Home প্রবন্ধ-নিবন্ধ যে তিনটি ঘটনা ঘটলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে নেটো জোট

যে তিনটি ঘটনা ঘটলে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে নেটো জোট

- প্রতীকী ছবি

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে শুরুর পর থেকেই যে বিষয়টি নেটো সামরিক জোটের প্রধান চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে তা হলো, এই যুদ্ধে সরাসরি না জড়িয়ে তাদের মিত্র ইউক্রেনকে কতটা সামরিক সাহায্য দেওয়া যায় – সেই সিদ্ধান্ত নেয়া।

ইউক্রেন সরকার অবশ্য নেটো জোটের সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সমূহ বিপদ নিয়ে আদৌ চিন্তিত নয়। তারা নেটোর কাছ থেকে সর্বোচ্চ সাহায্যের জন্য খোলাখুলি চাপ দিয়ে চলেছে।

ইউক্রেন এখন বলছে, পূর্বের ডনবাস প্রদেশে রাশিয়ার হামলা প্রতিহত করতে পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে জরুরী ভিত্তিতে তাদের আরো জ্যাভেলিন ও এনএল ট্যাংক বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র, স্ট্রিংগার এবং স্ট্রারস্ট্রিক বিমান-বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র প্রয়োজন।

এসব সব অস্ত্র তারা আগেও পশ্চিমা দেশগুলোর কাছ থেকে পেয়েছে। কিন্তু ইউক্রেন বলছে সেগুলোর মজুদ কমে আসছে এবং জরুরী ভিত্তিতে ঐ সব অস্ত্রের নতুন সরবরাহ তাদের দরকার।

এসব অস্ত্র ইউক্রেনে কমবেশি যাচ্ছে, কিন্তু ইউক্রেন এখন ট্যাংক চাইছে, সামরিক ড্রোন চাইছে এবং রাশিয়ার বিমান এবং দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা চাইছে।

কারণ, তারা বলছে তা না পেলে রাশিয়ার হামলায় তাদের কৌশলগতভাবে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক এবং বেসামরিক স্থাপনা এবং সেইসাথে জ্বালানির মজুদ ক্রমেই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে।

কিন্তু এখনও এসব ভারী আক্রমণাত্মক অস্ত্র দিতে নেটো দ্বিধার মধ্যে রয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন, কেন?

একটাই উত্তর – নেটো ভয় পাচ্ছে এসব অস্ত্র ইউক্রেনকে দিলে যুদ্ধ ইউক্রেনের বাইরে বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়বে।

পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারগুলোর মধ্যে একটি ভয় কাজ করছে যে চাপে পড়লে রাশিয়া হয়তো স্বল্প মাত্রার পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে। এবং তা যদি তারা করে – তাহলে যুদ্ধ ইউক্রেনের সীমান্ত ছাড়িয়ে বাকি ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ার বড়ধরণের ঝুঁকি তৈরি হবে।

এখন পর্যন্ত পশ্চিমা জোটগুলো ইউক্রেনকে যেসব সাহায্য দিয়েছে:

  • এখন পর্যন্ত ৩০টিরও বেশি দেশ ইউক্রেনকে সামরিক সাহায্য দিয়েছে। তাদের মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেয়া সাহায্যের পরিমাণ ১০০ কোটি ডলারের মত। যুক্তরাষ্ট্র একাই দিয়েছে ১৭০ কোটি ডলারের অস্ত্র-সরঞ্জাম।
  • এখন পর্যন্ত এসব সাহায্য গোলাবারুদ এবং ট্যাংক এবং বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রের মধ্যে সীমিত রয়েছে। এসব পশ্চিমা অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে কাঁধে বহনযোগ্য ট্যাংক বিধ্বংসী জ্যাভলিন ক্ষেপণাস্ত্র।
  • এবং একইরকম কাঁধে বহনযোগ্য স্ট্রিংগার ক্ষেপণাস্ত্র যা দিয়ে বিমান ধ্বংস করা যায়। আফগানিস্তানে সোভিয়েত দখলদারির সময়ে বিমান ধ্বংসের জন্য আমেরিকা আফগান মুজাহেদিনদের এই অস্ত্র দিয়েছিল।
  • ব্রিটেন তাদের তৈরি সহজে বহনযোগ্য স্টারস্ট্রিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা দিয়েছে।

নেটো জোটের কথা যেসব অস্ত্র ইউক্রেনকে দেয়া হচ্ছে এগুলোর সবই প্রতিরক্ষামূলক, এবং জোটের অধিকাংশ সদস্য দেশ মনে করছে ট্যাংক বা যুদ্ধ বিমানের মত অস্ত্র যেহেতু আক্রমণাত্মক সুতরাং এগুলো দিলে রাশিয়া তাকে উসকানি হিসাবে বিবেচনা করবে।

যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকেই প্রেসিডেন্ট পুতিন বাকি বিশ্বকে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন, রাশিয়া একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ এবং তিনি তার পারমাণবিক অস্ত্রসম্ভারকে প্রস্তুত রাখছেন।

তবে যুক্তরাষ্ট্র এখনও এই হুমকিতে তেমন পাত্তা দিচ্ছেনা – কারণ রাশিয়া যে তাদের সুরক্ষিত বাঙ্কার থেকে এসব পারমাণবিক অস্ত্র বের করছে এমন কোনো আলামত এখনও তারা দেখছে না।

কিন্তু পুতিন তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন। তার মোদ্দা কথা: ‘রাশিয়ার কাছে অনেক পারমাণবিক অস্ত্র রয়েছে, সুতরাং আমাদের বেশি বিরক্ত করোনা।’

রাশিয়ার গৃহীত সামরিক কৌশলের নীতিতে যুদ্ধক্ষেত্রে রুশ সেনাবাহিনীকে প্রথম স্বল্পমাত্রার ট্যাকটিকাল পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করার অধিকার দেয়া হয়েছে। শত্রুপক্ষ থেকে তেমন অস্ত্র ব্যবহারের জন্য রুশ সেনাবাহিনীকে অপেক্ষা করতে হবেনা।

গত ৭৭ বছরে কোনো যুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয়নি এবং রাশিয়া জানে তেমন অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপক ভীতি রয়েছে।

নেটো জোটের দ্বিধা কমছে

নেটো জোটের সামরিক কৌশল যারা নির্ধারণ করেন তারা মনে করেন যদি ইউক্রেনের যুদ্ধক্ষেত্রে কোনো একটি টার্গেটের ওপরও পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার হয় – অর্থাৎ পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার নিয়ে যে ‘ট্যাবু’ বা অলিখিত বোঝাপড়া রয়েছে তা যদি একবার ভেঙে যায় – তাহলে মহা-সর্বনাশ হবে। রাশিয়া এবং পশ্চিমা শক্তিগুলোর মধ্যে পারমাণবিক যুদ্ধ লেগে যাওয়ার সত্যিকারের ঝুঁকি তৈরি হবে।

আরও পড়তে পারেন-

কিন্তু তারপরও ইউক্রেনে রুশ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে নৃশংসতার যত অভিযোগ উঠছে, নেটো জোটের মধ্যে বৃহত্তর যুদ্ধের ঝুঁকি নিয়ে শঙ্কা এবং দ্বিধা ততই কমছে।

যেমন, নেটো জোটের সদস্য দেশ চেক রিপাবলিক একক সিদ্ধান্তে ইউক্রেনকে ট্যাংক পাঠিয়েছে, যদিও তা সোভিয়েত আমলে তৈরি টি-৭২। স্লোভাকিয়া ইউক্রেনে এস থ্রি হানড্রেড (এস৩০০) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা পাঠাচ্ছে।

যুদ্ধ শুরুর প্রথম দিকে এমন অস্ত্র পাঠানোর কথা হয়তো নেটো জোটের কেউ চিন্তাও করেনি। এখন কেউ কেউ তেমন সিদ্ধান্ত নিচ্ছে।

যেমন, পশ্চিমা রাজনীতিক বা সামরিক বিশ্লেষক মনে করেন পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহারের কথা বলে মি. পুতিন আসলে ব্লাফ বা ধাপ্পা দিচ্ছেন। তাদেরই একজন ব্রিটেনের প্রতিরক্ষা বিষয়ক পার্লামেন্টারি স্থায়ী কমিটির সদস্য টোবিয়াস এলউড এমপি।

“ইউক্রেন কোন ধরনের অস্ত্র দেয়া যাবে কি যাবেনা তা নিয়ে আমরা অতিমাত্রায় সাবধানতা দেখাচ্ছি,” তিনি বলেন – “আমাদের আরো সাহস দেখাতে হবে। আমরা ইউক্রেনকে টিকে থাকার জন্য সরঞ্জাম দিচ্ছি, কিন্তু জেতার জন্য যা লাগবে তা দিচ্ছিনা। আমাদের এই মনোভাব বদলাতে হবে।”

কীভাবে যুদ্ধ পুরোইউরোপে ছড়িয়ে পড়তে পারে

এখন প্রশ্ন হচ্ছে ঠিক কীভাবে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একটি ইউরোপ-ব্যাপী যুদ্ধে পরিণত হতে পারে – যার পরিণতিতে নেটো সামরিক জোট সেই যুদ্ধে সরাসরি জড়িয়ে পড়তে পারে?

পশ্চিমা প্রতিরক্ষা দপ্তরগুলো যারা চালান তাদের মনে নিশ্চিতভাবে সম্ভাব্য কতগুলো দৃশ্যপট রয়েছে।

তেমন তিনটি দৃশ্যপট দেখা যাক :

এক. বন্দর শহর ওডেসা থেকে ইউক্রেনিয়ান সেনাবাহিনী পশ্চিমা কোনো দেশের দেওয়া জাহাজ বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ে কৃষ্ণসাগরে একটি রুশ যুদ্ধ জাহাজ ডুবিয়ে দিল এবং তার ফলে প্রায় একশ রুশ নৌ সেনা এবং কয়েক ডজন রুশ মেরিন সেনা মারা গেলে। একটি হামলায় এত প্রাণহানি রাশিয়ার জন্য নজিরবিহীন একটি ঘটনা হবে এবং বদলা নেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট পুতিনের ওপর বড় ধরণের চাপ তৈরি হবে।

দুই. নেটো কোনো দেশ থেকে – যেমন পোল্যান্ড বা স্লোভাকিয়া – অস্ত্রের চালান ইউক্রেনে ঢোকার সময় রাশিয়া তার ওপর স্বল্প শক্তির পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুঁড়ল। সেই হামলা যদি বিশেষ করে নেটোর সীমান্তের ভেতর হয় এবং তাতে যদি প্রাণহানি হয়, তাহলে নেটো তাদের সংবিধানের আর্টিকেল ফাইভ কার্যকরী করবে, যার অর্থ জোটের সবগুলো দেশ একসাথে কোনো একটি বা দুটি সদস্য দেশের প্রতিরক্ষায় সক্রিয় হবে।

তিন. ইউক্রেনের পূর্বে ডনবাস প্রদেশে তীব্র লড়াইয়ের সময় একটি শিল্প ইউনিটে বিষ্ফোরণ হলো যার ফলে সেখান থেকে বিষাক্ত রাসায়নিক গ্যাস নির্গমন শুরু হলো। যদিও তেমন বিস্ফোরণ এরই মধ্যে হয়েছে, কিন্তু তার ফলে কেউ মারা যায়নি। কিন্তু তেমন বিস্ফোরণে যদি প্রচুর মানুষ মারা যায় এবং এমন প্রমাণ যদি পাওয়া যায় যে রাশিয়া ইচ্ছা করে ঐ বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে, তাহলে নেটো জোটের মধ্যে পাল্টা ব্যবস্থা নেয়ার প্রচণ্ড চাপ তৈরি হবে।

এমনও হতে পারে যে, এসব সম্ভাব্য পরিস্থিতি হয়তো আদৌ দেখা দেবে না।

কিন্তু যদিও পশ্চিমা দেশগুলো ইউক্রেনে রুশ সামরিক হামলার ইস্যুতে নিজেদের মধ্যে বিরল একটি ঐক্য দেখাচ্ছে, কিন্তু এমন সমালোচনা হচ্ছে যে এখন পর্যন্ত এসব দেশ শুধু তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে এবং এই যুদ্ধের ‘এন্ড-গেম’ বা চূড়ান্ত পর্ব কী হবে নিয়ে ততটা মাথা ঘামাচ্ছেনা। নিজেরাই চূড়ান্ত পরিণতি নির্ধারণের তেমন কোনো চেষ্টা পশ্চিমা দেশগুলো করছে না।

“বৃহত্তর স্ট্রাটেজিক প্রশ্ন হচ্ছে,” নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিবিসিকে বলেন ব্রিটেনের সবচেয়ে অভিজ্ঞ সাবেক সামরিক অধিনায়কদের একজন,”আমাদের সরকার কি সংকট মেটানোর কাজে লিপ্ত নাকি সত্যিকারের কৌশল নিয়ে ভাবছে?”

তিনি বলছেন যদি কৌশলগত লক্ষ্য অর্জনই মূল লক্ষ্য হয়, তাহলে এই সংঘাতের চূড়ান্ত পরিণতির বিষয়টি মাথায় নিয়ে এগুতে হবে। তিনি বলেন, “আমারা যেটা অর্জনের চেষ্টা করছি তা হলো তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের ঝুঁকি এড়িয়ে ইউক্রেনকে যতটা সাহায্য করা যায়। কিন্তু সমস্যা হলো পুতিন আমাদের চেয়ে অনেক বড় জুয়াড়ি।”

টোবিয়াস এলউড এমপি এমন কথার সাথে একমত। “রাশিয়া খুব সফলভাবে তাদের হুমকি কাজে লাগায়। আমরা ভয় পেয়ে যাই। পুরো পরিস্থিতিকে আমাদের মত করে নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা আমরা হারিয়ে ফেলেছি।”

সূত্র- বিবিসি বাংলা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।