Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ন্যাটোর সম্প্রসারণ যুদ্ধের সূচনা করবে; ভবিষ্যদ্বাণী ছিল অনেকের

ন্যাটোর সম্প্রসারণ যুদ্ধের সূচনা করবে; ভবিষ্যদ্বাণী ছিল অনেকের

।। টেড গ্যালেন কার্পেন্টার ।।

ন্যাটো জোট ও মস্কোর মধ্যকার উদ্বেগজনক সম্পর্কের আগুনে পেট্রোল ঢেলে দিয়েছে ইউক্রেনে আগ্রাসন। করে তুলেছে আরও বিপজ্জনক। রাশিয়ার সাথে পশ্চিমা বিশ্বের ‘কোল্ড ওয়ার’ তাই এখন হয়ে উঠেছে উত্তপ্ত। সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর জন্য রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনই শুধু দায়ী নন, ন্যাটোর গোয়ার্তুমি আর অপরপক্ষের মতামতের প্রতি অবজ্ঞার নীতিও সমান দায়ী।

আমেরিকার (মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র) পররাষ্ট্রনীতির বাস্তবমুখী ও সংযত ঘরানার বিশ্লেষকরা গেল ২৫ বছর ধরে আজকের মতো সংকটের ব্যাপারেই সতর্ক করে এসেছেন। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক জোটের (ন্যাটো) আরও পূবমুখী অগ্রসর হওয়া, আরেকটি বৃহৎ শক্তির ঘরের এত কাছে অবস্থানের ব্যাপারে তারা আগেই সতর্কবাণী দিয়েছিলেন। বলেওছিলেন, এর পরিণতি ভালো হবে না কোনোমতেই। ইউক্রেন যুদ্ধ তাদের পূর্বাভাসের সত্যতাকেই প্রমাণ করছে।

ইউক্রেন সংকটের পর্যালোচনা ও কারণ

১৯৯৪ সালে প্রকাশিত আমার ‘বিয়ন্ড ন্যাটো: স্টেয়িং আউট অব ইউরোপস ওয়ারস’ শীর্ষক বইয়ে লিখেছিলাম, “রাশিয়ার বিরাগভাজন না হয়ে ন্যাটোকে পূবদিকে বিস্তার করা অসম্ভব। সবচেয়ে সংযত পরিকল্পনা নিলেও দিনশেষে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সীমান্তে হাজির হবে এই জোট। কিন্তু, আরও উচ্চাভিলাষী লক্ষ্যের আওতায় কার্যত রাশিয়ান ফেডারেশনকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলার পরিকল্পনা রয়েছে।”

উল্লেখ্য, ওই সময়ে ন্যাটোর সম্প্রসারণকে নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটনে আয়োজিত পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক সম্মেলনগুলোয় কেবলমাত্র একটি সম্ভাবনা হিসেবে আলোচনা চলছিল। তখনই বলেছিলাম, “এমনটা করলে রাশিয়াকে অহেতুক উত্তেজিত করা হবে।”

তবে নীতি গবেষকদের অজানা ছিল, গোপনে গোপনে সাবেক ওয়ারশ প্যাক্টভুক্ত দেশগুলোকে ন্যাটোতে সদস্যপদ দেওয়ার নিয়তিনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে বিল ক্লিনটনের প্রশাসন। এরপর অচিরেই পোল্যান্ড, চেক রিপাবলিক ও হাঙ্গেরিকে ন্যাটোতে যোগদানের আমন্ত্রণ জানায় আমেরিকা। ১৯৯৮ সালে নর্থ অ্যাটলান্টিক ট্রিটিতে এসব দেশের যোগদানের অনুমোদন দেয় মার্কিন সিনেট। তারপর আরও কয়েক দফায় এমন সদস্য রাষ্ট্রের সংখ্যা বাড়ানো হয়।

প্রথম দফাতেই চটেছিল রাশিয়া, ক্ষোভ নিয়ে রাখঢাকও করেনি। এব্যাপারে তার আত্নজীবনীতে ক্লিনটন প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেডেলিন অলব্রাইট লিখেছেন, “রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলেৎসিন এবং তার দেশবাসী ন্যাটো সম্প্রসারণের চরম বিরোধী—তারা একে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ইউরোপকে বিভাজনকারী ভূ-রাজনৈতিক ভারসাম্যের সীমানা আরও পূবে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন, যাতে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন।”

একই কথা বলেছেন সাবেক মার্কিন উপ-পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্ট্রোবে ট্যালবট। তিনি রুশ মনোভাবের বর্ণনায় বলেন, “বেশিরভাগ রাশিয়ান ন্যাটোকে স্নায়ুযুদ্ধের হাতিয়ার মনে করেন, যা তাদের দেশের বিরুদ্ধে গঠন করা হয়েছিল। তাদের দাবি, তারা ওয়ারশ প্যাক্ট (সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট) ভেঙে দিয়েছে, চাইলে পশ্চিমা দুনিয়াও সেই রাস্তায় হাঁটতে পারে। কেন পশ্চিমারা তা করছে না?- এই প্রশ্নই তারা তুলছে।”

নিঃসন্দেহে প্রশ্নটি অসাধারণ ও যৌক্তিক। কিন্তু ক্লিনটন প্রশাসন বা পরবর্তী মার্কিন সরকারগুলোর কেউই এর গ্রহণযোগ্য উত্তর দিতে পারেনি।

সোভিয়েত প্রভাব বলয়ের বিস্তার রোধে আমেরিকা গ্রহণ করে ‘কন্টেইনমেন্ট পলিসি’। স্নায়ুযুদ্ধের এই পররাষ্ট্রনীতির বুদ্ধিবৃত্তিক জনক জর্জ কেনান ১৯৯৮ সালে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন সিনেটে ন্যাটোর প্রথম দফা সম্প্রসারণের অনুমোদন বাতিলের পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, “এতে নতুন স্নায়ুযুদ্ধের সূচনা হলো। আমি মনে করি, রাশিয়ানরা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণ বিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখাতে থাকবে, এই বিরোধ তাদের রাষ্ট্রীয় নীতিকেও পরিবর্তন করবে। আমার মতে, সিনেটের সিদ্ধান্ত একটি মর্মান্তিক ভুল, যা নেওয়ার কোনো যুক্তি ছিল না। এখন অন্য কেউ আমেরিকা বা তার মিত্রদের (সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো) হুমকি দিচ্ছে না।”

তিনি ভুল বলেননি মোটেও। কিন্তু তাতে কেউ কান দেয়নি। বরং আমেরিকা ও ন্যাটোর অন্য নেতারা সম্প্রসারণের আরও নতুন দফা অব্যাহত রাখলেন। এতে বাল্টিক সাগর তীরবর্তী দেশগুলোকে যুক্ত করে রাশিয়ান ভাল্লুককে গায়ে পড়ে রাগানো হলো। কারণ এসব বাল্টিক দেশ কেবল সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন নয় বরং জারের আমল থেকেই ছিল রুশ সাম্রাজ্যের অংশ। এভাবেই এগিয়ে আসতে আসতে রাশিয়ান ফেডারেশনের ঘাড়ে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে ন্যাটো।

নিজ আঙিনায় ন্যাটোর অনুপ্রবেশে মস্কোর ধৈর্যের বাঁধের দেওয়াল ক্ষয় হতে থাকে। রাশিয়ার পক্ষ থেকে সর্বশেষ বন্ধুত্বপূর্ণ সতর্কবাণী দেওয়া হয় ২০০৭ সালের মার্চে। মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে যোগ দিয়ে পুতিন এসময় ন্যাটোকে সংযত হতে বলেন। পুতিন বলেন, “আমাদের সীমান্তে নিজস্ব শক্তি মোতায়েন করেছে ন্যাটো। এই জোটের সম্প্রসারণ এমন মারাত্মক হুমকি যা দ্বিপাক্ষিক আস্থাকে তলানিতে নামাবে। তাই আমাদের অবশ্যই জানার অধিকার আছে: আসলে কার হুমকি মোকাবিলায় এই সম্প্রসারণ? তাহলে ওয়ারশ প্যাক্ট বিলুপ্তির পর আমাদের পশ্চিমা অংশীদাররা যেসব নিরাপত্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল- তাদের কী কোনো মূল্যই নেই?”

প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ প্রশাসনের সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী রবার্ট এম গেটস তার আত্মজীবনী ‘ডিউটি’ গ্রন্থে তার বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে লিখেছেন, “জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ (সিনিয়র বুশ) হোয়াইট হাউস ছাড়ার পর থেকেই রাশিয়ার সাথে আমাদের সম্পর্ক বাজে রকম অব্যবস্থাপনার শিকার হয়েছে। আমাদের অন্যান্য ভুল পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে, রোমানিয়া ও বুলগেরীয় সরকারের সাথে মার্কিন সরকারের চুক্তি, যার মাধ্যমে দেশদুটিতে অবস্থান করা মার্কিন সেনাদের এক ঘাঁটি থেকে আরেক ঘাঁটিতে সরিয়ে (রাশিয়াকে) অহেতুক উস্কানি দেওয়া হচ্ছে।”

গেটস জোর দিয়েই বলেন, “এরপর জর্জিয়া ও ইউক্রেনকে ন্যাটোভুক্ত করার চিন্তাও অপরিণামদর্শী হবে। এই সিদ্ধান্ত রাশিয়ানরা যাকে অপরিহার্য জাতীয় স্বার্থ মনে করে তাকে গোয়ার্তুমি করে সরাসরি অবজ্ঞার শামিল।”

আরও পড়তে পারেন-

এরপরের বছরেই (২০০৮ সালে) রাশিয়ার নিরাপত্তা বলয়ে ন্যাটোর ক্রমসম্প্রসারণের বিরুদ্ধে মৌখিক অসন্তোষ জ্ঞাপন করে রুশ সরকার। এসময় জর্জিয়ার পশ্চিমাপন্থী সরকারের বিদ্রোহী অঞ্চলে সামরিক অভিযান পরিচালনার অবিবেচক সিদ্ধান্ত মস্কোকে দেশটিতে আগ্রাসন চালানোর সুযোগ করে দেয়। তখন থেকেই জর্জিয়ার বিচ্ছিন্নতাকামী দুটি অঞ্চল (দক্ষিণ ওশেটিয়া ও আবখাজিয়া) কার্যত রাশিয়ার নিয়ন্ত্রণে চলে যায়।

পশ্চিমা সরকারগুলো বিশেষত আমেরিকার জন্য এটাই হওয়ার কথা ছিল সতর্কতার চরম সংকেত। কিন্তু, তারা একের পর এক লাল আলোকে উপেক্ষা করে বেপরোয়া গতিতে চালিয়ে গেছে তাদের মারমুখী সম্প্রসারণ নীতি। ২০১৩ ও ২০১৪ সালে ইউক্রেনের রাজনীতিতে বিস্ময়কর রকম হস্তক্ষেপ করে বসে প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসন। মদদ দেয় রাশিয়াপন্থী একজন প্রেসিডেন্টকে উৎখাতে। এটি ছিল মস্কোকে উস্কে দেওয়ার সবচেয়ে দুঃসাহসী সিদ্ধান্ত। আর তখনই উত্তেজনার পারদ সর্বোচ্চ সীমায় পৌঁছায়। তারই পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ইউক্রেনের ক্রিমিয়া উপদ্বীপ দখল করে নেয় ক্রেমলিন। আর তাদের প্রতিশোধের আকাঙ্ক্ষাই নতুন স্নায়ুযুদ্ধের দুয়ার খুলে দেয়।

ইউক্রেন সংকট কি এড়ানো যেত

গত কয়েক মাসের ঘটনাবলী পূর্ব ইউরোপে একটি যুদ্ধ থামানোর শেষ সুযোগ হারানোকেও তুলে ধরেছে। ন্যাটোর কাছে রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের কয়েকটি দাবি জানিয়েছিলেন পুতিন। বিশেষ করে, জোটটি যেন পূর্ব ইউরোপে তাদের ক্রমবর্ধমান সামরিক উপস্থিতি কমায় এবং ইউক্রেনকে কখনো ন্যাটোর সদস্য না করে সেই গ্যারান্টি চান। এসব দাবি আদায়ের জন্যেই ইউক্রেনের সীমান্তে বিপুল সেনা সমাবেশ ঘটান রুশ প্রেসিডেন্ট।

কিন্তু, পশ্চিমাদের থেকে অর্থপূর্ণ ছাড় পাওয়ার এসব দাবির বিপরীতে বাইডেন প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া ছিল একইসাথে অস্পষ্ট ও এড়িয়ে চলার শামিল। আর তখনই পুতিন পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করার সিদ্ধান্ত নেন। ইউক্রেনকে ন্যাটোর রাজনৈতিক ও সামরিক দাবার গুটি বানাতে চাওয়ার ইচ্ছের কারণেই দিনশেষে ইউক্রেনীয় জনতাকে চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।

ইউক্রেন ট্র্যাজেডি

ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সোভিয়েত ইউনিয়ন পতনের পর পরবর্তী দশকগুলোয় রাশিয়ার সাথে অন্যায় আচরণ করেছে ওয়াশিংটন, যা ছিল মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির নজিরবিহীন ও সাংঘাতিক ভুল। ন্যাটোর সম্প্রসারণ শেষমেষ বিয়োগান্তক, বিধ্বংসী পরিণতির জন্ম দেবে তাও সহজেই অনুমান করা গেছে। সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষক, কূটনীতিকরা সে ব্যাপারে হুঁশিয়ারিও দিয়েছেন। কিন্তু, তাতে কান দেওয়ার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেনি। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি নির্ধারকদের সেই গোয়ার্তুমি ও অদূরদর্শীতার মূল্যই আজ ইউরোপকে দিতে হচ্ছে।

লেখক: টেড গ্যালেন কার্পেন্টার একজন উদারমনা মার্কিন থিঙ্ক ট্যাঙ্ক ক্যাটো ইনস্টিটিউটের প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক জ্যেষ্ঠ ফেলো। ১৯৮৬ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি ক্যাটোর পররাষ্ট্রনীতি অধ্যয়ন কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। ১৯৯৫ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ছিলেন সংস্থাটির প্রতিরক্ষা ও পররাষ্ট্রনীতি অধ্যয়ন বিভাগের ভাইস-প্রেসিডেন্ট।

মূল লেখা : দ্য গার্ডিয়ান।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।