Home ওপিনিয়ন বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী লুণ্ঠন টিকিয়ে রাখার জায়নবাদী যুদ্ধ

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদী লুণ্ঠন টিকিয়ে রাখার জায়নবাদী যুদ্ধ

ইয়েমেনে বিমান হামলায় আহত এক শিশুকে উদ্ধার করা হচ্ছে। -সংগৃহিত ছবি।

।। জামালউদ্দিন বারী ।।

ইউক্রেন-রাশিয়া দ্বন্দ্ব সৃষ্টি এবং দ্ব›দ্বকে একটি সংঘাতে পরিনত করার প্রেক্ষাপট পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরাই সৃষ্টি করেছে। ইউক্রেনে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের সাজানো ক্যু, অত:পর বশংবদ শাসককে রাশিয়ার প্রতি বিদ্বিষ্ট করে তোলা এবং ন্যাটোর সদস্যভুক্ত করে সেখানে মার্কিনী ও ইউরোপের পরাশক্তির সামরিক উপস্থিতির মাধ্যমে রাশিয়ার জন্য একটি প্রত্যক্ষ হুমকিজনক পরিবেশ তৈরী করা হয়েছে।

রাশিয়ার পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে বলা হয়েছে, তার নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার বিষয়গুলোকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ইউক্রেনের ভূ-রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস পশ্চিমারা ভুলে গেল কী করে? মাত্র তিন দশক আগে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙ্গে আলাদা রাষ্ট্র হিসেবে ইউক্রেনের আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। ইউক্রেন-বেলারুশের মত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো সোভিয়েত ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কারণেই সোভিয়েত ইউনিয়ন ইউরেশিয়া নামে পরিচিতি লাভ করেছিল। নব্বই দশকের শুরুতে রাশিয়া থেকে আলাদা হওয়ার পর থেকেই ইউক্রেনের রাজনীতি ও ভবিষ্যত নিয়ে জায়নিস্ট ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা গভীর ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ইউক্রেনের জনগণ রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতেই বেশী আগ্রহী। বিগত দশকের শুরুতে ভিক্টর ইয়ানুকোভিচ গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার মধ্য দিয়ে তা প্রমানিত হয়। ইসরাইলী জায়নিস্টরা সব সময়ই পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে কাজ করেছে। ভিক্টর ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করতে ২০১৪ সালে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট ৫ বিলিয়ন ডলার খরচ করেছে বলে জানা যায়।

মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের রুশ বিদ্বেষী কর্মকর্তা ভিক্টোরিয়া ন্যুল্যান্ডের নির্দেশনায়, গ্লোবালিস্ট ধনকুবের জর্জ সরোস এবং ইউক্রেনীয় ইহুদি ধনকুবের ইহোর কলোময়োস্কির অর্থায়ন ও পৃষ্ঠপোষকতায় প্রথমে ইয়ানুকোভিচকে গদিচ্যুত করে তদস্থলে একজন ইহুদি পেত্রো পেরোশেঙ্কোকে ক্ষমতায় বসায়। নির্বাচিত হয়েই পেরোশেঙ্কো সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা, সংস্কৃতি ও রাজনৈতিক অধিকারের প্রশ্নে একের পর এক বিতর্কিত আইন প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে থাকে। বিশেষত রুশ ভাষী ও রুশ বংশোদ্ভুত নাগরিকদের অধিকার হরণের মাধ্যমে সেখানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তোলা হয়। ২০১৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে আরো কট্টর ইহুদি, পারিবারিকভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হলোকস্টের ভিক্টিম বলে দাবিদার ভলোদিমির জেলেনস্কি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ন্যাটো ও মার্কিনীদের সাথে তার দহরম মহরম রাশিয়ার জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পেরোশেঙ্কোর সময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ বংশোদ্ভুতদের প্রতি বৈষম্য ও রাজনৈতিক বিদ্বেষ প্রকট আকার ধারণ করলে ২০১৪ সালে ক্রিমিয়ার উপর সামরিক ও রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে রাশিয়া। সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক রুশ বংশোদ্ভুত হওয়ায় সেখানে কিয়েভ প্রশাসনের তেমন কিছু করণীয় ছিল না। জায়নিস্ট ও পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদী নীলনকশার ষড়যন্ত্র স্পষ্ট হয়ে ওঠায় এবারো তার পুনরাবৃত্তির সুযোগ গ্রহণ করেছে রাশিয়া। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান শুরুর আগেই লুহানস্ক ও ডোনেটস্ক এলাকায় রুশ বংশোদ্ভুত বিদ্রোহীরা স্বাধীনতা ঘোষণা করার ২৪ ঘন্টার মধ্যেই প্রেসিডেন্ট পুতিন তাদের স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেন।

পশ্চিমারা ইউক্রেনে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে লক্ষ্যচ্যুত করে সেখানে বশংবদ ইহুদি জায়নবাদীদের বসিয়ে যে রাজনৈতিক সংকট তৈরী করেছে তা এখন পুরো বিশ্বের জন্য নিরাপত্তা হুমকি জনক পরিস্থিতি করেছে। ইউক্রেনে জায়নবাদী ইহুদি শাসক বসিয়ে পূর্ব-পশ্চিমের একটি গুরুত্বপূর্ণ করিডোরের উপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চক্রান্তে লিপ্ত রয়েছে ইসরাইলী শাসকরা। ইউক্রেনে রাশিয়ান আগ্রাসনের শুরুতেই ইসরাইলের শাসকরা মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে চাইছে। একদিকে কিয়েভে নিজেদের বশংবদ শাসক, অন্যদিকে মার্কিনীদের ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন সত্তে¡ও রাশিয়ার সাথে গোপণ সমঝোতা করে চলেছে ইসরাইল। ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক আগ্রাসন শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই ইসারাইলের প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত মস্কোতে গিয়ে হাজির হন। ইউক্রেনের চলমান পরিস্থিতিতে ন্যাটোর তেমন কিছুই করণীয় নেই। ইউক্রেনে ইসরাইলী প্রভাব ঠিক রাখা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অব্যাহত সমর্থন তথা শ্যাম ও কূল দুইই রক্ষা করতে চাইছেন বেনেত। ভøাদিমির পুতিন নাফতালি বেনেতকে যে বার্তা দিয়েছেন, তার প্রেক্ষিতে তিনি জেলেনস্কিকে প্রকারান্তরে রাশিয়ার কাছে আত্মসমর্পনের পরামর্শ দিয়েছেন। যুদ্ধ শুরুর ৫ দিনের মাথায়ই বেলারুশের সীমান্তবর্তী শহর গোমেলে শান্তি আলোচনার শুরুতে রাশিয়ার পক্ষ থেকে যে সব শর্ত দেয়া হয়েছিল তার বেশিরভাগই পুরণ করতে সম্মত হয়েছে ইউক্রেন।

এ সব শর্তের মধ্যে ক্রিমিয়া, লুহানস্ক, ডোনেটস্ক তথা ডনবাস রিজিয়নের স্বাধীনতার স্বীকৃতি ও ন্যাটোতে যোগ না দেয়ার শর্ত ছাড়াও জেলেনস্কির রিজিম বদলের শর্ত ছিল। একজন ইউক্রেনীয় শীর্ষ কর্মকর্তা ক্ষোভের সাথে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেত রাশিয়ার শর্ত মেনে নিতে জেলেনস্কিকে পরামর্শ দিয়েছেন। এ থেকে স্পষ্টই বোঝা যায়, পশ্চিমারা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিলেও তারা ইউক্রেনের পাশে থেকে রাশিয়াকে মোকাবেলা করতে সক্ষম নয়। এ কারণেই ইসরাইল প্রমাদ গুনতে শুরু করেছে। তারা ইউক্রেনে রাশিয়ার কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিজয় নিশ্চিত করার বিনিময়ে নিজেদের নিরাপত্তা সহযোগিতা নিশ্চিত করতে চায়। তবে ইউক্রেনের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় ইসরাইলের মধ্যস্থতা ও পরামর্শ প্রত্যাখ্যাত হয়েছে বলে জানা যায়। দুই কুল রক্ষার চেষ্টা করে ইসরাইল শেষ পর্যন্ত রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অটুট রাখার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে বলে প্রাথমিকভাবে মনে হলেও এ সপ্তাহে ইসরাইলী গণমাধ্যমে প্রকাশিত মতামতগুলো বিশ্লেষণ করলে ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইসরাইলীদের এখনো অস্থিরতা ও দোটানায় ঝুলে থাকতে দেখা যাচ্ছে। ফিলিস্তিন-জেরুজালেম ও মধ্যপ্রাচ্যের উপর পশ্চিমা-জায়নবাদী আগ্রাসনের প্রশ্নে রাশিয়ার মত পরাশক্তির নিরবতা নিস্ক্রিয়তার পেছনে এই গোপণ সমঝোতার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। একইভাবে কাশ্মির এবং আরাকানের মুসলমানদের উপর চরম নির্যাতন, এথনিক ক্লিনজিং-গণহত্যার ঘটনা প্রমানিত হওয়ার পরও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ-রাশিয়া ও চীনের নিরবতা-নিস্ক্রীয়তা থেকে এটাই প্রমান হয়, মুসলমানদের সম্ভাব্য ঐক্য ও উত্থান রুখতে মানসিকভাবে বাকি দুনিয়ার সব শক্তি ঐক্যবদ্ধ।

রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমনের পেক্ষাপটে প্রাচ্য-প্রতীচ্যের রাজনৈতিক লেখক-রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কেউ কেউ একে পূর্ব-পশ্চিমের দ্ব›দ্ব বলে অভিহিত করছেন। এরই মধ্যে মার্কিন ও পশ্চিমাদের মধ্যে কেউ কেউ পশ্চিমা সা¤্রাজ্যবাদের আসল প্রতিপক্ষ হিসেবে রাশিয়া নয় চীনের দিকে অঙুলি তুলেছেন। আসলে কোনো অঞ্চল বা ভূখÐ নয়। এটি একটি অর্থনৈতিক পুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদ। এক সময় সোভিয়েত সমাজতন্ত্রকেই এর প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা হতো। পারমানবিক সমরাস্ত্রের প্রতিযোগিতামূলক ভাÐার গড়ে তোলা এবং পরস্পরের দিকে আইসিবিএম তাক করে রাখা ¯œায়ুযুদ্ধের যুগ সোভিয়েত সমাজতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যাওয়ার পর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক শক্তির ভারসাম্য মার্কিনীদের ঝুলে যায়। সোভিয়েত নেতৃত্বাধীন ওয়ারশ’ সামরিক জোটের অবলুপ্তির পর প্রতিপক্ষ ন্যাটো জোটের বাড়বাড়ন্তের আদৌ কোনো প্রয়োজনীয়তা ছিলনা, নেই। এসব সামরিক জোট এবং নতুন সমর পরিকল্পনা, অর্থনৈতিক রূপরেখা, জ্বালানি ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের কলাকৌশলগুলোকে সামনে এগিয়ে রাখতে গণবিদ্ধংসী মারনাস্ত্র ও রাষ্ট্র দখলকেই যারা তাদের মূল টার্গেট হিসেবে গ্রহণ করেছে, তারা কীভাবে নিজেদের সুসভ্য জাতি বলে দাবী করতে পারে! যারা দেশে দেশে গণতন্ত্র হত্যা করে নিজেদের বশংবদ রাজা, স্বৈরশাসক ও সামরিক একনায়কদের পৃষ্ঠপোষকতা দিচ্ছে তারাই নিজেদের গণতন্ত্রের সোল এজেন্ট-নিশানবরদার দাবী করছে! হিটলারের নাৎসীবাদ বিরোধী যুদ্ধে জয়লাভ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী শক্তি নিজেই একটা নির্মম ফ্যাসিবাদে পরিনত হয়েছে। গোয়েবলসের প্রোপাগান্ডার চেয়ে হাজারগুণ বিস্তৃত, গভীর ও শক্তিশালী প্রোপাগান্ডার আশ্রয় নিয়ে তারা কোটি মানুষের অধিকার হরণ করে চলেছে।

ইউক্রেণ যুদ্ধের শুরুতেই পশ্চিমা প্রোপাগান্ডা মেশিন থেকে রাশান প্রোপাগান্ডার অভিযোগ তোলা হয়েছে। অর্থাৎ যে সব মিথ্যা অভিযোগ সামনে রেখে তারা আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকান দেশগুলোতে সামরিক আগ্রাসন ও দখলদারিত্ব চালাচ্ছে, ইউক্রেনের উপর রাশিয়ার দাবী ও অভিযোগগুলোকেও তারা একই সমান্তরাল মিথ্যা প্রোপাগান্ডা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। বিশ্বের সব অঞ্চলের সম্পদ ও পুঁজি লুন্ঠনের তন্ত্রমন্ত্রগুলোর সুরক্ষা নিশ্চিত করাই হচ্ছে তাদের সব আয়োজনের মূল টার্গেট। প্রথমে তারা জার্মান নাৎসীবাদকে টার্গেট করেছিল, এর পর থেকে নিজেরাই নাৎসীবাদের সব নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে। এরপর তাদের প্রতিপক্ষ সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, সোভিয়েতের পতনের পর ইসলামিক মূল্যবোধ ও সামাজিক-অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে তারা তাদের প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করিয়েছে ।

ইউক্রেন যুদ্ধের পরিনতি যাই হোক, এই যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একদিকে পূর্ব-পশ্চিম ডিভাইড অন্যদিকে পুুঁজিবাদী সা¤্রাজ্যবাদের অর্থনৈতিক শোষনযন্ত্রের ব্যবহার সম্পর্কে বিশ্বের সাধারণ মানুষ ভালমত অবগত হল। এই যুদ্ধে এও প্রমানিত হল, ন্যাটো ও পশ্চিমা যুদ্ধবাদী সামরিক অ্যাপারেটাসগুলো চীন বা রাশিয়ার মত শক্ত প্রতিপক্ষের সাথে যুদ্ধে জড়াতে সাহস করতে না পারলেও সুসভ্য দুর্বল দেশ ইরাক, আফগানিস্তান, সিরিয়া বা ইয়েমেনের প্রাচীন সভ্যতা ও শস্য-শ্যামল মাটিকে পুড়িয়ে দিতে, লাখ লাখ মানুষ হত্যা করতে হাজার হাজার টন গোলাবারুদের যোগান নিশ্চিত করতে একটুও দ্বিধান্বিত হয়নি। রাশিয়ার ইউক্রেন দখল হঠাৎ করেই ঘটেনি। গত দুই দশক ধরে ইঙ্গ-মার্কিন জায়নবাদী চক্র ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়ার সাথে এক নতুন খেলায় মেতে উঠেছিল। তারা মধ্যপ্রাচ্যের মুসলমানদের দমিয়ে রাখতে যেমন জায়নবাদী রাষ্ট্র ইসরাইল সৃষ্টি করেছিল, ঠিক একইভাবে রাশিয়ার উপর একটি স্থায়ী নিয়ন্ত্রণ কাঠামো গড়ে তোলতে ইউক্রেনকেও পশ্চিমা বশংবদ অনুরূপ একটি জায়নবাদী রাষ্ট্রে পরিনত করতে চেয়েছিল। একবিংশ শতকের প্রথম দশকের আদমশুমারী অনুসারে, ইউক্রেনে প্রায় ৪০ ভাগ মানুষ কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেনা। ধর্মবিশ্বাসীদের মধ্যে ৪৬ শতাংশ ইউক্রেনিয়ান অর্থডক্স খ্রিস্টান, ৬ শতাংশ ক্যাথলিক, ২ শতাংশ প্রোটেস্ট্যান্ট, মুসলমান জনসংখ্যা ১ শতাংশের কিছু বেশি এবং ইহুদির সংখ্যা অর্ধ শতাংশের কাছাকাছি। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের পৃষ্ঠপোষকতায় ইয়ানুকোভিচকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর থেকে পর পর দুইজন ইসরাইলী নাগরিকত্ব গ্রহণকারী জায়নবাদী ইহুদি পেরোশেঙ্কো ও জেলেনস্কিকে ইউক্রেনের ক্ষমতায় বসানো হয়েছে। রাশিয়ার ইউক্রেন আক্রমণের পর নাফতালি বেনেতের মিডিয়েশন প্রচেষ্টা এবং মস্কোতে দৌড়ঝাঁপের কারণ এখন অনেকটাই পরিষ্কার।

জাতিসংঘ বা আন্তর্জাতিক কনভেনশন উপেক্ষা করে মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে আমেরিকা ও ন্যাটো জোটের ইরাক-আফগানিস্তান দখলের পর বিশ্বের কোনো দেশ বা আন্তর্জাতিক সংস্থা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার মিত্রদের বিরুদ্ধে কোনো অর্থনৈতিক বা বানিজ্যিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। এমনকি নিন্দা বা আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদও কেউ জানায়নি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের কোনো কার্যকর পন্থা অন্য কোনো পক্ষের হাতে নেই। তাদের হাতে থাকা এসব কৌশলগত অস্ত্র তারা বাকি দুনিয়ার উপর নির্মমভাবে ব্যবহার করে চলেছে। রাশিয়া ইউক্রেন দখল করার চারদিনের মাথায় ইউক্রেনের সাথে শান্তি আলোচনায় বসলেও পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিতে দুইদিনও দেরি হয়নি। অন্যদিকে আফগানিস্তানের সাথে আমেরিকার কোনো সীমান্ত বা দূরবর্তী হুমকিজনক কিছু না থাকলেও আমেরিকা ও ন্যাটো আফগানিস্তান দখল করে নেয়ার ২০ বছর পর প্রতিপক্ষ তালেবানের সাথে সমঝোতা করে সৈন্য ফিরিয়ে নেয়ার পর তারা আফগানিস্তানের পুনর্গঠনে অর্থ-সহায়তা না দিয়ে উল্টো তাদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। এর মানে হচ্ছে, পশ্চিমা যুদ্ধবাদী সাম্রাজ্যবাদের ভিকটিমরাও তাদের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হচ্ছে। পর পর তিন বছর চরম খরার কারণে খাদ্য উৎপাদনে ঘাটতি এবং পশ্চিমা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও সম্পদ আটকের কারণে আফগানিস্তানে দুই কোটির বেশি মানুষ চরম দুর্ভীক্ষ ও মানবিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন। বিশ্বখাদ্য সংস্থার তরফ থেকে আফগানিস্তান ও ইয়েমেনে রেড এলার্ট জারি করা হয়েছে। ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনসহ পশ্চিমা আগ্রাসনের শিকার প্রতিটি জনপদে একই বাস্তবতা বিদ্যমান।

অন্যদিকে ইউক্রেন যুদ্ধের দুই সপ্তাহের মধ্যেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের দেশগুলো হাজার হাজার কোটি ডলারের সহায়তা নিয়ে পাশে দাঁড়াচ্ছে। চলমান বিশ্বের অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার প্রায় পুরোটাই মার্কিনী ও পশ্চিমা কর্পোরেট জায়নবাদীদের হাতে। চীন-রাশিয়া, তার্কি, ইরানসহ বিকল্প শক্তিগুলো সাংহাই কো-অপারেশ চুক্তির মধ্য দিয়ে একটি বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে তোলতে ঐক্যমত্য পোষণ করলেও গত দুই দশকেও তারা ডলারের বিপরীতে বিকল্প কোনো নিজস্ব মূদ্রা ব্যবস্থা বা সুইফ্ট কোডের বিপরীত কোনো আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সিস্টেম গড়ে তুলতে পারেনি। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, ডাবিøউটিও, ফিফা, বিশ্ব-অলিম্পিকের মত সংস্থাগুলোর নিয়ন্ত্রণ পশ্চিমাদের হাতে। অর্থব্যবস্থা, খাদ্য উৎপাদন ও সরবরাহ, জ্বালানি ও তথ্যপ্রযুক্তির নিয়ন্ত্রন ব্যবস্থা পশ্চিমাদের হাতে রেখে চুড়ান্ত যুদ্ধে জয়লাভ করা খুবই কঠিন। ইউক্রেন যুদ্ধের ফলাফল যদি পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাকে বদলে ফেলার লক্ষ্য নির্ধারণে সচেষ্ট ও সক্ষম হয় তাহলে প্রথমেই কর্পোরেট জায়নবাদের নিয়ন্ত্রণে থাকা পুঁজিবাদী লুন্ঠন ব্যবস্থার অবসানকল্পে জাতিসংঘসহ সব বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানকে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় পুনর্গঠনের উদ্যোগ নিতে হবে।

কোনো জাতির রাষ্ট্রীয় স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব কোনো প্রতাপশালী প্রতিবেশীর নিরাপত্তা হুমকি বা সাম্রাজ্যবাদী-আধিপত্যবাদী নীতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে পারে না। আধুনিক বিশ্বে রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তা, একক, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সমন্বয় ও নীতি- কৌশলের সাথে সম্পর্কযুক্ত হয়ে পড়েছে। ইরান বা তুরস্ক বাদে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো, আফ্রিকা ও সাব-সাহারান দেশগুলোসহ তৃতীয় তৃতীয় বিশ্বের অধিকাংশ দেশ রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে কতটা স্বাধীন ও স্বনিয়ন্ত্রিত তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ আছে। সাদা চামড়ার ইউরোপীয় এবং ইসরাইল প্রভাবিত হওয়ায় ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে পশ্চিমারা যে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে তারচেয়ে শতগুণ বিদ্ধংসী ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টিকারী যুদ্ধের বিপরীতে ইউরোপ-আমেরিকানদের একভাগ উদ্বেগ-বিকার দেখা যায়নি। চলতি সপ্তাহে অনুষ্ঠিত ইউরোপীয় পার্লামেন্টের এক বক্তৃতায় একজন আইরিশ সদস্যা ইউক্রেন যুদ্ধ নিয়ে ইউরোপীয়দের অতি মাত্রায় প্রতিক্রিয়া এবং ইরাক, আফগানিস্তান-ইয়েমেন যুদ্ধের মানবিক বিপর্যয়ে তাদের নিরবতা ও নিস্ক্রীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন।

আইরিশ পার্লামেন্টে আরো বেশ কয়েকজন সদস্য ফিলিস্তিনীদের উপর ইসরাইলের বর্ণবাদী শাসকদের নিমর্ম নির্যাতন, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও ভূমি জবরদখলের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে এর বিরুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের শক্ত পদক্ষেপের আহŸান জানিয়েছেন। ইয়েমেনে মানবিক বিপর্যয়ের জন্য ইঙ্গ-মার্কিন, ফরাসি ও সৌদি শাসকদের নির্মম সমঝোতার প্রসঙ্গও তাদের আলোচনায় উঠে আসে।

গত সাত দশকের বেশি সময় ধরে পশ্চিমা সভ্যতা বাকি দুনিয়ার উপর আধিপত্যবাদী আগ্রাসন চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের উপর রাশিয়ান সামরিক হামলার পর ন্যাটোর আগ্রাসী সামরিক থাবা কিছুটা খামোশ হলেও অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞাকে তারা শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছে। মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে ট্রিলিয়ন ডলারের যুদ্ধ বাজেট নিয়ে আফগান, ইরাকি, সিরীয়, লিবীয় ও ইয়েমেনী নিরীহ জনগণের উপর মৃত্যু ও ধ্বংসের ভয়াল বিভীষিকা, দুর্ভীক্ষ ও মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টির দায়ে তাদের উপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা কে দেবে? কোটি কোটি মানুষের অধিকার হরণ, লাখ লাখ মানুষের মৃত্যু ও সভ্যতা ধ্বংসের দায় ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে বিশ্বব্যবস্থার পুর্নগঠন জরুরী হয়ে পড়েছে।

লেখক: সাংবাদিক ও দৈনিক ইনকিলাবের সহকারী সম্পাদক।
ইমেইল-bari_zamal@yahoo.com