Home ইতিহাস ও জীবনী হেজাজ রেলওয়ে: মুসলিম বিশ্বকে এক সুতায় বাঁধার যে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে

হেজাজ রেলওয়ে: মুসলিম বিশ্বকে এক সুতায় বাঁধার যে স্বপ্ন অধরাই থেকে গেছে

জর্ডানের রাজধানী আম্মানের ধূলোমলিন সদর রাস্তা থেকে হেজাজ রেলওয়ে স্টেশন চোখে পড়ে না। শহরের অনেকগুলো গোলকধাঁধাতুল্য সর্পিল পথ পেরোনোর পরই দেখা পাবেন এ স্টেশনের।

শহর থেকে হেজাজ রেলওয়ে স্টেশনের দূরত্ব মাত্র পাঁচ কিলোমিটার। কিন্তু আম্মানের তীব্র যানজটের কারণে সেখানে পৌঁছাতে অনেকক্ষণ লেগে যায়।

তবে যানজট জয় করে পাথর-নির্মিত হেজাজ রেলওয়ে স্টেশনে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হবে হঠাৎ যেন অন্য কোনো পৃথিবীতে, অন্য কোনো যুগে চলে এসেছেন। এই জগতে এখনও স্টিম ইঞ্জিন বা বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত ট্রেন চলে। 

এই রেললাইন নির্মাতার স্বপ্ন ছিল গোটা মুসলিম বিশ্বকে এক সুতায় বাঁধা।

১৯০০ সালের পয়লা সেপ্টেম্বর সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদের আদেশে ১ হাজার ৩২০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের এই হেজাজ রেলওয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করে অটোমান কর্তৃপক্ষ। 

সে সময় হজযাত্রীরা পবিত্র মক্কায় সফর করতেন উটের কাফেলায় করে। মক্কায় পৌঁছতে তাদের লেগে যেত কয়েক সপ্তাহ।

হজযাত্রীদের সফর নিরাপদ করতে ও তাদের কষ্ট লাঘবের উদ্দেশ্যে ‘দ্য হেজাজ রেলওয়ে’ প্রকল্প হাতে নেন অটোমান সাম্রাজ্যের (বর্তমান তুরস্ক) সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। ১৯০৮ সালে এ রেললাইনের নির্মাণকাজ শেষ হয়।

হেজাজ রেলওয়ের স্বপ্নদ্রষ্টা সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। ছবি: সংগৃহীত ।

ওই সময় দামেস্ক থেকে মক্কায় পৌঁছতে অন্তত ৪০ দিন লাগত। সফরকালে শুষ্ক মরু আর পাহাড়ি পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মারা যেতেন বহু হজযাত্রী। হেজাজ রেলওয়ে নির্মাণের পর এই ৪০ দিনের সফর নেমে আসে মাত্র ৫ দিনে।

সব মুসলমানের সম্পত্তি

হেজাজ রেলওয়ে লাইনের দামেস্ক-মদিনা অংশের নির্মাণ সম্পূর্ণ হওয়ার পর একে অটোমান সালতানাতের রাজধানী কনস্টান্টিনোপোল (বর্তমান ইস্তাম্বুল) পর্যন্ত বাড়ানোর কাজ শুরু হয়। এভাবে এ রেলপথ উত্তরে ইস্তাম্বুল থেকে দক্ষিণে পবিত্র মক্কা পর্যন্ত যোগাযোগ স্থাপন করে। কিন্তু মুসলিম বিশ্বের কাছে এই রেলওয়ে প্রকল্পের তাৎপর্য তারচেয়েও অনেক বেশি।

এই অসাধারণ যোগাযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের পুরোটাই আসে বিশ্বের নানা প্রান্তের মুসলিমদের অনুদান, অটোমান সালতানাতের আয় ও নাগরিকদের কর থেকে। এক পয়সাও বিদেশি বিনিয়োগ বা সহায়তা নেয়া হয়নি এ প্রকল্পে।

এমনকি রেললাইন নেয়ার জন্য যেসব কৃষকের জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, তারাও অটোমান সাম্রাজ্যের দেয়া ক্ষতিপূরণ নিতে রাজি হননি। অটোমান সৈন্যরা (আরব ও তুর্কি) এই রেলপথ নির্মাণে দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম। 

এ প্রকল্পে অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিরা এমনই উৎসাহে কাজ করেছেন যে, প্রতি বছর তারা ২৮৮ কিলোমিটার রেল ট্র্যাক বসাতে পেরেছেন। অথচ ইউরোপীয় রেলওয়ে বিশেষজ্ঞরা ঘোষণা দিয়েছিলেন, বছরে ১০০ কিলোমিটারের বেশি ট্র্যাক বসানো সম্ভব হবে না কিছুতেই। 

আর এই কারণেই আজও এই রেলপথটি বিবেচিত হয় ‘ওয়াকফ’ হিসেবে। ‘ওয়াকফ’ হলো এমন সম্পত্তি, যার ওপর বিশ্বের সব মুসলমানের অধিকার রয়েছে।

ছবি: সংগৃহীত।

হেজাজ রেলওয়ের জর্ডানে অংশের মহাপরিচালক জেনারেল উজমা নালশিক বিবিসিকে বলেন, ‘এটা কোনো দেশের, কোনো ব্যক্তির সম্পদ নয়। এটা বিশ্বের সব মুসলিমের সম্পদ। এটা মসজিদের মতো, একে বিক্রি করা যায় না।’

উজমা নালশিক বলেন, ‘ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের মুসলমান এখানে এসে দাবি করে বলতে পারেন যে এই সম্পদে তার অংশ আছে।’

হেজাজ রেলওয়ের গুরুত্ব

হেজাজ রেলওয়ে প্রকল্প ধর্মীয় দিক থেকে যেমন গুরুত্বপূর্ণ ছিল, তেমনি এর রাজনৈতিক গুরুত্ব ও সুফলও ছিল ব্যাপক। এ প্রকল্প শুরুর কয়েক দশক আগে থেকেই প্রতিপক্ষরা অটোমান সালতানাতে ভাঙন ধরাতে শুরু করেছিল।

অটোমান সালতানাতের অন্তর্ভুক্ত তিউনিসিয়ার দখল নিয়েছিল ফ্রান্স, ব্রিটিশরা আগ্রাসন চালিয়েছিল মিশরে। রোমানিয়া, সার্বিয়াও মন্টেনিগ্রোও অটোমান সাম্রাজ্য থেকে স্বাধীন হয়ে যায়।

অটোমান সালতানাতের সব মানুষকে একত্রিত করে শুধু বিশ্বের মুসলিমদেরই নয়, নিজ সালতানাতকেও এক সুতায় বাঁধতে চেয়েছিলেন সুলতান দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তার সেই প্রচেষ্টা আলোর মুখ দেখেনি। ১৯০৮ সালে হেজাজ রেলপথে দামেস্ক থেকে মদিনায় প্রথম ট্রেনযাত্রা শুরু হওয়ার পরের বছরই ক্ষমতাচ্যুত হন দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ। তারপর তো কালের পরিক্রমায় অটোমান সাম্রাজ্যই ইতিহাসের গর্ভে হারিয়ে গেল।

অটোমান সাম্রাজ্য যেভাবে ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে, তেমনি হেজাজ রেলপথটিও এখন হয়ে গেছে পাঁচটি দেশের অংশ। রেলপথটি এখন তুরস্ক, সিরিয়া, জর্ডান, সৌদি আরব ও ইসরায়েলের বুক চিরে চলে গেছে।

১৯১৪ সাল পর্যন্ত বছরে ৩ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া হেজাজ রেলওয়ে নির্মাণের পর এক দশক পর্যন্ত নিজের গুরুত্ব ধরে রাখে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কারণে এ রেলওয়েকে বলা হতো ‘দি আয়রন সিল্ক রোড’। ওই অঞ্চলের মানুষের সমন্বিত উদ্যোগের সর্বশেষ উদাহরণ হেজাজ রেলওয়ে প্রকল্প।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তুরস্কের সেনাবাহিনী এই রেলপথ ব্যবহার করা শুরু করলে ‘লরেন্স অভ অ্যারাবিয়া’খ্যাত ব্রিটিশ অফিসার টিই লরেন্স ও বিদ্রোহী আরব যোদ্ধারা এর ওপর উপর্যুপরি হামলা চালায়।

যুদ্ধের পর ব্রিটিশ ও ফরাসিরা পূর্ব ভূমধ্যসাগরের লেভান্ত অঞ্চলের পুনর্দখল নেয়। সে সময় তারা গুরুত্ব দিয়ে এই ক্ষতিগ্রস্ত রেললাইনের পুনঃসংস্কার করে। 

হেজাজ রেলওয়ের বর্তমান হাল-হকিকত

বর্তমানে আম্মানের মূল স্টেশনে অলস দাঁড়িয়ে থাকে ‘রঙিন’, ‘নীরব’ বাষ্পীয় রেল ইঞ্জিন। স্টেশনের জাদুঘরে এই রেলওয়ে-সংক্রান্ত নানা জিনিস—পুরনো টিকিট, ছবি, লন্ঠন—সাজিয়ে রাখা হয়েছে দর্শনার্থীদের জন্য। একটি বগি সংস্কার করা হয়েছে। বিলাসবহুল ভেলভেট চেয়ার আর সোনালি রঙের বাতিতে সজ্জিত সেই বগি দাঁড়িয়ে আছে শতবর্ষ আগের ঐশ্বর্যের সাক্ষী হয়ে।

এই রেললাইন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর গবেষক শেখ আলী আতানতাভি লিখেছিলেন: ‘হেজাজ রেলওয়ের গল্পটা সত্যিই মর্মান্তিক। লাইন আছে কিন্তু ট্রেন চলে না…স্টেশন আছে কিন্তু যাত্রী নেই।’

তবে হেজাজ রেলওয়ের গল্প শুধু ভুল আর দীর্ঘশ্বাসেই আটকে নেই। বিগত বছরগুলোতে রেলওয়েটির কিছু অংশ সংস্কার করা হয়েছে। ২০১৬ সালে হেজাজ রেলওয়ের হাইফা থেকে বেইত শিয়ন পর্যন্ত অংশ পুনর্নির্মিত করে সেই অংশে ট্রেন চলাচল শুরু করে ইসরায়েল।

আরও পড়তে পারেন-

২০১১ সালে আম্মান থেকে দামেস্ক পর্যন্ত এই লাইনে ট্রেন চলত। লাইনটি তখন স্থানীয়দের কাছে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ওই সময় আম্মানের লোকজন এই রেলে চেপে ‘সাপ্তাহিক ছুটি কাটাতে’ সিরিয়া চলে যেত। 

জর্ডানের নাগরিকরা এখনও এই রেলপথের দুটি অংশ ব্যবহার করতে পারে। এখন অবশ্য গ্রীষ্মের সময় মরুর বুক চিরে বাষ্পীয় ইঞ্জিনচালিত একটি ট্রেন চলে। এটি চলে মূলত পর্যটকদের জন্য।

এছাড়াও আম্মান থেকে আল জাজ্জাহ স্টেশন পর্যন্ত সপ্তাহে একদিন ট্রেন চলে। এই সাপ্তাহিক ট্রেনটি সারা বছরই চলে। কিছু কিছু অংশে এই ঐতিহাসিক ট্রেন আধুনিক রেললাইনের পাশ দিয়ে যায়।

বস্তুত স্থানীয়রা এই রেলওয়েকে এখন অনেকটাই চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহার করেন।

মরে যায়নি পুনর্জীবিত করার আশা 

বর্তমানে মূলত পর্যটন ও চিত্তবিনোদনের জন্য ব্যবহৃত হলেও হেজাজ রেলওয়েকে ট্র্যাককে ফের জীবিত করে তোলার আশা মরে যায়নি। সংশ্লিষ্টদের আশা, এই রেলওয়ে আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

উজমা নালশিক জানান, এই রেলপথটির ব্যবহারিক গুরুত্ব রয়েছে। প্রতিদিন ৬ লাখ মানুষ প্রতিদিন যারকা থেকে আম্মানে যাতায়াত করেন। শহর দুটির দূরত্ব ৩০ কিলোমিটার। মানুষের যাতায়াতের সুবিধার জন্য এই দুই শহরে ফের হেজাজ রেলওয়ে চালু করা যায় কি না, তা নিয়ে গবেষণা চলছে।

নালশিক বলেন, ‘হেজাজ রেলওয়ের ইতিহাসের সঙ্গে মানুষকে পরিচিত করানোও একটি উদ্দেশ্য। অনেক মানুষই এখান দিয়ে যায়, কিন্তু জানে না যে ১১০ বছরের পুরনো একটি স্টেশন এখানে এখনও চালু রয়েছে। আমি একে জর্ডানের টুরিস্ট ম্যাপে অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা করছি।’

এছাড়াও এই রেলওয়েকে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার লক্ষ্যও রয়েছে।

২০১৫ সালে সৌদি আরব একে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখে। যদিও সৌদি আরব জর্ডানের মতো তাদের অংশের রেললাইন সংস্কার করে চালু করেনি। তবে এই রেললাইন নিয়ে তাদের একটি ছোট জাদুঘর রয়েছে। 

বর্তমান প্রেক্ষাপটে সিরিয়া থেকে যাত্রী নিয়ে সৌদি আরবে কোনো ট্রেন যাবে, এই চিন্তাই মাথায় আনা কঠিন। তবে হেজাজ রেলওয়ের ঐতিহ্য ও ইতিহাস যতদিন অক্ষুণ্ণ রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকবে, এই রেলওয়ে নতুন করে চালু হওয়ার সম্ভাবনাও ততদিন টিকে থাকবে। [টিবিএস-এর সৌজন্যে]


  • বিবিসি হিন্দি ও ডেইলি সাবাহ থেকে অনূদিত।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।