Home ধর্মতত্ত্ব ও দর্শন ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য ইখলাসের গুরুত্ব

ইবাদত কবুল হওয়ার জন্য ইখলাসের গুরুত্ব

।। আল্লামা মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ।।

আল্লাহ তাআলা মানুষ সৃষ্টি করেছেন তাঁর ইবাদত করার জন্য। ইবাদত অর্থ তাঁর আনুগত্য করা। তিনি যা করতে আদেশ করেছেন, তা পালন করা এবং যা করতে নিষেধ করেছেন, তা বর্জন করা। যেমন, তিনি তাঁর একত্ববাদের উপর পূর্ণ বিশ্বাস রাখতে বলেছেন, র্শিক বা তাঁর সমপর্যায়ের অংশীদার কেউ আছে- এ ধরনের বিশ্বাস থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকতে বলেছেন। শুধু এতটুকু বলেই আল্লাহ তাআলা ক্ষান্ত হননি।

তিনি ইরশাদ করেছেন, আমি শিরকের গুনাহ কখনো ক্ষমা করব না খালেস তওবা ছাড়া। আর এটি আল্লাহ তাআলার সাথে যতগুলো নাফরমানী আছে তার মধ্যে সবচেয়ে জঘন্যতম। নামায, রোযা করতে বলেছেন, অন্যায় অশ্লীলতা, চুরি, ডাকাতি, যিনা, মদ্যপান, জুলুম, নির্যাতন ইত্যাদি থেকে দূরে থাকতে বলেছেন।

বস্তুত নামায, রোযা, হজ্ব, যাকাত ইত্যাদি ইবাদত পালন করলেই কি সেগুলো মকবুল ইবাদতে গণ্য হবে? মানুষের চলাচলের জন্য কেউ একটি রাস্তা তৈরি করে দিল, একটি পুল নির্মাণ করে দিল, একটি মসজিদ বা মাদ্রাসা নির্মাণ করে দিল। তাতেই কি তার আমলনামায় বেহিসাব সাওয়াব জমা হতে থাকবে? আল্লাহ তাআলা তার প্রতি খুশি হয়ে তার সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিবেন? না, এসব পুণ্যের কাজ মকবুল ইবাদতে গণ্য হবে না- যতক্ষণ পর্যন্ত না এই কাজে তার নিয়্যাত সঠিক হবে। কারণ, প্রতিটি কাজেরই ফলাফল নির্ভর করে নিয়্যাতের উপর। আল্লাহ তাআলা নিয়্যাতের উপরই ফলাফল নির্ধারণ করবেন।

মানুষের সৃষ্টিগত স্বভাব হলো, সে যে কোন একটি উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে কাজে অগ্রসর হয়। তার উদ্দেশ্য যদি হয় এই আমল দ্বারা আল্লাহ তাআলার সন্তুষ্টি অর্জন, রাসূলুল্লাহ (সা.)এর খুশনুদি লাভ, তাহলে সে তার নিয়্যাত অনুযায়ী সাওয়াব ও ফযীলত পাবে। পক্ষান্তরে তার নিয়্যাত যদি সেরূপ না হয়, তাহলে সে সাওয়াব থেকে বঞ্চিত হবে। কোন কোন ক্ষেত্রে কঠিন আযাবেরও সম্মুখীন হবে।

যেমন আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন, নামায কায়েম করতে। এখন যদি কোন লোক নামায আদায় করে আল্লাহর হুকুম রক্ষা করার জন্য, তাকে খুশি করার জন্য, তাহলে সে সাওয়াব পাবে। আর যদি এই নামায আদায় করে মানুষকে দেখানোর জন্য অথবা কোন হীনস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য, তাহলে সে কোন সাওয়াবের অধিকারী তো হবেই না, উপরন্তু আল্লাহর ভীষণ আযাবের সম্মুখীন হবে।

আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘ওয়ায়েল’ দোযখ এমন নামাযীদের জন্য, যারা নামাযের ব্যাপারে গাফেল (উদাসীন), যারা মানুষকে দেখানোর জন্য নামায পড়ে। (সূরা মাঊন, ৪-৫ আয়াত)।

আরও পড়তে পারেন-

উপর্যুক্ত আয়াতে যাদের কথা বলা হয়েছে, তারা হলো মুনাফিক। আর মুনাফিকদের জন্য আল্লাহ তাআলা সবচে নিকৃষ্টতম দোযখ রেখে দিয়েছেন।

কাজেই নিয়্যাত সঠিক হতে হবে। নিয়্যাত সঠিক করার জন্য দু’টি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রাখতে হবে। প্রথমত কাজ করার পূর্বে উদ্দেশ্য স্থির করতে হবে। লক্ষ্যহীন অবস্থায় কোন কাজ করা যাবে না। দ্বিতীয়তঃ উদ্দেশ্য স্থির হওয়ার পর দেখতে হবে, এ কাজে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)এর সম্মতি আছে কি-না। আল্লাহ ও আল্লাহর রাসূল তাতে সন্তুষ্ট হবেন কি-না।

হযরত ইমাম গাজালী (রহ.) একটি উপমা দিয়েছেন। আতর, কেউ যদি শুধুমাত্র সুঘ্রাণের জন্য ব্যবহার করে, তাহলে এতে গুনাহ্ও নেই সাওয়াবও নেই। পক্ষান্তরে কেউ যদি রাসূলুল্লাহ (সা.)এর সুন্নাত, তিনি আতর ব্যবহার করতেন এ নিয়্যাতে ব্যবহার করে, তাহলে বিপুল সাওয়াবের অধিকারী হবে। আবার কেউ যদি আতর ব্যবহার করে নিজের অহংকার প্রকাশ করার জন্য, তাহলে গুনাহ্গার হবে। উপরে তিনটি প্রেক্ষাপটে আতরের সুঘ্রাণ কিন্তু একই ছিল, শুধুমাত্র নিয়্যাতের কারণে এই পার্থক্য।

রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ক্বিয়ামতের দিন বিচারের জন্য এক ব্যক্তিকে হাজির করা হবে। যিনি শাহাদাত বরণ করে ছিলেন। আল্লাহর যেসব নিয়ামত তিনি উপভোগ করেছেন সেগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে জিজ্ঞাসা করা হবে, তুমি এসব নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা আদায় করেছ কি? আর শুকরিয়া স্বরূপ কী কী কাজ করেছ? উত্তরে তিনি বলবেন, হে আমার প্রতিপালক! আমি তোমার দ্বীনের জন্য নিজের জীবন পর্যন্ত কুরবান করেছি। জিহাদে শামিল হয়ে তোমার ইসলামের জন্য জীবন উৎসর্গ করতেও কুণ্ঠাবোধ করিনি। তখন আল্লাহ তাআলা বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ, তুমি আমার জন্য, আমার দ্বীন ইসলামের জন্য জিহাদ করেনি। তুমি জিহাদ করেছ নিজের নাম-যশের জন্য, তোমাকে মানুষ বীর বলবে এ জন্য। কাজেই তোমার পুরস্কার আমার কাছে নেই। অতঃপর ফেরেশতাগণ তাকে টেনে হেঁচড়ে দোযখে নিক্ষেপ করবে।

এরপর আনা হবে একজন আলেমকে। তাকে আল্লাহ তাআলা জিজ্ঞাসা করবেন- তুমি কিভাবে আমার শোক্র আদায় করেছ? তিনি বলবেন, হে আল্লাহ্! আমি আজীবন আপনার কুরআন এবং আপনার রাসূলের হাদীস নিজে শিক্ষা করেছি এবং মানুষকে শিক্ষা দিয়েছি। এসবই আপনার সন্তুষ্টির জন্য।

আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যা বলছ। তোমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষ তোমাকে আলেম বলবে, ক্বারী বলবে, হাফেয বলবে। মাওলানা সাহেব বলে সম্মান করবে। এসব তুমি দুনিয়াতে পেয়েছ। তুমি আমার ইসলামের জন্য কিছুই করনি। কাজেই আমার নিকট তোমার কোন পুরস্কার নেই। অতঃপর ফেরশ্তাগণ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবে।

এরপর হাজির করা হবে একজন দানশীল ধনীকে। তাকেও অনুরূপ প্রশ্ন করা হবে। সে উত্তরে বলবে, হে দয়াময়! যেসব ক্ষেত্রে দান করলে তুমি খুশি হও, তোমার রাসূল খুশি হন, সে সব ক্ষেত্রে আমি দান করেছি। এতে উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র তোমার এবং তোমার রাসূলের সন্তুষ্টি। আল্লাহ বলবেন, তুমি মিথ্যাবাদি। তোমার নিয়্যাত ছিল, তোমাকে মানুষ দাতা বলুক, তোমার সুনাম-সুখ্যাতি হোক। সত্যিকারভাবে তুমি আমার জন্য কিছুই করনি। কাজেই আমার নিকট তোমার জন্য কোন পুরস্কার নেই। অতঃপর ফেরেশ্তাগণ তাকে দোযখে নিক্ষেপ করবে। (মুসলিম শরীফ)।

মূলত আল্লাহ তাআলা বাহ্যিক দিক থেকে বিচার করবেন না। তিনি দেখবেন ভিতর অর্থাৎ অন্তরে কী আছে। কাজেই নিয়্যাত সঠিক হতে হবে। তাহলেই সাওয়াব পাওয়া যাবে। যেমন মনে করুন, মসজিদে শয়ন করা, রাত্রিযাপন করা নিষিদ্ধ। কিন্তু যদি কেউ ই’তিক্বাফের নিয়্যাতে রাতযাপন করে, তাহলে সেটি ইবাদতে পরিণত হয়ে যায়।

মোটকথা, নিয়্যাতে ইখলাস থাকতে হবে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “এবং তাদেরকে নির্দেশই দেওয়া হয়েছে, যেন তারা ইখলাসের সাথে ইবাদত করে।” (সূরা বায়্যিনাত- ৫ আয়াত)।

একই সূরার ২ ও ৩ নং আয়াতে ঘোষিত হয়েছে- “আপনি নিষ্ঠার সাথে আল্লাহর ইবাদত করুন। জেনে রাখুন, নিষ্ঠাপূর্ণ ইবাদত আল্লাহ্রই নিমিত্ত”।

খুলুসিয়্যাত বা নিষ্ঠানুপাতে আল্লাহর নিকট আমল গৃহীত হয়, গণনার মাধ্যমে নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন- “আমি ক্বিয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদ- স্থাপন করব। সুতরাং কারও প্রতি জুলুম হবে না।” (সূরা আম্বিয়া- ৪৭)।

অর্থাৎ ক্বিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা দাঁড়িপাল্লা স্থাপন করবেন। সে দাঁড়িপাল্লায় আমল ওজন করা হবে। এতেই বোঝা গেল, আমলের সংখ্যা গণনা করা হবে না। দেখা হবে আমলের মধ্যে ওজন কতটুকু আছে। অর্থাৎ খুলুসিয়্যাত কতটুকু আছে। রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন- ইখলাস আমার এক গুপ্ত রহস্য। আমি এটিকে আমার প্রিয় বান্দাদের অন্তরে আমানত রেখেছি।

ইখলাসের অর্থ হলো, ইবাদত শুধুমাত্র আল্লাহর জন্য হবে। আর এই বিশ্বাস যদি অন্তরে দৃঢ় থাকে, তাহলে আল্লাহ তাআলা তার আমলকে এমন পবিত্র করে দিবেন যেমন রক্ত এবং গোবরের মধ্য থেকে দুধ আলাদা করা হয়। কোন আমল যদি রিয়া মুক্ত হয় এবং শুধুমাত্র আল্লাহ তাআলার জন্য করা হয়, তবেই সেটিকে খালেস আমল বলা যাবে।

কেউ কেউ বলেন, এটিই ইখলাস যে, নিজের ইখলাসও দেখতে পাবে না। যে ব্যক্তি নিজের ইখলাসের মধ্যে ইখলাস দেখতে পাবে, তার ইখলাসের জন্যই ইখলাসের প্রয়োজন। আবার হযরত সাহল (রহ.) বলেন, বান্দার যাবতীয় কাজকর্ম, উঠাবসা শুধুমাত্র আল্লাহর উদ্দেশ্যে হওয়ার নামই ইখলাস।

হযরত ফুযাইল (রহ.)এর মতে মানুষের কারণে আমল ত্যাগ করা রিয়া। আর মানুষের জন্য আমল করা র্শিক। আর এ দু’টি অবস্থা থেকে নিরাপদ থাকাই ইখলাস। আল্লাহ আমাদের সকলকে ইখলাসের সাথে আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

লেখক: মুহতামিম, আল জামিয়াতুল আহলিয়া দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।