Home ওপিনিয়ন পশ্চিমের শেষ ভরসা কী সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ?

পশ্চিমের শেষ ভরসা কী সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ?

।। গৌতম দাস ।।

সামনের দিনগুলোতে গ্লোবাল পরিসরে যুদ্ধ-লড়াই ক্রমেই ‘জাত শ্রেষ্ঠত্বের লড়াই হিসেবে’ খাড়া করার উদ্যোগ শুরু হয়েছে। মানে, কারা নৃতাত্ত্বিক-জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ যেন এ নিয়ে হতে যাচ্ছে লড়াইটা – এ ভাব ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হবে। কথাটা আরো সরাসরি করেও বলা যায়। যেমন পশ্চিমা শক্তি আসলে সোজা বলতে চাইছে, আগামী যেকোনো যুদ্ধ-লড়াই তারা ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব’-এর লড়াই হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা শুরু করে দিয়েছে। অর্থাৎ বাস্তবে তারা আগেই জানত ও জানে যে, দুনিয়াতে কোন নৃতাত্ত্বিক-জাতি শ্রেষ্ঠ – এই অনুমান বা তুলনা করাটাই অর্থহীন। প্রতিটি জনগোষ্ঠীরই একেক দিকে বিশেষত্ব থাকে, থাকতে পারে। কিন্তু মূল কথা, কোন অজুহাত বা জুতসই সাফাই-যুক্তি কেউ দিলেও আমরা কেউ কারো অধীনে অধীনস্থ নই বা করতে দিতে পারি না। অতএব ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব’ প্রতিষ্ঠার লড়াই বলে কিছুই নেই।

তবু দুনিয়াতে আমরা দেখেছি টানা সাড়ে তিন শ’ বছরের কলোনি দখল ও লুটেরা শাসন চলেছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগ পর্যন্ত যার ভুয়া সাফাই ছিল এই যে, পশ্চিমা সাদা ককেশীয়রা ছিল নাকি ‘বেশি সভ্য’। কাজেই তারা আমাদের মত দেশের  উপর শাসন কায়েম করবে লুট করবে, এ উছিলায় যে, তারা আমাদের সভ্য বানাবে ইত্যাদি।

সবচেয়ে বড় কথা, মনে করা হয়েছিল বিশ্বযুদ্ধে মুখ্যত জার্মান হিটলার ও তার দোসর-বন্ধুদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তাদের পতনের মধ্য দিয়ে হয়তো দুনিয়া যথেষ্ট শিক্ষা পেয়েছে। ফলে বর্ণবাদ বা রেসিজম [RACISM] এই জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদ সেবার পরাজিত হওয়ার পর ক্রমেই এই চিন্তা হয়তো চাপা পড়ে যাবে। এছাড়া তখন ধরে নেয়া হয়্বেছিল যে মানুষ শ্রেষ্ঠত্ববাদের বিপদ ও চরম খারাপ দিক সম্পর্কে  নিশ্চয় ইতোমধ্যে অনেক জেনেছে। ফলে কোন রেসিজমের চিন্তা আবার জেগে উঠার সুযোগ নেই। কিন্তু লক্ষ করা যাচ্ছে এই পশ্চিমা শক্তিই খোদ এবার রেসিজম, এই পুরনো ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদী’ হয়ে ফিরতে চাচ্ছে।

এমনিতে নয়া চলতি শতক হল অর্থনৈতিক দিক থেকে আমেরিকার পতন ও চীনের উত্থানের সময়কাল। তাই বারবার মনে করিয়ে দিয়েছি এটা অবজেকটিভ মানে মানুষের ইচ্ছা নিরপেক্ষ এক ফেনোমেনা। যেমন আমেরিকান কোনো প্রেসিডেন্ট কোনো যুদ্ধ লাগিয়ে চীনা উত্থান ঠেকানোর চেষ্টা করবেন হয়ত কিন্তু তাতেও এটা ঠেকবে না। অন্তত সেই ২০১৪ সাল থেকে তাই নিয়মিত বলে আসছি যে, এককালে পুরনো ব্রিটিশ কলোনি সাম্রাজ্যও পেছনে পড়ে যেমন উত্থিত আমেরিকার কাছে হেরে গিয়েছিল আর নানা ঘটনাপ্রবাহ শেষে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে আমেরিকা এক গ্লোবাল নেতা হয়ে উঠেছিল, আজ প্রায় ৭৫ বছর পরে এটাও আবার পরিবর্তিত হতে যাচ্ছে। এবার চীনা উত্থান মানে চীনের অর্থনীতিতে উদ্বৃত্ত সম্পদ সঞ্চয়, এই পুঞ্জিভবন [accumulation] ব্যাপক ও সবাইকে ছাড়িয়ে হাজির হওয়া শুরু হয়েছে। এটা চীনের অর্থনৈতিক সক্ষমতাতে আমেরিকাকে ছাড়িয়ে যাওয়ার পথে; ঠিক যেমন এককালে আমেরিকা ব্রিটিশ অর্থনীতিকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল।

আমেরিকার এই ক্রমেই পতন ও চীনের ক্রমেই উত্থান প্রমাণিত সত্য হিসেবে আমেরিকার ন্যাশনাল সার্ভেতেও ২০০৮ সাল থেকে স্পষ্ট হয়ে চলেছে। গত ২০০৮ সাল ছিল এ নিয়ে প্রথম পরিসংখ্যানগত প্রকাশিত সার্ভে রিপোর্ট ও প্রমাণ, যা এরপর থেকে প্রতি চার বছর পরপর এর বিকাশ আরো স্পষ্ট করে একই রিপোর্ট তুলে ধরছে। এ নিয়ে বুশ বা ওবামা আমলে তারা উভয়েই দুই টার্ম করে ক্ষমতায় থাকলেও তাদের মিলের দিকটি হল – এদুই প্রেসিডেন্টই সার্ভে রিপোর্ট হাতে পেয়েছেন ঠিকই কিন্তু নিজ সার্ভে রিপোর্টও মানতে চাননি। অস্বীকার করে গেছেন, ‘এতে তেমন কিছু হবে না’ ধরনের কথা দাবি করে। তবে তলায় তলায় উভয়েই এশিয়ায় চীন ঠেকানো বা China Containment পলিসি নিয়েছেন। সেটা হল, ভারতের পিঠে হাত রেখে চীনকে ঠেকানোর নীতি।

সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপারটা হল তারা উভয় তাদের প্রেসিডেন্টশিপের মোট ১৬ বছর ধরে দেখেছেন এতে আমেরিকার ফেভারে কোনো অগ্রগতি নেই। তবে কেবল কয়েক বছর পরে পরে চীনের উপরে চাপ সৃষ্টি করে আমেরিকার জন্য নয়া কিছু বাণিজ্য সুবিধা আদায় করেছেন, চীনের কাজ থেকে। চীনও কখনোই তাদের নিরাশ করেনি। এভাবেই চলে আসছিল এমনকি এত পাগলাটে ও জাতিবাদী ভাব দেখানো ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর আমলেও। তিনিও একইভাবে চীনের কাছে দাবি করেছেন আর এতে নয়া কিছু বাণিজ্য সুবিধা তিনিও পেয়েছেন। এমনকি সর্বশেষ তা ২০১৭ সালেও যে বছর প্রথম ‘কোয়াড’ বা QUAD (আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারত এই চার দেশের) জোটকে চাঙ্গা করা হয়েছিল তখনো ট্রাম্প সুবিধা পেয়েছিলেন।

কিন্তু এরপরই আমেরিকাকে ট্রাম্প এক মহাপরিবর্তনের দিকে মোচড় দিয়েছিলেন। সেটা হল “সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ” [White Supremacist]। মানে আমরা সাদারাই দুনিয়ার মধ্যে শ্রেষ্ঠ জাতি – এই ধারণা। এখানে সাদা বলতে ফর্সা হলেই হবে না। ককেশীয় ]Caucasian] নৃগোষ্ঠির  গায়ের সাদাচামড়ার অর্থে ‘সাদা’ হতে হবে।  ট্রাম্প দল হিসাবে নিজে রিপাবলিকান দলের লোক।  এর উপর নিজেকে  “সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদ” [White Supremacist] এর দিক ঝোঁক দেখানো! এটা স্বভাবতই এক ভয়ঙ্কর রেসিজম। কিন্তু ২০১৬ সালে নির্বাচন করতে আসার শুরু থেকেই এই ঝোঁক-অভিমুখ ট্রাম্পের সাথেই ছিল। তবে প্রথম দিকে খাপ ছাড়া বা অস্পষ্টতার কারণে সাধারণ্যে তা হয়ত স্পষ্ট হয়নি। যেমন ধরা যাক স্টিভ ব্যাননের [Steve Bannon] কথা। তিনি ছিলেন আগে ট্রাম্পের  ২০১৬ সালের নির্বাচনী ক্যাম্পেইনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। আর পরে ট্রাম্প প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণের পরে হন, প্রেসিডেন্ট অফিস হোয়াইট হাউজের প্রধান উপদেষ্টা হন ব্যনন। যদিও তিনি মাত্র সাত মাস এই পদে ছিলেন। আর এরপর ওই সৃষ্টপদটাই আবার অবলুপ্ত করে দেয়া হয়। রাজনৈতিক চিন্তার দিক থেকে এই ব্যানন ছিলেন ‘সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বড় নেতা, তাত্বিক। তবে প্রেসিডেন্টশীপের  শুরুর থেকেই তাঁর এত উগ্র অবস্থান ট্রাম্প নিতে পারেননি; তাই ব্যননকেই সরে যেতে হয়েছিল। যদিও ট্রাম্প যতই ক্ষমতামলের শেষের দিকে গেছেন ততই তিনি আরো বেশি ও প্রকাশ্যে সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী (হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট) গ্রুপের ওপর তাঁর নির্ভরশীলতা বাড়িয়ে গেছেন।

পরেরবার গত ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ট্রাম্প পরাজিত হলে এরপরের বাকি তিন মাস তিনি লাগাম ছাড়া, তিনি আর রিপাবলিকান না, যেন সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীদের মূল নেতা হয়ে উঠেন। আর এরই সবচেয়ে বড় প্রকাশ তিনি ঘটান ৬ জানুয়ারি ২০২১ সালে। ঐদিন সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদীরা আমেরিকান সংসদ বা কংগ্রেস [Congress] ভবন দখল করে নিয়েছিল ও এর শিখরে উঠে কংগ্রেস বিল্ডিংয়ে তাদের রাজত্ব কায়েম করে ছাদে দেয়ালে নাচানাচি-বিজয় প্রকাশ করেছিল। সরকারি হিসেবে ওদিন সাতজনের মৃত্যু ও কয়েকজনের আহত হওয়ার মধ্যে দিয়ে ঘটনা শেষ হয়েছিল।

সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা জাত-শ্রেষ্ঠত্ববাদী বলতে এরা কারাঃ
বাংলাদেশের মত পাঠকদের মধ্যে সাধারণ্যে ‘জাত শ্রেষ্ঠত্ব’ কথাটা অনেকের কাছে আবছা ধারণায় থাকতে পারে বা তা খুব একটা পরিষ্কার না এমন হতে পারে। তাই এনিয়ে আগে একটু কথা বলে নেই। শব্দটার মূল বিষয় ‘শ্রেষ্ঠত্ববাদিতা’ বা নিজেকে সব ব্যাপারে, অন্য এথনিক জনগোষ্ঠীর চেয়ে ধর্ম-জাতি ইত্যাদি যেকোনো দিকে শ্রেষ্ঠ-বোধ করার দাবি তুলে ধরে। ইংরেজিতে একটি শব্দ আছে সুপ্রিমেসিস্ট [Supremacist]। আর, ইংরেজি ‘সুপার’ বা সবার চেয়ে ভাল – এ ধারণা থেকে ‘সুপ্রিমেসিস্ট’ শব্দ তৈরি করা হয়েছে। এই সুপ্রিমেসিস্ট শব্দেরই খাস বাংলা হল শ্রেষ্ঠত্ববাদী। বলাবাহুল্য, সুপ্রিমেসিস্ট বা শ্রেষ্ঠত্ববাদী এগুলো নেতিবাচক শব্দ। এগুলো শুধু নেতিবাচক শব্দই নয়, এটাকে ইংরেজিতে বলে ‘ডেরোগেটরি’ [derogatory] শব্দ মানে, কাউকে – নিচা দেখানোর-  শব্দ। বাংলায় বললে কাউকে ইচ্ছা করে ‘নিচা দেখানোর’ জন্য এসব শব্দ ব্যবহার করা হয়।

কিন্তু কোন জনগোষ্ঠীর মানুষের নিজেকে অন্যদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ – এই বোধ তাদের কেউ কেউ আনে কেন? এটার দরকার কী?  আসলে যখন থেকে মানুষ টের পেয়েছে নিজের গায়-গতরের শ্রমে সম্পদ জোগাড়ের চেয়ে সহজ ভিন্ন পথ আছে; তখন থেকে শুরু হয়েছে এই সমস্যা। সেটা হল, অন্যের শ্রম-সম্পদ লুটে খাওয়া ও নেয়া, অন্যের কাঁধে চড়ে খাওয়া ইত্যাদির জন্য অন্য পুরো জনগোষ্ঠীকেই নিজ অধীনস্থ করা বা বাধ্য করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা।

কিন্তু তাতেও পেছনে আরো বড় কাহিনী আছে। দুনিয়াতে মানুষের থিতু হয়ে কৃষিকাজভিত্তিক জীবনযাপন শুরু করা বলা হয় মোটামুটি প্রায় ছয় হাজার বছর বয়সী। সে কারণে এখান থেকেই আমাদের তৎপরতাকে আমরা সভ্যতা বলি বা ‘সিভিলাইজেশন’-এর শুরু বলা হয়। আর দুনিয়াতে এমন সভ্যতার জীবন বা কৃষিকাজে মানে থিতু হয়ে কোনো ভূগোলে বসবাস শুরু করা, যাযাবর জীবন ত্যাগ করা- এসবই শুরু হয়েছিল আর এটাই সভ্যতার শুরু। আসলে অন্তত দশের অধিক বিভিন্ন সভ্যতা যারা প্রায় কাছাকাছি সময়ে (কিন্তু পরস্পর সম্পর্কে একেবারেই না জেনে, যোগাযোগ ছাড়াই) শুরু হয়েছিল। যেমন এসব সভ্যতার বিচারে আমরা ‘সিন্ধু সভ্যতার’ অংশ (যার মূল ভূখণ্ড এখন পাকিস্তানের অংশ)। আর এর ভেতরেও আবার অনেক নৃতাত্ত্বিক-জাতির জন্ম ও বিকাশ ঘটেছিল, যার মধ্যে আমরা বৃহত্তরভাবে সিন্ধু সভ্যতার অংশ হলেও এর ভেতরের “বাঙালি” – এই নৃতাত্ত্বিক-জাতির অন্তর্ভুক্ত বা অংশ। যেমন এশিয়ায় আমাদের কাছাকাছি সবচেয়ে প্রভাবশালী আরেক সভ্যতার নাম হল মেসোপটেমিয়া (বর্তমান ইরাক-কুয়েত), টাইগ্রিস ও ইউফ্রেটিস নদীর তীরের এই সভ্যতা।

আগের দিনে এথনিক জনগোষ্ঠীর মধ্যে বা সভ্যতাগতভাবে তাদের মধ্যে কোন সঙ্ঘাত হয়নি এমন নয়। তবে ধরনটা ছিল যেমন, দেখা গেছে দেশ যুদ্ধ-মারামারিতে অন্যের দখলে চলে গেছে পেয়েছে অথচ এরপর থেকে  দখলদারও সেই ভূমিতেই (যেভুমি থেকে সে এসেছে তা ফেলে) এর পর থেকে নিজেও বসবাস শুরু করেছে। এটাই প্রধান ধরণ ছিল। মোগল শাসকেরা এমন ধারার ছিল। তাই এতে সম্পদ পাচার বা নিজ পুরানা দেশে লুটে ফেরত নিয়ে যাওয়া এমন ফেনোমেনো তা ছিল না।   পরবর্তীতে টেকনোলজি বিকাশের সুযোগ নিয়ে এক কলোনি দখল যুগ (১৬০৭-১৯৪৫) শুরু হয়েছিল। আর এ্রতে একমাত্র দখলদার হাজির হয়ে যায় ইউরোপ যারা,  এশিয়া, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকা সব মহাদেশকেই কলোনি, নিজের শিকার বানিয়ে নিয়েছিল। প্রায় সাড়ে তিন শ’ বছরের এই লুটেরা শাসন চলেছিল। কিন্তু এটি বিশেষ লক্ষণীয় যে, এই প্রথম ইউরোপীয় কলোনিবাজ দখলদাররা দখলের পরে সাথে এ কাজের পক্ষে সাফাই বক্তব্যও দেয়া শুরু করেছিল। আর সেই প্রথম আমরা কে সভ্য আর কে নয় এ নিয়ে  শঠতাপুর্ণ তুলনা হতে দেখেছিলাম। আর এ থেকে দেয়া সাফাইটা হয় যেমন, এশিয়ায় আমাদের চেয়ে ইউরোপীয় দখলদাররা “ভালো সভ্য” বা “বেশি সভ্য” বলেই সবার আগে তাড়া দাবি করেছিল। পরে এই মিথ্যা  সাফাই দিতে শুরু করেছিল যে  “যেন তারা আমাদের সভ্যতা শিখাতেই আমাদের দেশ দখল করেছে। এ থেকেই শুরু হয় সভ্যতা শব্দটার শঠতা বা ছলনার নেতি ব্যবহার। যেন ইংল্যান্ড বৃটিশ-ইন্ডিয়া দখল করেছিল আমাদের সভ্যতা শিখাতে এসে আর এতে  আমাদের স্থায়ী মজুদ বা উদ্বৃত্ত সম্পদ সবই নিরন্তর লুট করে নিয়ে যাওয়াই ছিল তাদের কাজ।

আসলে সরাসরি বললে আমরা শ্রেষ্ঠ কিংবা আমরা অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ – এ ধারণা, এ অনুভবটা থেকেই সব অপরাধের উতস বা শুরু হতে পারে। কারণ আপনি হয়ত সতর্ক থাকলেন কিন্তু অন্যে হয়ত আপনার না করে দেয়া ধারণা-কথাটাই অন্য জনগোষ্ঠীকে পদানত বা অধীনস্থ করার সাফাই হিসেবে কেউ ব্যবহার করবেন।

যেমন আমেরিকাসহ পশ্চিমা দেশের ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’ ধরণের চিন্তাচর্চার ঘাঁটিঁ বা ফেবারেবল অঞ্চল। এদের মূল কথা হল, তাদের গায়ের চামড়ার সাদা (বলতে চায় সাদা ককেশীয় নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী) অতএব তাঁরা অন্য সব নৃ-গোষ্ঠির মানুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। যেখানে কেউ শ্রেষ্ঠ কিনা এটা অপ্রয়োজনীয় ও অপ্রমাণিত ধারণা, এর চেয়েও বড় কথা এর কারণে কাউকে লুটে নেয়া, নিজ অধীনস্ত করে নেয়া অথবা  একই দেশের ভিতরে সহ-নাগরিকের সাথে কাউকে বৈষম্য করা  ইত্যাদি সব এগুলো ক্রিমিনাল অপরাধ। অথচ কেউ যখন জাত শ্রেষ্ঠত্বের মুইথ্যা বড়াই করে সে আসলে ইঙ্গিতে বলতে চায় তাদের ন্রৃ-গোষ্ঠি চার-পাঁচ শ’ বছর ধরে অনেক জনগোষ্ঠীকেই অধীনস্থ করে রাখতে পেরেছিল তাই তারা এখনও শ্রেষ্ঠ। তবে একালে ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’ চিন্তা ফিরে জেগে ওঠার কারণ আরেকটু ভিন্ন।

গ্লোবাল ইকোনমি যেখানে পরিবর্তিত হচ্ছে এর অভিমুখ হল, চীনের উত্থানে আমেরিকান ইকোনমির পতন বা তাদের অন্ততপক্ষে রি-অ্যাডজাস্টমেন্ট (ভিন্ন কাজ ভিন্ন দেশ ইত্যাদি) একটি খুবই স্বাভাবিক বা প্রায়ই ঘটা ঘটনা হিসেবে উঠে আসছে। বড়লোক অবস্থাপন্ন অনেকেই তো বটেই, মিডল ক্লাসের ব্যবসা বা চাকরি প্রায়ই টলায়মান হয়ে উঠছে। আগের বাজার, আগের নিয়ন্ত্রণ আমেরিকার হাতে টিকে থাকছে না। আর এ’বস্থায় তাদের ‘হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট’ বয়ানটা  মুখরোচক হয়ে উঠে আসছে এমন যে, “আগে তারা সুন্দর দিন ‘কাটাইত”! কিন্তু অ-সাদা মানুষেরা সব নষ্ট করে দিয়েছে। মানে এখন কালো বা বাদামি চামড়ার লোকেরা তাদের পশ্চিমাদেশে এসে ছেয়ে ফেলাতেই নাকি তাদের চাকরি-ব্যবসার সব সুবিধা এরা নিয়ে গেছে।

আসলে, স্বভাবতই এখানে অর্থনৈতিক গ্লোবালাইজেশনের কারণ, পশ্চিমা দেশ থেকে সাদা চামড়ার মানুষ অন্য দেশে ব্যবসা-কাজের লোভে বেরিয়েছে বা অন্য চামড়ার কিন্তু সস্তা শ্রমিক বলে তাঁরা পশ্চিমা দেশে কাজ ও থাকার অনুমতি পেয়েছে। কিন্তু যেকোনো উগ্র জাতিবাদের মত এই হোয়াইট সুপ্রিমেসিস্টরা সত্য-মিথ্যা মিলিয়েই কথা বলবে। মূলকথাটা সোজা  – যখন পশ্চিমা কোনো দেশের অর্থনীতি ভাল চলে তখন বাইরের আমাদের মত দেশের সস্তা শ্রমিক পেতেই তো মাইগ্রেটেড শ্রমিক সে আমদানি করবে। কাজেই অ-সাদা চামড়াদের তখন ভালো লাগবে যখন পশ্চিমা দেশে অর্থনীতি ভালো চলবে। অতএব এর সাথে কোনো রঙের গায়ের চামড়ার মানুষ ভাল অথবা শ্রেষ্ঠ – এটা ডাহা মিথ্যা ও ভুয়া কথাবার্তা। কিন্তু তবু পশ্চিমের ঘৃণায়, নরওয়ে-তে হত্যা বা সর্বশেষ নেদারল্যান্ডসে মুসলমান বলে হত্যাকাণ্ডগুলো প্রায়ই উঠে আসছে।

আবার গ্লোবাল ইকোনমিতে  চীনা উথান ও চীন নেতা হলেই সেটা সাদা চামড়া জনগোষ্ঠীর মানুষেরা না খেয়ে মরবে, বা তাদের জন্য খারাপ ঠিক তা নয়। তবে সুযোগ সুবিধা কমে বা ভিন্ন হয়ে যেতে পারে। আবার তারাও এশিয়ায় মাইগ্রেটেড (লেবার, টেকনিশিয়ান বা যেকোনো স্পেশালাইজড) হলে তারাও ভালো করবে যেভাবে গত অন্তত শ’বছর আমরা এশিয়ানরা এভাবেই নিজেদের ভাগ্য খুলবার চেষ্টা করে এসেছি। তবে একটা জিনিষ, দুনিয়াতে গত প্রায় ছয়শ বছর ধরে একনাগাড়ে সাদা ককেশীয়দের একচেটিয়া শাসন চলে আসছে।  এখন গ্লোবাল ইকোনমিতে  পরিবর্তনের মোচড়ে যদি সাদা ককেশীয়দের একচেটিয়া শাসন দূর হয়ে যায় তাতে চীনের কী করার আছে??  আবার পশ্চিমাদেশের আধিপত্য চলে যাওয়া মানে সব হারানো তা তো নয়! আমেরিকা বৃ্টিশদের থেকে গ্লোবাল নেতৃত্ব নিয়ে নিয়েছে বলে লন্ডন তো পরিত্যক্ত শহর হয়ে যায় নাই। একালেও এখন অনেকেই নন্ডনে সেটেল হতে চাচ্ছেন। সৎ মনোভাব নিয়ে তাকালে অনেক কিছুই খারাপ লাগার কথা নয়!

একই সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের দুই রূপ ট্রাম্প ও বাইডেনঃ
ট্রাম্প সম্পর্কেই উপরে বেশি কথা লিখেছি তবে তাতে ট্রাম্পই কেবল খারাপ আর বাইডেন ভাল, তিনি জাত শ্রেষ্ঠত্ববাদী বা হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট নন অথবা কম? তাই কি? না, তা একেবারেই নয়।

তবে নতুন যেটা তা হল, বাইডেন তাঁর যুগে সবচেয়ে বড় হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট হিসেবে হাজির হতে চাইছেন। এটাই একালের সবচেয়ে বড় শিফট! এখন এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, বাইডেন আরো বড় হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট রাজনৈতিক পরিকল্পনা নিয়েই ২০২১ সালে্র জানিয়ারিতে শপথ নিয়েছিলেন। তা হলে ট্রাম্প ও বাইডেন দু’জনই কি সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদী? সাধারণ উত্তর হ্যাঁ-সূচক। কিন্তু তবু দু’জনের কাজের ফিল্ড বা ফোকাস ভিন্ন। যেমন, ট্রাম্প অভ্যন্তরীণভাবে মূলত আমেরিকার ভিতরে অর্থে হোয়াইট সুপ্রিমিস্ট। আর বাইডেন সারা পশ্চিমাশক্তি মিলে, যার মধ্যে ইউরোপীয় নেতারা শামিল আর ব্যতিক্রমী জাপানিজরা। তারা মনে করে, গত পঁচাত্তর বছরে  আমেরিকার পুরনো গ্লোবাল নেতৃত্ব তারা আরো কিছু দিন যেভাবেই হোক ধরে রাখবেন।

আরও পড়তে পারেন-

এতে বাইডেন এন্ড গংয়ের সবচেয়ে যেটা বড় বিভ্রম ও জিদ তা হল ইকোনমিক নেতৃত্বটা যেন সাবজেক্টটিভ বা ব্যক্তি ইচ্ছায় নির্ধারিত হয়। যেন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধটা প্রধানমন্ত্রী চার্চিল প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের দাসখতে রাজি বা বাধ্য না হয়েও বৃটিশ সাম্রাজ্য তার পুরনো গ্লোবাল অর্থনৈতিক কর্তৃত্ব ও নেতৃত্ব হিটলারের হাত থেকে চাইলেই বাঁচতে ও বাঁচাতে পারত। বাইডেন আসলে এর থেকেও এককাঠি উপর দিয়ে চলেছেন। বাইডেন মনে করছেন, পাঁচ-ছয় শ’ বছর ধরে সাদা চামড়ার শাসন দুনিয়ায় চলছে। এ শাসন চীনের (অ-সাদা) নেতৃত্বের তলে পড়তে পারে না, যেভাবেই হোক টিকিয়ে রাখতেই হবে – এই জবরদস্তির উসকানি দিয়ে বাইডেন নিজ গ্লোবাল নেতার সুপ্রিমিজম যেন তিনি ধরে বা টিকিয়ে রাখতে সফল হবেন – এই হল তার বাজনার মূল সুর!

কিন্তু বাইডেনের বিরুদ্ধে এসব অভিযোগের খাস প্রমাণ কী?
বাইডেন প্রশাসন এতদিন ঠিক কী বলে ইউরোপকে ইউক্রেন যুদ্ধে শামিল করেছেন, তা পাবলিকলি খোলাসা করেননি। যারা বারবার রাশিয়ান তেন-গ্যাস ছাড়া চলতে পারবে না বলে অনবরত বেঁকে বসছিল! কিন্তু বোঝা যাচ্ছিল বাইডেন নিজেদের সাদা শাসন হারিয়ে যাবে এমন ভয়-উস্কানি দেখিয়ে থাকতে পারেন। সম্প্রতি তা নিয়ে একটু ডিটেইল ব্যাখ্যা করেছেন বর্তমানে বাইডেন প্রশাসনের দুই মন্ত্রী কর্তা- পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন [Antony Blinken ] ও ট্রেজারি বা অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন [Janet L. Yellen], তবে দুই আলাদা আসরে। দুটোই লম্বা পলিসি বক্তব্য।  আটলান্টিক কাউন্সিল [Atlantic Council] নামে আমেরিকার এক থিংকট্যাংক আছে, এর এক বক্তৃতায় জ্যানেটের বক্তব্য গত ১৩ এপ্রিলে। জ্যানেটের দেয়া বক্তব্যের ট্রান্সক্রিপ্ট ওরেই তাদের সাইটে দিয়ে দিয়েছে এখানে।  আর ওদিকে ব্লিঙ্কেন জর্জ ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বক্তৃতা দিয়েছেন গত ২৬ মার্চ ২০২২। সেখানেই তিনি ‘চীনা সরকারের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের পলিসির রূপরেখা’ দিচ্ছেন বলে এ বক্তৃতা দিয়েছেন। ইইউ এর পলিটিকো মিডিয়া তার রিপোর্টের শিরোনাম দিয়েছে, “Blinken calls China ‘most serious long-term’ threat to world order”। এককথায় চীনকে ওয়ার্ল্ড অর্ডার মানে বিশ্বব্যবস্থার শৃঙ্খলার জন্য হুমকি বলে বর্ণনা করছেন ব্লিঙ্কেন। সোজা করে বললে, চীনা অর্থনৈতিক উত্থানে আমেরিকার কষ্ট হচ্ছে অথচ সেকথাটা ব্লিঙ্কেন লুকিয়ে হাজির করছেন এভাবে যে চীন ওয়ার্ল্ড ব্যবস্থার জন্য ফিট নয়!!!  আসলে বিশ্বব্যবস্থা গড়ে তোলা বা গড়ে যাবার প্রায় পচাত্তর বছর পরে এসে এসব কথা অর্থহীন!  আগ্রহিরা লেখা দুইটা সরাসরি পড়ে নিতে পারেন। আমি কিছু ক্যাচি অংশ তুলে আনব। 

এখনকার সার কথাগুলো বোঝা খুব কঠিন না। আমি ব্লিঙ্কেনে কিছু মুখ্য ভাব-শব্দ তুলে আনছি। মুখ্য শব্দগুলোর দিকে খেয়াল রাখলেই মূল বক্তব্য বুঝা যাবে। যেমন –

এক. ইউনিভার্সাল ভ্যালু [ …… Beijing’s vision would move us away from the universal values]; ইন্টারন্যাশনাল অর্ডার, ইন্টারন্যাশনাল রুল বেজড অর্ডার [we will defend and strengthen the international law, agreements, principles, and institutions that maintain peace and security] ;

দুই. ইকোনমিক অর্ডার, ইন্টারন্যশনাল ল, প্রিন্সিপাল ও প্রতিষ্ঠান;

তিন. রাশিয়ার সাথে চীনের অ্যালায়েন্স [……potential security risks to the U.S. and its allies posed by China’s alliance with Russia. ] ইত্যাদি।

এসব কিছুর সার কথা একটাই – দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে আজ পর্যন্ত যেন আমেরিকার নেতৃত্বে জাতিসঙ্ঘ ও আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক প্রভৃতি যেসব রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গ্লোবাল প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল চীন এগুলোর কেউ নয়। এ-সংক্রান্ত সব মূল্যবোধ ও ইউনিভার্সাল মূল্যবোধের বাইরে চীন।

তা হলে ব্লিঙ্কেন এখন কী করবেন?
তিনি স্বীকার করে বলছেন, ‘চীন হল একমাত্র দেশ যার আন্তর্জাতিক অর্ডার বদলে ফেলার ইচ্ছা ও সামর্থ্য আছে- যে সামর্থ্য বলতে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক, কূটনীতিক, সামরিক ও টেকনোলজিক্যাল সব বোঝায়। কিন্তু চীনের আর আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মূল্যবোধ এক নয়।’ [……“China is the only country with both the intent to reshape the international order and, increasingly, the economic, diplomatic, military and technological power to do it,” ]

তা হলে ব্লিঙ্কেনের প্রতি এখন প্রথম প্রশ্ন হল, যদি চীন আর আমেরিকার মধ্যে ন্যূনতম রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মূল্যবোধ বা কাম্য ও প্রতিষ্ঠিত দুনিয়ার নিয়ম-শৃঙ্খলা বা গ্লোবাল অর্ডারে মিল না থেকে থাকে তা হলে চীনের সাথে আমেরিকার এত দিন চলল কী করে? জাতিসঙ্ঘ গঠন হতে পেরেছিল কী করে? যদি ধরে নেই চীন (মাওয়ের চীন) পরে এসেছে, তবু জাতিসঙ্ঘের জন্মের থেকে সবচেয়ে প্রবল্ভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন সক্রিয় সদস্য ছিল। কিন্তু তাই বলে কী লুটেরা কলোনি মাস্টার (বৃটিশ-ফরাসির) ইউরোপ নিশ্চয় সেকালের প্রেসিডেন্ট রুজভেল্টের মূল্যবোধ ও অর্ডার-শৃঙ্খলা (ব্লিঙ্কেন কথিত) কায়েমের পক্ষে বা দোস্ত ছিল না। তা হলে এর পরেও সেকালের রুজভেল্ট একমাত্র সোভিয়েত ইউনিয়নকেই গোনায় ধরে গ্লোবাল অর্ডার সাজাতে হয়েছিল? তা হলে আজ অন্য যে কারও প্রতি বাইডেনের এত বিতৃষ্ণা কেন? এর সাফাই কই??  রুজভেল্ট কী জানতেন না যে সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা স্তালিন পাক্কা কমিউনিস্ট ছিলেন? তবু ব্লিঙ্কেন সাহেব আজ যে মুল্যবোধের বড়াই অমিল দেখছেন তা রুজভেল্ট আমলই করেন নাই। তা করলে তো জাতিসংঘের জন্মই হওয়ার কোন কারণ নাই। আর তা হয় নাই। কাজেই ব্লিঙ্কেন অবশ্যই অর্থহীন কথা বলছেন! মূলকথা রাজনৈতিক ভিন্নতা সত্বেও তাঁরা একসাথে জাতিসংঘ গঠন করেছিলেন। আর আজ ব্লিঙ্কেন নয়া বৈরাগী হতে চাইছেন, মুল্যবোধ বুঝাবুঝির তর্ক উঠিয়েছেন!!!

আবার চীনের কথায় আসিঃ  সত্তরের দশকে কিসিঞ্জারের আমেরিকা ১৯৭১ সালের জুলাইয়ে বাংলাদেশের স্বার্থসহ দুনিয়ার সব মূল্যবোধকেই পায়ে দলে চীনের মন পেতে কি গোপনে বেইজিং ছুটে যাননি? তখন সেটা কি আমেরিকার বৈষয়িক স্বার্থের ভিত্তিতে বাকি সবভুলে পা ফেলা ছিল না? তা হলে তখন আজকের তোলা মূল্যবোধের কথা কোথায় ছিল? ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বার্ষিক মিটিংয়ে মাওয়ের চীনকে ভেটোক্ষমতাসহ সদস্যপদ ফিরে দেয়া হয়।  আবার টানা সাত বছর (১৯৭১-৭৭) চীন-আমেরিকার নেগোসিয়েশন চলেছিল – উভয় উভয়কে যা কিছু সব বুঝে নেবার যথেষ্টের চেয়েও অতিরিক্ত সময়  দিয়েছিল। এই হিসাব শেষে ১৯৭৮ সালের ১ জানুয়ারি থেকে তাদের মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক চালু হয়েছিল। তা হলে তখনকার আরো কড়া কমিউনিস্ট চীনকে সহ্য হলে এখন লিবারেল চীনকে অসহ্য লাগা শুরু হবে কেন? আমেরিকান পুঁজি ওয়াল স্ট্রিটের সেকালে অবাধে চীনের বাজারে প্রবেশের সুযোগ পাওয়ায়, চীন অনুমতি দেয়ায় যদি তখন চীনকে ভালো মনে হয়ে থাকে – মূল্যবোধে কোনো সমস্যা না দেখা দিয়ে থাকে, তা হলে এখন এমন কী ঘটেছে সেটা অবশ্যই বাইডেন-ব্লিঙ্কেনকে আগে স্পষ্ট বলতে হবে। সুপ্রিমিজম করতে দেয়া হবে না।

আবার আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের ইস্যুতে যদিও চিয়াংকাইশেকের জাতিবাদী চীন ১৯৪৫ সাল থেকেই আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সদস্য।  কিন্তু ১৯৪৯ সালে মাওয়ের বিপ্লব হয়ে যায় মূল চীন ভূখণ্ডে। চীন জাতিসঙ্ঘেরও সাধারণ সদস্য ছিল না তখন। পরে ১৯৭১ সালে তাইওয়ানকে বাদ দিয়ে মূল চীন (জাতিসঙ্ঘ জন্মের সময়ের )ভেটো-ওয়ালা সদস্যপদ ফিরে পেয়েছিল। আর একইভাবে চীন আইএমএফ-বিশ্বব্যাংকের সক্রিয় মেম্বার হয়েছে ১৯৮০ থেকে। এমনকি মাওয়ের চীন, মূলচীন ডব্লিউটিওয়ের সদস্যপদ নেয় আরো পরে, ২০০১ সালে। তা হলে জাতিসঙ্ঘ বা আইএমএফ-বিশ্বব্যাংক ধরনের প্রতিষ্ঠানের ইন্টারন্যাশনাল মূল্যবোধ না বুঝে থাকাটার আর কি চীনের বুঝতে বাকি ছিল? আর মুল্যবোধ বুঝা নিয়ে কোন সময় কোন আপত্তি আমেরিকা তুলে নাই কেন? মুখ খোলার আগে ব্লিঙ্কেন কী এতটুকু বুঝেন নাই কথা বুঝে বলতে হয়!!! গুছিয়ে মিলিয়ে কথা বলতে হয়!!

আসলে এসব প্রশ্নের উত্তরে ব্লিঙ্কেনের খবর নেই। যেন তাদের কথা একটাই, তাদের সাদা চামড়ার নেতৃত্ব দুনিয়াতে তাদের স্থায়ী করে দিতেই হবে। না হলে চীনা মূল্যবোধ নিয়ে তারা প্রশ্ন তুলতেই থাকবেন???

সবশেষে, ব্লিঙ্কেন  সম্ভবত বুঝেছিলেন তারা কথার মেরুদণ্ড নেই – খামোখা কথা বলছেন। তাই এবার তিনি বলে বসেন, “চায়নার বন্ধু রাশিয়ার’ হুমকিতে তারা ভীত [security risks to the U.S. and its allies posed by China’s alliance with Russia]। অতএব, এটা চীনের দায়। ইউক্রেনের যুদ্ধও চীনের দায়!

এক কথায় বললে, সাদা চামড়া সুপ্রিমিজম, জাত শ্রেষ্ঠত্ব এর আওয়াজ তুলে এভাবেই ডুবে যাবে বাইডেনের আমেরিকা!! এ’ভিন্ন কোন পরিণতি নাই!

বাইডেন আসলে কোথায় যেতে চাইছেন? কোন বাস্তবোচিত কোন চিন্তা তিনি করতে পারতেছেন তা মনে হয় না। তবে খুব সম্ভবত বাইডেন-ব্লিঙ্কেন-জ্যানেট এদের যে এক অলীক কল্পনাটা আছে সেটা খুব সম্ভবত এই যে, কোল্ডওয়ার যুগের মত মুখ্যত, একটা মূল আইওএমএফ-বিশ্বব্যাংক কেন্দ্রিক বাণিজ্যের দুনিয়া আরেকটা বাকিদের ব্লক এর বাইরে; এমন দুটা ব্লকে দুনিয়া ভাগ করা। এমন শখ বা কল্পনা অনেকের মধ্যেই প্রায় দেখা যায়। কিন্তু হার্ড ফ্যাক্টস হল, দুনিয়াতে আর কখনও দুই অর্থনৈতিক ব্লক ফিরে আসবে না। চাইলেও ফেরা যাবে না।  দুনিয়ায় ফিরে আসবে না। মূল কারণ, আমরা এখন (১৯৯১ সালের পর থেকে) সব দেশই একই  আইওএমএফ কেন্দ্রিক বাণিজ্যের দুনিয়া চালু করে ফেলেছি। আমরা  আইওএমএফ বদল করে আরেকটা আইএমএফ বানাতে পারি, নামে বদল হিসাবে। কিন্তু আইএমএফ টাইপের কিছুই বানাবো না এটা হবে না। আর যেমন এক ঘরে দুটা পীর থাকতে পারে নাই, তাই দুনিয়াতে একসাথে দুটা ‘আইএমএফ’ থাকবে না।  মূলকথা, সকলকেই একই আইএমএফ (ধরণের প্রতিষ্ঠান) এর এবং এমন একটাই প্রতিষ্ঠানের সবাই সদস্য এভাবে – হয়েই থাকব!!

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক। ইমেইল- goutamdas1958@hotmail.com

[এই লেখাটা  দৈনিক  “নয়াদিগন্ত” পত্রিকার  ০৪ জুন  ২০২২ ওয়েবে আর পরদিন প্রিন্টে   ট্রাম্প ও বাইডেন, সাদা শ্রেষ্ঠত্ববাদের দুই রূপ“– এই শিরোনামে  ছাপা হয়েছিল।   ঐ ছাপা হওয়া লেখাগুলোকে আমার লেখার ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ বলা যায়।  আর আমার এই নিজস্ব সাইটের লেখাটাকে সেকেন্ড ভার্সান হিসাবে এবং  থিতু ভাষ্য বলে পাঠক গণ্য করতে পারেন।  আসলে পরবর্তিতে ‘ফার্স্ট ড্রাফট’ লেখাটাকেই এখানে আরও অনেক নতুন তথ্যসহ বহু আপডেট করা হয়েছে। ফলে সেটা নতুন করে সংযোজিত ও এডিটেড এক সম্পুর্ণ নতুন ভার্সান হিসাবে ও নতুন শিরোনামে এখানে আজ ছাপা হল।]

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।