Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ ইমরান খানের পতনের জন্য দায়ী তিনি নিজেই

ইমরান খানের পতনের জন্য দায়ী তিনি নিজেই

মিহির শর্মা, ব্লুমবার্গ: আবারও রাজনৈতিক সংকটের মুখোমুখি পাকিস্তান। অবশ্য যে দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত নেতাদের ক্ষমতাচ্যুত হওয়া নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা সেখানে এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

তবে এবারের ঘটনায় কিছুটা অবাক হতেই হয়। যদিও প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান ২০১৮ সালে অল্প ব্যবধানে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়ে নির্বাচিত হন, কোনো ধরনের বড় ঘটনা ছাড়াই তার মেয়াদ শেষ হবে বলে মনে হয়েছিল। তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তাও ছিল প্রশ্নাতীত। অর্থনীতির অবস্থা তলানিতে ঠেকেছিল। বিরোধীপক্ষ ছিল বিভক্ত বিশৃঙ্খল অবস্থায়, মামলা ছিল বেশিরভাগ শীর্ষস্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে। 

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইমরান খানের ছিল শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর সমর্থন। তার ওপর গত বছর আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের আচমকা সেনা প্রত্যাহারের কারণে ভাগ্য আরও সুপ্রসন্ন হয় ইমরান খানের।

এখন, জাতীয় সংসদে বিরোধী দলগুলোর অনাস্থা প্রস্তাবের মুখোমখি হতে চলেছেন তিনি। আগামী সোমবারের অধিবেশনে এ আলোচনা শুরু হওয়ার কথা। প্রায় দুই বছর ধরে ইমরান খানের পদত্যাগের দাবিতে দেশটির বিরোধী দলগুলো আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছে। সম্প্রতি এরই পরিপ্রেক্ষিতে পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেছে বিরোধী দলীয় এমপিরা।

এই প্রস্তাবে হেরে যেতে পারেন তিনি। যদিও কোনো মতে শেষ রক্ষা হয়ও, তার রাজনৈতিক অর্জন,প্রভাব ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সামরিক বাহিনীর কাছে আরও দায়গ্রস্ত হয়ে পড়বেন তিনি।

মোটের ওপর এ দায় তারই। সংস্কারের চিন্তা আর প্রবৃদ্ধি ভিত্তিক আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তোলার নয়, বরং ইসলামিক রাষ্ট্র গঠনের প্রতিজ্ঞা করে ক্ষমতায় আসেন তিনি। কয়েক দশক ধরে পাকিস্তানের সমস্যার উৎস হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোকে টার্গেট করেন তিনি। ক্ষমতায় আসার পরও এ পন্থা থেকে এক চুল নড়েননি। তার কথা ছিল, সব রাজনৈতিক নেতাই দুর্নীতিগ্রস্ত। শুধু তিনিই পারেন পাকিস্তানকে ঠিক করে দিতে।  

এরফলে দীর্ঘদিনের প্রতিদ্বন্দী রাজনৈতিক দল ও নেতারাও একত্রিত হওয়ার উদ্দীপনা পায়। এদিকে, তার দুর্নীতি বিরোধী শক্ত অবস্থানের প্রচারণা সত্ত্বেও তার পূর্ববর্তী অনেক সমর্থক খেয়াল করেন, যাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন বলেছিলেন ইমরান, তাদের বিরুদ্ধে নতুন কোনো প্রমাণ উন্মোচন বা নতুন মামলা দাখিলের গতি নেই। 

কিন্তু সবচেয়ে বড় সমস্যা অর্থনীতি। কখনোই আমদানির ওপর নির্ভরতার সমস্যা সমাধান করতে পারেনি পাকিস্তান। রূপির দাম কমে এলে বা তেলের দাম বাড়লেই সাথে সাথে উচ্চ হারে মুদ্রাস্ফীতি হয়। ইউক্রেনের রাশিয়ার আগ্রাসনের পর নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় বর্তমানে এ হার ১২ শতাংশ । ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগের পাঁচ বছরে এ হার ছিল গড়ে ৫ শতাংশ। 

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বেঞ্চমার্ক সুদের হার ১০ শতাংশ ছুঁইছুঁই করছে। এ বছর রেকর্ড ছাড়াতে পারে ব্যালেন্স অব পেমেন্ট। তার ক্ষমতায় আসার পর থেকে পাকিস্তানি মুদ্রার মান অর্ধেক কমে গেছে। 

এ ক্ষেত্রেও স্বভাবজাত প্রতিক্রিয়াই দেখান তিনি। ভোটারদের ওপর এই প্রভাব কমাতে পেট্রোলিয়াম পণ্য ও বিদ্যুতের জন্য ভর্তুকি ঘোষণা করেন তিনি। দায়িত্বশীল শাসনব্যবস্থার বদলে নতুন ধরনের রাষ্ট্র গঠন যার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি এর চেয়ে বেশি আর কি-ইবা করতেন।  

পাকিস্তানের অর্থনীতি সংকটের মুখে- এমন কথার বিপরীতে তার সরকার ও দলীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়াও ছিল নেতিবাচক। দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পাকিস্তানের অর্থনীতি বিষয়ে বৈশ্বিক সংবাদমাধ্যমের ‘বানোয়াট কথা’র নিন্দা জানানো হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের দাবি ছিল, এসব সমস্যার কারণ মহামারি এবং ইউক্রেন যুদ্ধ। 

কিন্তু সত্যি কথা হলো, কোভিড-১৯ মহামারির আগেই দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমতে শুরু করেছিল। ইমরান খান ক্ষমতায় আসার আগেকার ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৩ শতাংশে নেমে আসে। তার নতুন ধরনের রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা কোনো কাজেই আসেনি। রাজকোষ ঘাটতি ৭ শতাংশ অতিক্রম করেছে, ফেডারেল বাজেটের এক-তৃতীয়াংশই গেছে ঋণের সুদ পরিশোধে। 

এই ঘাটতি পূরণে সরাসরি করের ভিত্তিতে পরিবর্তন না এনে ইমরান খানের সরকার আমদানি করের ওপর গুরুত্ব দেয়। সরকারের রাজস্ব আয়ের ৪০ শতাংশের বেশি আসে এ খাত থেকে। কিন্তু এর ফলে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন থেকে আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে পাকিস্তান। আমদানি-রপ্তানি সহজ করা ও কম করারোপের ওপর নির্ভরশীল বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইন। 

এ ধরনের অবস্থায় থাকা একটি দেশ সাধারণত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল ও অন্যান্য বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠান থেকে সাহায্য চেয়ে থাকে। কিন্তু, ইমরান খান কীভাবে স্বীকার করবেন তার পশ্চিমা সাহায্য প্রয়োজন? আইএমএফ থেকে পাকিস্তান ৬ বিলয়ন ডলার ঋণ সহায়তা নিলেও, নিজের পশ্চিমা-বিরোধী অবস্থানের বিরুদ্ধে যাওয়ায় সংস্থাটির চাহিদা মোতাবেক প্রয়োজনীয় সংস্কার পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি তাকে। 

এই জঙ্গীবাদী, ইসলামিস্ট ও পশ্চিমা বিরোধী প্রচারণার জন্যই সামরিক বাহিনীর কাছে তার আবেদন তৈরি হয়, নির্বাচনে জয়ের আগেই তাকে সমর্থন দেয়। এখানেই পাকিস্তানের দুর্ভাগ্য। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে আধুনিকীকরণ করতে চান এবং বিশ্ব দরবারের কাছে উন্মুক্ত করতে চান এমন একজন বেসামরিক নেতা প্রয়োজনে বিচ্ছিন্নতাবাদী সামরিক বাহিনীকে প্রতিরোধ করবেন। সংস্কার ও অর্থনৈতিক উদারীকরণকে প্রাধান্য দিয়ে জেনারেলকে অমান্য করা নেতা আবার বেশিদিন ক্ষমতায় টিকবেন না। 

যতোক্ষণ পর্যন্ত বেসামরিক নেতারা সামরিক বাহিনীর জাল থেকে বের হতে পারছেন, পপুলিস্ট পশ্চিমা-বিরোধী জজবা থেকে মুক্ত না হচ্ছেন, নিয়মিতভাবে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকটের মুখে পড়বে পাকিস্তান। হাত থেকে ক্ষমতা ফসকে যাচ্ছে দেশটির এমন প্রধানমন্ত্রী আসাও বন্ধ হবে না। 


লেখক: মিহির স্বরূপ শর্মা ব্লুমবার্গের কলামিস্ট। তিনি নয়াদিল্লি ভিত্তিক অবজার্ভার রিসার্চ ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো এবং সংস্থাটির অর্থনীতি ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রধান। তিনি ‘রিস্টার্ট: দ্য লাস্ট চান্স ফর দ্য ইন্ডিয়ান ইকোনমি’ শীর্ষক এক সমাদৃত গ্রন্থের লেখক।