর্মীর ৩ দিন লেগেছিল।

একই বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ওয়াশিংটন রাজ্যে ফানুসের আগুন থেকে একটি ৫০০ একরের জমিতে দাবানল শুরু হয়। এরপর গত বছর জার্মান তদন্তকারীরা জানান, ফানুসের মাধ্যমে আগুন লেগে দেশটির ক্রেফেল্ড চিড়িয়াখানায় বেশ কিছু প্রাণির মৃত্যু হয়।

শুধু তাই নয়। ফানুসের কাঠামো তৈরিতে ব্যবহৃত তার ও বাঁশের ফ্রেমও যেন একেকটি মৃত্যুফাঁদ। আকাশে উড়তে থাকা অনেক পাখিরই ফানুসের সাথে আটকে মৃত্যু ঘটে।

ফানুস বিক্রেতারা একে ‘বায়োডেগ্রেডেবল’ বলে দাবি করলেও আসল চিত্র ভিন্ন। দ্য গার্ডিয়ানের সাংবাদিক ও ক্লাইমেট অ্যাক্টিভিস্ট লিও হিকম্যান উল্লেখ করেন, ফানুসে ব্যবহৃত কাগজটি ৬ থেকে ৮ সপ্তাহের মধ্যে বায়োডিগ্রেড হয়, এবং কাঠামোতে ব্যবহৃত তারটি বায়োডিগ্রেড হতে ৯ মাসের মতো সময় লাগে। একটি ফানুস নির্মাতা কোম্পানির সাথে যোগাযোগ করে এ তথ্য জানতে পারেন তিনি।

আরও পড়তে পারেন-

পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর আরও একটি উৎসব অনুষঙ্গ আতশবাজি। একটি চীনা আতশবাজিতে ৪৬.৮৮ শতাংশ পটাশিয়াম নাইট্রেট, ২৩.৪৪ শতাংশ সালফার, ২৩.৪৩ শতাংশ অ্যালুমিনিয়াম ও ৬.২৫ শতাংশ বেরিয়াম নাইট্রেট ব্যবহৃত হয়। স্থানীয় আতশবাজিতে এসব ক্ষতিকর উপাদান ব্যবহারের অনুপাত আরও বেশি। এতে যে শুধু পরিবেশই দূষিত হয় তা নয়; আতশবাজির উচ্চ শব্দ বিভিন্ন প্রাণির মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

বাংলাদেশেও বহুকাল ধরে আতশবাজি ব্যবহার করা হচ্ছে। আতশবাজি খেলার মাধ্যমে উৎসব উদযাপন আমাদের আনন্দের খোরাক হলেও তা কি অন্যান্য প্রাণিদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য?

গতকাল উদযাপন চলাকালীন সময় সামাজিক মাধ্যমের একটি ভিডিওতে দেখা যায়, আতশবাজির শব্দে একদল পাখি মানুষের ফ্ল্যাটে আশ্রয় নিয়েছে। সেই ভিডিও ধারণকারী আরও জানান, তার বাসার সিড়িতেও আশ্রয় নেয় বেশ কিছু পাখি।

এর আগে গত বছর ইংরেজি নববর্ষে আতশবাজি ফাটানোর ফলে ইতালির রোমে শত শত পাখির মৃত্যু ঘটে। পরিবেশবাদীদের ধারণা, পাখিরা মূলত বিকট শব্দে হার্ট অ্যাটাক করেই মারা গেছে। একে ‘গণহত্যা’ বলেও অভিহিত করেন অনেকে।

নিজেদের একদিনের উদযাপনের জন্য অন্যান্য প্রজাতির প্রাণি, এমনকি পরিবেশের ক্ষতি করাটা কতটা যুক্তিসঙ্গত? নিজেকে এটি প্রশ্ন করাই যায়।

পুরো পৃথিবী যেখানে জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে, সেখানে একে আরও ক্ষতির মুখে ফেলা নিছক বোকামি বৈ কিছুই নয়।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।