Home ইতিহাস ও জীবনী প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ধর্মীয় মুরুব্বী ছিলেন শায়খ মাহমূদ আফেন্দী (রহ.)

প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ধর্মীয় মুরুব্বী ছিলেন শায়খ মাহমূদ আফেন্দী (রহ.)

ফাহীম সিদ্দিকী: হযরত শাইখুল ইসলাম মাহমুদ আফেন্দী হাফিজাহুল্লাহ তুরস্কের প্রেসিডেন্ট এরদোগানের ধর্মীয় মুরুব্বী। তিনি রজব তাইয়েব এর উস্তাদ। প্রেসিডেন্ট রজব তাইয়েব তাঁর খাস শাগরেদ। হযরত মাহমুদ আফেন্দি যে আকিদা ও হানাফী মাযহাবের অনুসারী, এরদোয়ানও একই আকিদা ও মাযহাবের অনুসারী। শায়খ মাহমুদ আফেন্দি হুজ্জাতুল ইসলাম মাওলানা কাসেম নানুতুবির রহ. আকিদা অন্তরে লালন করেন, যা তিনি তার বিভিন্ন কিতাবে নানা সময় উল্লেখ করেছেন।

কামাল আতাতুর্ক এক ভাষনে বলেছিলো, জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতার সামনে দাঁড়িয়ে আমি তুরস্কের সভ্য সমাজের জনগণকে জাগতিক ও আধ্যাত্মিকতা লাভের জন্য আলেমদের নির্দেশনায় চলতে দিতে পারি না। তুর্কি প্রজাতন্ত্র শেখ, দরবেশ ও অনুসারীদের দেশ হতে পারে না। সর্বোৎকৃষ্ট রীতি হল সভ্যতার রীতি। মানুষ হওয়ার জন্য সভ্যতার প্রয়োজনীয়তা পূরণ করাই যথেষ্ট। দরবেশ প্রথার নেতৃবৃন্দ আমার কথার সত্যতা বুঝতে পারবেন এবং তাদের খানকাহগুলো গুটিয়ে নেবেন ও স্বীকার করবেন যে তাদের রীতিগুলো পুরনো হয়ে গেছে।

কামাল আতাতুর্কের এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সেখানকার নকশেবন্দিয়া তরিকার অনুসারী গণ প্রতিবাদ করেছিলেন, তাদের প্রতিবাদের আগুন সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে, তারা সরকারের বিভিন্ন কার্যালয় অবরোধ করেন, গুরুত্বপূর্ণ শহর অভিমুখে যাত্রা করেন৷ কামাল আতাতুর্ক সরকার তাদের এই প্রতিবাদকে বিদ্রোহ আখ্যা দিয়ে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করে, নেতাদের ধরে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দেয়, বিরোধী রাজনৈতিক দল বিলুপ্ত ঘোষণা করে, কার্যত এক সময় তুরস্কের মাটিতে সেক্যুলার শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার সকল সক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে যায়।

কামাল আতাতুর্কের তুরস্কে যখন মসজিদগুলো মিউজিয়াম হয়ে যায়। মাদরাসাগুলোর যাবতীয় সম্পত্তি সরকার ক্রোক করে নেয়, ধর্মীয় শিক্ষা নিষিদ্ধ করা হয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক জীবনে ধর্ম-চর্চা নিষিদ্ধ করা হয়, সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ বোধে-বিশ্বাসে এতোটাই সেক্যুলার হয়ে যায় যে, তারা ইসলামের নামও শুনতে প্রস্তুত নন। রাষ্ট্রীয়ভাবে ইসলাম প্রতিষ্ঠা তো দূরের কথা, ব্যক্তিজীবনেও তারা ইসলামের বিধি-নিষেধ মানতে প্রস্তুত নন।

এমন একটি জাতিকে কীভাবে ইসলামের পথে আনা যায়? এক্ষেত্রে দাওয়াতের অপেক্ষাকৃত কোমল ও ধীর এবং দীর্ঘমেয়াদী পথটাই যে যথোপযুক্ত ছিল।

তুর্কি উলামায়ে কেরাম শহর ছেড়ে চলে যান প্রত্যন্ত অঞ্চলে অজ পাড়াগাঁয়ে। তারা সেখানে গাছের নিচে বাচ্চাদের কুরআন শেখানোর কাজ শুরু করেন। এমনকি সৈন্যদের দেখলে সাথে সাথে তারা ক্ষেতে নেমে কৃষিকাজ শুরু করে দিতেন।

সেই তালিবুল ইলমদেরই একজন মাওলানা মাহমুদ আফেন্দি নকশেবন্দী হাফি.। জন্ম ১৯২৯ সালে। শায়খ মাহমুদ আফেন্দী নকশেবন্দী হানাফী মাজহাবের অনুসারী। উলূমে হাদিস, ও উলুমে ফেকাহ্ এর উপর উচ্চতর ডিগ্রিধারী। দেওবন্দী চিন্তা চেতনা ও মানহাযের উপর চলেন। তিনি খানকার মাধ্যমে দ্বীনি খিদমত আঞ্জাম দিয়ে আসছেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মাহমুদ আফেন্দির মুরিদান। যারা বিভিন্ন দেশেই দ্বীনের খেদমত করছেন। ইউরোপেও রয়েছে তাঁর খানকাহ্। সেখানে আফেন্দির প্রতিটি খানকা যেন সালতানাতে উসমানীয়ার এক একটি মারকায।

তিনি যেভাবে কষ্ট করে দীনি ইলম অর্জন করেছেন। তেমনিভাবে নিজেও গ্রামেগঞ্জে এভাবে ছাত্রদের দ্বীন শিখিয়েছেন। নিষেধাজ্ঞার সময় শায়খ মাহমুদ আফেন্দি ছাত্রদের আঙুলের ইশারায় সারফ-নাহু শেখাতেন এবং হাতের ইশারায় মাসআলা মাসায়িল শেখাতেন। এখনও তুরস্কে কিছু জায়গায় এ পদ্ধতিতে শিক্ষা দেওয়া হয়।

এক সময় শায়খ আফেন্দি এ মিশন নিয়ে শহরমুখী হন। সেখানে একটি পুরাতন মসজিদ ছিল। তিনি সেখানে অবস্থান করা শুরু করলেন এবং দ্বীনি ইলম শিক্ষা দেওয়া শুরু করেন। চল্লিশ বছর ধারাবাহিক এভাবে মানুষদের দ্বীন শেখান।

আঠারো বছর পর্যন্ত কেউ তার পেছনে সৈন্যদের ভয়ে প্রকাশ্যে নামাজ পড়ার সাহস করতে পারেনি। তবে সময়ের সাথে সাথে কিছু কিছু মানুষ সাহস করে তার পেছনে জামাতে নামাজ পড়া শুরু করে। এই বুজুর্গের মেহনতের ফলে একসময় সব মসজিদে আজানের সাথে সাথে লক্ষ লক্ষ মানুষ সমবেত হয়ে একসাথে নামাজ আদায় করেন। দারুল উলূম দেওবন্দ ও আকাবিরে দেওবন্দকে শায়খ মাহমুদ আফেন্দি হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা করেন এবং তাদের আদর্শ অনুসরণ করার চেষ্টা করেন। তিনি হজরত কাসেম নানুতবি রহ.কে চৌদ্দশ শতাব্দীর ‘মুজাদ্দিদ’ বলে থাকেন৷

মাহমুদ আফেন্দি হাফিজাহুল্লাহ তুর্কি ভাষায় কুরআনে কারিমের আঠারো খণ্ডের বিশাল এক তাফসির লেখেন। যার নাম ‘রুহুল ফোরকান’ এ কিতাবের চতুর্থ খণ্ডের ৭২৪ পৃষ্ঠায় মাওলানা আশরাফ আলী থানভি রহ. কে ‘শায়খুল মাশায়েখ’ ও শায়খুল হাদিস যাকারিয়া কান্দলভী রহ. কে ‘ইমাম’ ‘মুহাদ্দিস’ ও ‘আল্লামা’ উপাধিতে ভূষিত করেন।

আরও পড়তে পারেন-

উল্লেখ্য, ২০১৩ সালে শায়খুল ইসলাম শায়খ মাহমুদ আফেন্দিকে তুর্কিতে দ্বীনি শিক্ষা প্রচার প্রসারে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ‘ইমাম কাসেম নানুতবি এওয়ার্ড’ দিয়ে পুরষ্কৃত করা হয়। তুরস্কে অনুষ্ঠিত আলেমদের এক সম্মেলনে সায়্যিদ আরশাদ মাদানি হা.ফি. বলেন, শায়খ মাহমুদ আফেন্দি হলেন তুর্কির কাসেম নানুতবি।

দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে মাওলানা কাসেম নানুতুবি রহ. যেভাবে উলামায়ে কেরামের একটি বিশাল বিপ্লবী কাফেলা গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন, তা হলো, যেহেতু দেশের জনগণ ও স্থানীয় প্রশাসন- দুটোই ইসলাম থেকে শত ক্রোশ দূরে সরে গেছে, কাজেই সেক্যুলার প্রশাসনের বিরুদ্ধে শতভাগ বিদ্রোহে না গিয়ে-

(১) জনগণকে যথাসম্ভব ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনা৷ (২) ব্যক্তিউদ্যোগে, নিরবে-নিভৃতে-সংগোপনে খালিস ধর্মীয়শিক্ষা যেকোনো মূল্যে অব্যাহত রাখা।

(৩) আধুনিক সমাজব্যবস্থার ভঙ্গুর, ঠুনকো ও দুর্বল দিকগুলো জনগণের সামনে তুলে ধরে সেক্যুলার মহলের বুদ্ধিবৃত্তিক মোকাবেলা করা।

যেভাবে উলামায়ে কেরাম রাজধানী দিল্লির মাদরাসাগুলো গুটিয়ে চলে যান দেওবন্দ ও সাহারানপুরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলে। শুরু করেন সব ধরনের দৃষ্টি এড়িয়ে ইকামতে দ্বীনের নতুন মেহনত।

সেক্যুলারপন্থিরা মহান শায়খের উপর বহু আক্রমণ করেছিল, নব্বইয়ের দশকে একজন দরবারী মুফতীকে হত্যার অভিযোগে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, কিন্তু অভিযোগ মিথ্যা প্রমানিত হওয়ায় তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়, ২০০৭ এও এক ভয়ঙ্কর হামলা হয়, আল্লাহর রহমতে তিনি সেই যাত্রায়ও বেঁচে যান৷ পাঠক নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন যে, আয়া সোফিয়ার ফাতহুম মুবিন বা প্রকাশ্য বিজয়ের মূল চাবিকাঠি এই মহান শায়েখ।

ইতিহাস সাক্ষি, যুগে যুগে ইসলামের আলো যখন নিভু নিভু হয়ে যায় তখনই এ ধরণের আধ্যাত্মিক ধর্মীয় মনিষীগণের অক্লান্ত পরিশ্রম ও মেহনতের বদৌলতে ইসলামের আলো পুনর্জাগরণ সৃষ্টি করে, তুরস্কের ভুমিতেও একদিন পুরোদস্তুর ইসলামের আলো জ্বলে উঠবে, তুরস্কবাসী ফিরে পাবে তাদের হারানো ঐতিহ্য, ইনশাআল্লাহ।

লেখক : শিক্ষক, জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া, মোহাম্মদপুর, ঢাকা।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।