Home ইতিহাস ও জীবনী তাজমহলের জায়গায় কি আসলেই মন্দির ছিল? শুধু ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরাই এমন বলবে…

তাজমহলের জায়গায় কি আসলেই মন্দির ছিল? শুধু ষড়যন্ত্র তত্ত্বে বিশ্বাসীরাই এমন বলবে…

ঈদ-ঊল-ফিতরের দিন তাজমহলের সামনে ঈদের জামাত আদায়। ছবি: এএফপি

তাজমহলের মতো খুব কম স্থাপত্যই আছে যেগুলো রীতিমতো কোনো দেশের প্রতীক বনে গেছে। কয়েক দশক ধরে ভারতের ছবি, চলচ্চিত্র বা পর্যটনের প্রচারণায় তাজমহলের আধিপত্য। এমনকি রাজস্থানের চায়ের দোকানেও ৫০-এর দশকের পর্যটন বিজ্ঞাপনের পোস্টারে আজও তাজমহল দেখা যাবে। পোস্টারের সাদা মার্বেল পাথরের গম্বুজ আর মিনারগুলো মরুভূমির উত্তাপে বিবর্ণ হয়ে গেলেও ভ্রমণপিপাসুদের কাছে তাজমহলের আবেদন এখনও বিন্দুমাত্র কমেনি।

ইতিহাসবিদ রানা সাফভি বলেছিলেন, “তাজ কোনো হিন্দু বা মুসলিম স্মারক নয়, এটা ভারতীয় স্মারক যেটা সারা বিশ্বের কাছে ভারতকে তুলে ধরে”।

কিন্তু তাজমহলের সেই সর্বজনীন ব্যাপারটা সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। পুরোনো এক তত্ত্ব আবারও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। মোগল যুগের এই সমাধি নাকি হিন্দু মন্দিরের ওপর নির্মিত।

চলতি মাসের শুরুতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হিন্দু জাতীয়তাবাদী দল ভারতীয় জনতা পার্টির এক সদস্য উত্তর প্রদেশের এলাহাবাদ হাইকোর্টে তাজমহলের ‘বাস্তব ইতিহাস’ খুঁজে বের করতে ২২টি তালাবদ্ধ দরজা খুলতে পিটিশন দায়ের করেন।

আদালত এই আবেদন খারিজ করে দেন। বিচারকরা পুরো বিষয়টিকেই “অন্যায্য” বলে আবেদনকারীদের ভারতের বিচার ব্যবস্থা নিয়ে উপহাস করতে সতর্ক করেন।

কিন্তু এই ধরনের মামলাগুলো যারা করছে তাদের পক্ষে কিন্তু সমর্থনের অভাব নেই। এই বিতর্কের জন্ম অবশ্য আরও বহু আগে। ৭০-এর দশকে প্রথম তাজমহল তত্ত্ব প্রকাশ করেছিলেন ওক। পিএন ওকের অসংখ্য ভক্ত আছে ভারতে। তার মতে ভ্যাটিকান, কাবা ও ওয়েস্টমিনিস্টার অ্যাবে এককালে হিন্দু মন্দির ছিল। হোয়াটস অ্যাপের যুগে প্রতিক্রিয়াশীল হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের মধ্যেও জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে এই ডিসকোর্স।

তবে ৭০ এর দশকে ওক যখন এসব বলেছিলেন, সাফভির মতে তার কথা তখন কেউই গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু প্রায় ৫০ বছর পর পরিস্থিতি আর আগের মতো নেই।

তেজো মহালয়ার মন্দির

১৭ শতকের ঐতিহাসিক নথি ও ফরমান থেকে দেখা যায় যে যমুনা নদীর সামনে মোগল সাম্রাজ্যের জ্যেষ্ঠ সেনাপতি জয় সিংয়ের বাড়ির ওপর নির্মিত হয় তাজমহল।

তবে ওকের দাবি স্মৃতিস্তম্ভটি হিন্দু দেবী দুর্গার “তেজো মহালয়া”মন্দিরের ওপর নির্মিত। ২০০৩ সালে পুনঃপ্রকাশের পর হিন্দুত্ববাদীদের মাঝে সাড়া ফেলে ওকের বই।

২০১৪ সালে মোদির বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর ভুয়ো মন্দির তত্ত্ব আবার সাড়া ফেলে। মোগল যুগের ও মুসলিম স্থাপত্য নিদর্শনটিকে ভারতের ডানপন্থীরা বিদেশী দখলকারীদের স্থাপত্য হিসেবে প্রচারের চেষ্টা করে।

আরও পড়তে পারেন-

আরেকটি হাই-প্রফাইল কেস হলো বাবরি মসজিদ। ১৯৯২ সালে ১৬ শতকে সম্রাট বাবরের সময় নির্মিত বাবরি মসজিদ ধ্বংস করে হিন্দুত্ববাদীরা। বিজেপি ক্ষমতায় আসার আগে জায়গাটি নিয়ে কোনো সুরাহা হয়নি। ২০১৯ সালে ভারতের সুপ্রীম কোর্ট মন্দির নির্মাণের জন্য জমি হস্তান্তর করে। এরপরের বছর মোদি নিজেই এক অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে মন্দিরের ভিত্তি স্থাপন করেন।

এরপর থেকে আরও কয়েক ডজন মসজিদ নিয়ে একই ধরনের প্রশ্ন তুলেছে হিন্দত্ববাদীরা। এলাহাবাদ কোর্ট ১২ মে তাজমহলের উৎস বিজেপির পিটিশন খারিজ করলেও আইনজীবী ও প্রাক্তন আইন বিষয়ক সাংবাদিক আরিব উদ্দিন আহমেদ দিস উইক ইন এশিয়ার কাছে এক সাক্ষাতে বলেন, সামনে আরও চ্যালেঞ্জ আসতে পারে।

তাজমহল নিয়ে সর্বশেষ পিটিশনটিতে অবশ্য উৎস নিয়ে কম, বরং তালাবদ্ধ ঘরগুলো নিয়েই বেশি বিতর্ক ছিল। তার মতে, বারাণসী, মথুরা, মধ্যপ্রদেশের বিভিন্ন আদালতে যে মামলাগুলো চলছে তা বিবেচনায় নিলে এখানেও ঘটনার পুনরাবৃত্তি হতে পারে।

বর্তমানে ভারতের আদালতে মোগল-মুসলিম অন্তত পাঁচটি নিদর্শন নিয়ে মামলা চলমান। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঐতিহাসিক সত্যতার তোয়াক্কা না করেই এগুলোকে হিন্দু জাতীয়তাবাদী প্রচারণার আক্রমণে পরিণত করা হয়েছে।

নিম্ন আদালতে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হলেও সুপ্রিম কোর্টে তারা আপিল করতে পারবে বলে জানান সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আনাস তানভির। “আর আমার মনে হয় এজেন্ডা অনুযায়ী তারা এই কাজ করবে।,” বলেন তিনি।

তাজমহলের জমি মানসিংহকে উপহার দিয়েছিলেন আকবর

১৬৩২ সালে সম্রাট শাহজাহান আগের বছর মারা যাওয়া প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজ মহলের সমাধি হিসেবে তাজমহল নির্মাণ করেন। তাজমহল মোগল যুগের স্থাপত্যগুলোর মধ্যে শ্রেষ্ঠ হিসেবে বিবেচিত হয়।

সাদা গম্বুজের মারবেল সমাধির এই ভবনকে সাফভি ‘সমাধির চেয়েও বেশিকিছু’বলে উল্লেখ করেছিলেন। তার মতে, এটি “মৃত্যু, পুনরুত্থান ও স্বর্গকে নির্দেশ করে। একইসঙ্গে সাম্রাজ্য নিয়ে শাহজাহানের দৃষ্টিভঙ্গিও তুলে ধরে তা। মৃত্যুর পর সম্রাটকেও এখানেই সমাহিত করা হয়।

১৬৩৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর নদীর সামনের জায়গাটির পরিবর্তে সম্রাট জয় সিংকে চারটি হাভেলি উপহার দেন। জমিটি জয় সিং-এর দাদা মহারাজা মানসিংকে উপহার দিয়েছিলেন মোগল সম্রাট আকবর। মানসিং জয়পুরের হিন্দু রাজত্বের প্রধান ও সম্রাটের দরবারের গুরুত্বপূর্ণ একজন মন্ত্রী ছিলেন।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে তাজমহল ভারতের পর্যটন প্রচারণার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। একই ধরনের সাদা মারবেলে তৈরি তাজমহলে্র মিনিয়েচার স্মারক একসময় ভারত সরকারের তরফ থেকে বিদেশি অতিথিদের উপহার দেওয়া হতো।

সূত্র: সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।