Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে চীন: স্নায়ুযুদ্ধের নতুন রূপ?

সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে চীন: স্নায়ুযুদ্ধের নতুন রূপ?

কোনো শক্ত আদর্শগত ভিত না থাকায় চীন গণতন্ত্রের জন্য তত বড় হুমকি নয়, যতটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। ছবি- সংগৃহীত।

।। উসামা রাফিদ ।।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর কয়েক দশক ধরে চলা স্নায়ুযুদ্ধের অবসান ঘটলো। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সমান টক্কর দেওয়ার মতো বড় পরাশক্তি আর রইলো না। যুক্তরাষ্ট্র তাদের সামরিক আর অর্থনৈতিক শক্তি দিয়ে ক্রমেই সারা বিশ্বে নিজেদের প্রভাব আরও বিস্তার করতে থাকলো, যার প্রমাণ উপসাগরীয় যুদ্ধ, ইরাক যুদ্ধ আর আফগানিস্তান যুদ্ধ; সাথে সহযোগী হিসেবে রইলো বাকি পশ্চিমা রাষ্ট্রগুলো। 

এই সময়ে চীন তাদের অর্থনীতিকে ঢেলে সাজিয়েছে, শিক্ষাব্যবস্থা আর প্রযুক্তি গবেষণার ওপর বিনিয়োগ করেছে কয়েক হাজার বিলিয়ন ডলার। সামরিক আর প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ছাড়াও নিজেদের অর্থনীতিকে কাজে লাগিয়ে হাত বাড়িয়েছে এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকায় প্রভাব বিস্তার করতে। চীনের অর্থনীতি এতটাই শক্তিশালী যে একে উপেক্ষা করার মতো শক্তি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা এর মিত্র দেশগুলোর নেই। করোনা মহামারী এই বাস্তবতাকে আরও দ্রুত সামনে নিয়ে এসেছে, চোখে আঙুল দিয়ে জানান দিচ্ছে চীনের শক্তিমত্তা। অর্থনীতিকেন্দ্রিক প্রভাব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের এই দ্বন্দ্বকে অনেকেই অভিহিত করছেন এক ‘নব্য স্নায়ুযুদ্ধ’ হিসেবে। আসলেই কি তা-ই? 

অনেকেই চীন ও সোভিয়েত ইউনিয়নকে তুলনা করে দেখিয়েছেন। কোনো শক্ত আদর্শগত ভিত না থাকায় চীন গণতন্ত্রের জন্য তত বড় হুমকি নয়, যতটা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়ন। আবার অনেকের মতে, চীন স্নায়ুযুদ্ধকালীন মস্কোর নীতিগুলোই পুনরায় নিজস্ব পদ্ধতিতে ব্যবহার করছে, যেটিও একটি অতি-সরলীকৃত ধারণা বৈ কিছু নয়। 

‘নব্য স্নায়ুযুদ্ধ’ হিসেবে অভিহিত করার আগে স্নায়ুযুদ্ধের মূল বিষয় সম্পর্কে জানা জরুরি। সোভিয়েত ইউনিয়ন কীভাবে তাদের আদর্শ সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চাপিয়ে দিতে চেয়েছিল, সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকলেই বোঝা সম্ভব কেন বর্তমান চীন ও সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রসঙ্গ বেশ খানিকটা ভিন্ন।  

সোভিয়েত ইউনিয়নের মূল লক্ষ্য ছিল পুঁজিবাদী দেশগুলোর সরকারকে সহিংস বিপ্লবের মাধ্যমে সরিয়ে দিয়ে শুন্যস্থান কমিউনিস্ট সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপন করা। জার্মান দার্শনিক কার্ল মার্ক্সের ঘোষণা অনুযায়ী, “এটা আমাদের দায়িত্ব যে বিপ্লবকে স্থায়ীরূপ দেওয়া, যেখানে শ্রমিকরা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নেবে; কেবল একটি দেশেই নয়, বরং পৃথিবীকে নেতৃত্ব দেওয়া প্রত্যেকটি দেশে।” আর কার্ল মার্ক্সের এই ঘোষণাই বাস্তব রূপ নেওয়া শুরু করে এর ৭০ বছর পর যখন বলশেভিকরা আন্দোলনের মাধ্যমে রাশিয়ার জারকে সরিয়ে দিয়ে ক্ষমতা দখল করে নেয়। বলশেভিক নেতা লেনিনের বক্তব্য অনুযায়ী, ‘বলশেভিক বিপ্লবকে তখনই সফল বলা যাবে, যখন পুরো পৃথিবীজুড়ে পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লব শুরু হবে।’ আর লেনিনের বক্তব্যকে সঠিক প্রমাণ করতে মস্কো এবার গতানুগতিক কূটনীতির সাথে সাথে জুড়ে দেয় বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক পরিকল্পনা- বিভিন্ন দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করা, সরকার নিয়ন্ত্রণ করা কিংবা সরকারকে উৎখাত করা পর্যন্ত। 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরপরই লেনিনের ‘কমিনটার্ন’ নামে খ্যাত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গঠনের মাধ্যমেই শুরু হয়ে যায় পৃথিবীকে ‘কমিউনিস্ট’ বানানোর কাজ। মূলত মস্কোর নির্দেশেই কমিনটার্ন তার কার্যক্রম ঠিক করতো। লেনিনেরও বক্তব্য ছিল, ‘লক্ষ্য পূরণের জন্য কমিউনিস্টদেরকে যেকোন ছল-চাতুরির আশ্রয় থেকে শুরু করে অবৈধ কাজ, সত্য লুকানো কিংবা চেপে রাখার মতো কাজ করতে বাধা নেই।’ 

একই ধরনের কৌশল কাজে লাগানো হলো কমিউনিস্ট প্রোপাগান্ডা ছড়ানো, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের পেছনে অর্থ ঢালা, কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল রাজনৈতিক দলের অর্থ যোগান দেওয়া, বড় বড় আন্দোলনের পেছনে কলকাঠি নাড়ানো কিংবাবিভিন্ন দেশের কমিউনিস্টপন্থীদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করার মতো কাজে। এই সবকিছুর মূল উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে অ-কমিউনিস্ট সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা সে দেশের জনগণের কাছে কমিয়ে দেওয়া; যার পরবর্তী পদক্ষেপ হবে সেই সরকারকে উৎখাত করে মস্কোপন্থী সরকার বসানো। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সোভিয়েত ইউনিয়ন এ ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা শুরু করে, বিশেষ করে পোল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ার মতো দেশে- যে দেশগুলো দৃশ্যত স্বাধীন হলেও বাস্তবে নীতিনির্ধারণী ভূমিকা পালন করতো সোভিয়েত ইউনিয়নই। দেশগুলোতে মস্কো তাদের কর্তৃত্ববাদী চিন্তাধারা ছড়িয়ে দিয়েছিল, যার মধ্যে রয়েছে গোপন পুলিশ বাহিনী গঠন, সরকার দ্বারা গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বুদ্ধিজীবি সমাজ উচ্ছেদ কিংবা পরিকল্পিত সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি চালু করার মতো বিষয়। এছাড়াও স্থানীয় কমিউনিস্ট দলগুলোকে মিত্র অ্যাখ্যা দিয়ে অন্য যেকোন ধরনের মতবাদ ছড়িয়ে দিতে বাধা দেওয়া, সমস্ত সামাজিক ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানে লোক নেওয়া, শিক্ষার ওপর অধিকতর নিয়ন্ত্রণ কিংবা ক্যাথলিক ও প্রোটেস্ট্যান্ট গির্জার ওপরেও বাধানিষেধ তৈরি ছিল সোভিয়েতদের উদ্দেশ্য হাসিলের অস্ত্র। 

সোভিয়েত ব্যবস্থাকে কেবল বিশ্ব কীভাবে কাজ করবে তার একটি দর্শন হিসেবে বিচার করলে ভুল হবে। এটি এমন এক নীতিনির্ধারনী ব্যবস্থা, যেখানে রাষ্ট্রকে একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পনার মধ্যে এনে, ব্যক্তিগত সম্পত্তির বিলোপ ঘটিয়ে এবং সমগ্র দেশের শিল্পখাতকে রাষ্ট্রীয়করণ করে দেশে একটি লেনিনীয় আদর্শ অনুসরণ করা দলের সরকারের কাছে ক্ষমতা অর্পণ করা হয়। দেশটির ক্ষমতা পুরোপুরি কব্জায় আনার জন্য বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেপও এই সোভিয়েত ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত। 

ক্রেমলিনে থাকা বেশ কিছু অতি-কমিউনিস্ট ব্যক্তি অবশ্য চাইতেন যে অন্যান্য দেশেও একেবারে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই রাষ্ট্র পরিচালনা করা হোক। তবে বেশিরভাগ সোভিয়েত নেতারা এতটা গোঁড়া ছিলেন না, কমিউনিজিমের মূল কিছু নীতিকে ঠিক রেখে পুঁজিবাদের ভয়াবহতা চিহ্নিত করে সোভিয়েত আদর্শের সাথে সেই দেশের আদর্শ এক করে দেখানোই ছিল তাদের চিন্তা; অর্থাৎ সোভিয়েত আদর্শ যে পুঁজিবাদী পশ্চিমের তুলনায় সেরা তা-ই ছিল প্রধান লক্ষ্য। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন অবশ্য তাদের মার্কসীয়-লেনিনীয় চিন্তাধারা অন্যান্য দেশে স্থাপন করতে অনেকটাই ব্যর্থ হয়েছিল। ১৯৬০-এর মাঝামাঝি সময় থেকেই লক্ষ্য করা যায়, কেবল কম্বোডিয়া এবং উত্তর কোরিয়ার মতো অতি-নিয়ন্ত্রিত সমাজেই সোভিয়েত চিন্তাধারার বিস্তার ঘটানো সম্ভব। তবে সোভিয়েত চিন্তাধারার প্রভাব যে একেবারেই ছিল না, তা নয়। স্নায়ুযুদ্ধের পুরোটা সময় ধরেই উদার গণতান্ত্রিক দেশগুলোর জবাবে এবং সোভিয়েত আদর্শের প্রভাবে অনেক দেশেই আধা-সমাজতান্ত্রিক এবং অগণতান্ত্রিক সরকার গঠিত হয়েছিল। 

সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং চীনের মডেলের পার্থক্য ঠিক এখানেই। চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টি (সিসিপি) সোভিয়েতদের মতো মার্কসীয় আদর্শ ছড়িয়ে দেওয়ার মতো প্রেরণায় তাড়িত হয়ে কার্যক্রম পরিচালনা করে না, এমনকি বিশ্বজুড়ে ছোটখাটো সিসিপি-র মতো কমিউনিস্ট দল গঠনেও তাদের কোনো তৎপরতা দেখা যায় না। তার বদলে সিসিপি-র আসল উদ্দেশ্য হলো নিজেদের কর্তৃত্ববাদী মডেলকে উন্নয়নের মূল কারণ হিসেবে সকলের সামনে চিহ্নিত করে এর গ্রহণযোগ্যতা আদায় করে নেওয়া, যাতে করে চীন ও সিসিপি-র ক্ষমতা, নিরাপত্তা ও বৈশ্বিক প্রভাব আরও জোরদার করা যায়। 

সোভিয়েত ইউনিয়নের সাথে চীনের সবচেয়ে বড় মিলটি হলো, এটি গণতান্ত্রিক সরকারকে দুর্বল হিসেবে তুলে ধরে। এর বদলে চীনের কর্তৃত্ববাদী মডেল সারাবিশ্বে জনপ্রিয় করার লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে চীন। প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং এবং অন্যান্য চীনা নেতারা চীনের অর্থনৈতিক সাফল্যকে দেখিয়ে প্রায়ই প্রমাণ করার চেষ্টা চালান যে উদার গণতান্ত্রিক পরিবেশে এই অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের দেশের নেতাদের কাছে অবশ্য এই আদর্শ বেশ লোভনীয়, গণতান্ত্রিক দেশগুলোর কৈফিয়ত চাওয়াকে উপেক্ষা করেই তারা দেশের ‘উন্নতি’ করতে পারবে, একইসাথে গণতন্ত্রকে সরিয়ে নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজেও এই নীতি ব্যবহার করার সুযোগ তৈরি হবে। 

অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে ‘সফল’ হিসেবে প্রতীয়মান করে জনপ্রিয় করে তোলা অবশ্যই সোভিয়েত ঘরানার জোরপূর্বক ক্ষমতা দখল করে কমিউনিস্টপন্থী সরকার দ্বারা প্রতিস্থাপন থেকে আলাদা। তবে সিসিপি-র এই আগ্রাসী জনপ্রিয়করণ নীতি গণতান্ত্রিক আদর্শের জন্য বেশ বড় হুমকি হয়ে উঠছে, বিশেষ করে বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা গণতন্ত্রের দুর্বল রূপ দেখে জনগণ ক্রমেই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা হারিয়ে ফেলছে। তাছাড়া চীনের এই বৈশ্বিক পরাশক্তি হিসেবে উত্থানের ফলে বিভিন্ন দেশের সরকার চীনের দিকে ঝুঁকে পড়ে অগণতান্ত্রিক পথে হাঁটছে, যার ফলে সেই দেশের সাধারণ জনগণের ওপর নিয়ন্ত্রণ ও নজরদারি আরও বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা করা যায়। 

অর্থাৎ, মূল সারবস্তু এই যে, বেইজিং চেষ্টা করছে তাদের কর্তৃত্ববাদী মোডেলকে জনপ্রিয় করে তুলে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিকে অকার্যকর প্রমাণ করা। সিসিপি-র কাজের ধরন ভিন্ন হলেও উদার গণতান্ত্রিক আদর্শের বিপক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়নের মতোই হুমকি হয়ে উঠেছে এটি।

সাবেক মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেট মাইক পম্পেও চাইনিজ কমিউনিস্ট পার্টিকে নিরাপত্তার সবচেয়ে বড় হুমকি হিসেবে ঘোষণা দিয়েছিলেন, এমনকি আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের চেয়েও। অন্য বেশ কিছু দেশ এই মতের পক্ষে সায়ও দিয়েছিল। তাইওয়ান থেকে হংকং, হিমালয়ের পাদদেশে থাকা ভারতের লাদাখ সীমান্ত কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরের প্যারাসেল দ্বীপপুঞ্জে চীনের সাম্প্রতিক আচরণ অনেককেই চীনের সাথে সম্পর্ককে পুনরায় খতিয়ে দেখার কথা ভাবছে। এদিকে যুক্তরাষ্ট্র চাচ্ছে একটি চীনবিরোধী জোট গঠন করতে। তবে বিশ্বের বেশির ভাগ দেশেরই অর্থনীতি চীনের সাথে এতটাই আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা যে চীনকে অস্বীকার করা আত্মহত্যার নামান্তর, জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়ার ক্ষেত্রে এই কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।

জাতিসংঘে সিঙ্গাপুরের কূটনীতিক কিশোর মাহবুবানির মতে, ‘এশিয়ার দেশগুলো যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমতাধর হিসেবে স্বীকার করে, যাদের এশিয়া অঞ্চলে বিশেষ আগ্রহ আছে। অন্যদিকে চীন এই অঞ্চলের মোড়ল হয়ে উঠেছে এবং এটাই বাস্তবতা। এশিয়ার দেশগুলো চায় না, তাদের এই দুই দেশের মধ্যে যেকোনো একটি দেশকে বাছাই করতে বাধ্য করা হোক। যদি দুই দেশ যেকোনো একদিকে ঝুঁকে পড়ার জন্য চাপ দিতে শুরু করে, তবে পুরো এশিয়া অঞ্চলই ক্ষতির সম্মুখীন হবে।’ 

ইউরোপের অবস্থাও এশিয়ার চেয়ে ভিন্ন কিছু নয়। দুই বছর আগেও যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সুর মিলিয়ে চীনকে ‘পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী’ হিসেবে অ্যাখ্যায়িত করেছিল, সেখান থেকে সরে এসেছে তারা। বরং নিরপেক্ষ অবস্থানে থেকেই নিজেদের সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নের দিকে জোর দিতে চায় ইউরোপ। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান জোসেপ বোরেলের মতে, ‘প্রতিদ্বন্দ্বী মানে কী? কোন ক্ষেত্রে প্রতিদ্বন্দ্বী? পদ্ধতিগত প্রতিদ্বন্দ্বী বলতেই-বা কী বোঝায়?’

ইউরোপও যে চীনকে অগ্রাহ্য করতে পারছে না, তার একটি বড় উদাহরণ জার্মানি। ২০১৯ সালে চীন জার্মানি থেকে প্রায় ৯৬ বিলিয়ন ইউরোর পণ্য আমদানি করেছে, যা বাকি সমগ্র ইউরোপের অর্ধেক। ফোক্সওয়াগেন একাই ২০১৭ সালে প্রায় ৪২ লক্ষ গাড়ি রপ্তানি করেছে চীনে। জার্মান টেলিকম কোম্পানি ডয়েচ টেলিকম যদি চীনের যন্ত্রাংশ আমদানি করা বন্ধ করে দেয়, তবে এ ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সময় লাগবে ৫ বছর, বিপরীতে ক্ষতি গুনতে হবে কয়েক বিলিয়ন ডলার। ফলে যুক্তরাষ্ট্রের কথায় খুব বেশি কর্ণপাত করতে চাইছে না জার্মানিসহ ইউরোপের অন্য দেশগুলো। 

আরও পড়তে পারেন-

ল্যাটিন আমেরিকার অনেক দেশই চীনমুখী নীতি গ্রহণ করেছে। ল্যাটিন আমেরিকার সবচেয়ে মুক্ত অর্থনীতির দেশ হিসেবে পরিচিত চিলির প্রধান আমদানি-রপ্তানি সহযোগী দেশ এখন চীন! ওই অঞ্চলে প্রভাববিস্তার করতে সি চিন পিং তার ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ প্রকল্প টেনে নিয়ে গেছে ল্যাটিন আমেরিকা পর্যন্ত, ২০টি দেশের ১৪টি দেশকেই রাজি করে ফেলিয়েছে এই প্রকল্পে অংশ নিতে। অন্যদিকে আর্জেন্টিনার অর্থনীতির সবচেয়ে বড় সহযোগী ব্রাজিলকে হটিয়ে চীন এখন তাদের সবচেয়ে বড় সহযোগী। ইকুয়েডরের জাতীয় ঋণের এক-তৃতীয়াংশই (১৮.৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার) চীনের ব্যাংকগুলোর কাছে। মেক্সিকো, ভেনেজুয়েলা ও বলিভিয়ার সাথেও চীনের গভীর সম্পর্ক। 

দুই দশক আগেও যুক্তরাষ্ট্রের ‘উঠান’ হিসেবে পরিচিত ল্যাটিন আমেরিকা পরিণত হয়েছে চীনের বাগানে। তাইওয়ান ইস্যুকে কেন্দ্র করে সাম্প্রতিক সময়ে পানামা, ডোমিনিকান রিপাবলিক ও এল সালভ্যাদর চীনের পক্ষে রায় দিয়েছে, বিনিময়ে পেয়েছে অবকাঠামো ও বাণিজ্য উন্নয়নের জন্য চীনের সাহায্য। আফ্রিকার ক্ষেত্রে অবশ্য চীন বহু আগেই পশ্চিমা দেশগুলোকে হটিয়ে দিয়েছে। আফ্রিকান দেশগুলো চীন থেকে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ঋণ নিয়েছে, যা আফ্রিকার বাহ্যিক ঋণের ২০ শতাংশ। 

সাম্প্রতিক সময়ে চীনের এই ঋণ দেওয়ার পরিমাণ আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং প্যারিস ক্লাবের সামষ্টিক ঋনের পরিমাণের চেয়েও বেশি। যদিও এই ঋণ দেওয়ার প্রায় ৫০ শতাংশই মূল হিসাবের বাইরে। চীন তাদের এই ঋণকে কাজে লাগিয়ে ক্রমেই সারা বিশ্বে প্রভাব বিস্তার করছে এবং তারা যেহেতু ঋণদাতা, তারা এটিকে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বার্থ আদায় করে নিচ্ছে। দুর্বল অর্থনীতির দেশগুলোকে আলাপ-আলোচনা করার জায়গাও দেওয়া হচ্ছে না, চীনের শর্তগুলোই তাদের মুখ বুজে মেনে নিতে হচ্ছে। 

চীন তাদের এই প্রভাব কাজে লাগাচ্ছে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোতেও। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রধান নির্বাচনে যুক্তরাজ্যের প্রতিযোগীকে হারিয়ে প্রধান হিসেবে নির্বাচিত হন চীনের প্রভাবাচ্ছন্ন ইথিওপিয়ার প্রার্থী। জাতিসংঘের ১৫টি মূল সংস্থার চারটিতেই চীন তাদের প্রভাবে থাকা প্রার্থীকে নির্বাচিত করে রেখেছে। ২০১৯ সালে খাদ্য ও কৃষি সংস্থার নির্বাচনে ক্যামেরুনের প্রার্থী হঠাৎ করেই নিজেকে সরিয়ে নেয়, যার ফলে চীনের প্রার্থী ফরাসি প্রার্থীকে হারিয়ে প্রধান হিসেবে মনোনীত হয়। বিনিময়ে ক্যামেরুনের ৭৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ঋণ মওকুফ করে দেয় চীন। 

জাতিসংঘের মানবাধিকার কাউন্সিলেও চীনের এই প্রভাব বিস্তার লক্ষ্য করা যায়। ২০১৯-এর জুলাইয়ে উইঘুর মুসলিমদের ওপর চীনের আচরণকে সমালোচনা করে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে পশ্চিমা ২২টি রাষ্ট্র। তার জবাবে ৫০টি রাষ্ট্র পশ্চিমা দেশগুলোর বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ দাখিল করে মানবাধিকারকে রাজনীতিকরণ করার জন্য। একটি মুসলিমপ্রধান রাষ্ট্রও চীনের সমালোচনা করতে সাহস করেনি। পূর্ব ইউরোপসহ অন্যান্য অঞ্চলের উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলোও চীনের ঋণ থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কায় চীনের পক্ষে মত দিয়েছে অথবা চুপ থেকেছে। 

তাইওয়ান ইস্যু, হংকংয়ের ওপর চাপ, গালওয়ান ভ্যালিতে ভারতের সৈন্যদের সাথে সংঘর্ষ কিংবা দক্ষিণ চীন সাগরে ক্রমাগত চীনের প্রভাব বিস্তার বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলোকে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকতে বাধা দিচ্ছে। দেশগুলোকে যেকোনো একপক্ষ বেছে নিতে হচ্ছে নিজের স্বার্থের জন্য। চীন যে তাদের অর্থনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিশ্বের ওপর প্রভাব আরও বাড়াবে, তা বলাই বাহুল্য। যুক্তরাষ্ট্র এর প্রত্যুত্তর কীভাবে দেবে, তার ওপরেই নির্ভর করছে অনেক হিসাবনিকাশ। এ রকম অবস্থায় ইতালীয় মার্ক্সিস্ট আন্তোনিও গ্রামসির একটি কথা স্মরণ করা যায়: ‘পুরোনো পৃথিবী মারা যাচ্ছে, আর নতুন পৃথিবী সংগ্রাম করছে জন্ম নেওয়ার। এখন সময় কেবল দানবদের।’ 

সৌজন্যে- টিবিএস।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।