Home সোশ্যাল মিডিয়া কুড়িগ্রামের বন্যা ও নদীভাঙন: জন্মের অভ্যর্থনা যেখানে গম্ভীর ও বিষন্ন!

কুড়িগ্রামের বন্যা ও নদীভাঙন: জন্মের অভ্যর্থনা যেখানে গম্ভীর ও বিষন্ন!

রনি সরকার: ‘আমার বাপ-ভাই ডুইবা মরে, তুমি একবারও নি খবর নিলা মাঝি?’ ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসে এভাবেই মালা তার স্বামী কুবেরকে বলেছিল, কারণ মালার বাপের বাড়ির এলাকাটি ছিল একেবারেই পদ্মা নদীর তীরবর্তী বন্যাকবলিত গ্রাম। তেমনিভাবে, কুড়িগ্রাম জেলা দিয়ে ভারতের প্রায় ১৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এ ছাড়া আরও দুটি আন্তসীমান্তীয় নদী এ জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত। বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি পানি বহনকারী ব্রহ্মপুত্র নদও কুড়িগ্রাম দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এসব নদীর কোল ঘেঁষে গড়ে উঠেছে কুড়িগ্রাম জেলাটি। প্রতি বর্ষা মৌসুমেই এ জেলায় ব্যাপক বন্যা হয়।

উত্তরবঙ্গের কয়েকটি জেলাকে একসময় মানুষ চিনত মঙ্গাপীড়িত এলাকা হিসেবে। তন্মধ্যে কুড়িগ্রাম অন্যতম, যার প্রধান কারণ হচ্ছে বন্যা ও নদীভাঙন। বন্যা ও নদীভাঙন কুড়িগ্রামের জন্য অনেকটা অভিশাপ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নদীগুলো ক্রমান্বয়ে হারাচ্ছে নাব্যতা। খালে, বিলে কোনোখানেই পানির ঠাঁই নেই। সবখানে দখলদারদের বাণিজ্যিক থাবা। আর এই বাণিজ্যিক থাবা আসে মূলত সরকারপন্থী দলের লোকদের থেকে। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিকরণে নেই কোনো দৃশ্যত পদক্ষেপ। নেই কোনো বিশেষ বরাদ্দ। এ জেলার মানুষ কি এতই অবহেলিত যে প্রতিবছরই বন্যার সঙ্গে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকতে হবে তাদের? বন্যায় মানুষ দিশেহারা হয়ে যখন নিরাপদ আশ্রয় খোঁজে, তখন আমাদের নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ আরাম–আয়েশে বিভাগীয় ও রাজধানী শহরে বসবাস করেন। একদিকে খাদ্যের চরম সংকটে ভোগা এসব মানুষ যখন জীবনযুদ্ধে নিমজ্জিত, তখন দেশের সরকারের শীর্ষ মহল থেকে শুরু করে স্থানীয় সংসদ সদস্যরা পর্যন্ত এসব মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান না। এমনকি ত্রাণ পর্যন্ত পায় না আমাদের এলাকার লোকজন।

সম্প্রতি সিলেট-সুনামগঞ্জে বন্যার সময় আমার দেখেছি, সব মিডিয়া ও দেশের প্রভাবশালী মানুষের নজর সিলেটের দিকে। সমস্ত ত্রাণ সিলেট ও সুনামগঞ্জের জন্য বরাদ্দ, কিন্তু কুড়িগ্রামের জন্য নেই কোনো বিশেষ দৃষ্টি। এত সব বৈষম্য রেখে কীভাবে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব? দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার বাড়ছে, কিন্তু তারপরও কুড়িগ্রাম কেন দারিদ্র্যসীমার নিচে, কেন নেই এ জেলার জন্য বিশেষ বরাদ্দ? এসব প্রশ্ন আজও আমাকে ভাবায়!

আরও পড়তে পারেন-

বাঁধ সংস্কারে সরকারের দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম আমরা এখন পর্যন্ত এ জেলায় লক্ষ করছি না। নদীর নাব্যতা বৃদ্ধিতে বিশেষ কিছু ব্যবস্থা থাকলেও তা সঠিকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে কি না, তার কোনো তদারকিও নেই। আমাদের কুড়িগ্রাম জেলা কৃষিনির্ভর ও বন্যাকবলিত এলাকা হওয়ায় আমন সেচের ওপর প্রান্তিক পর্যায়ের মানুষ তেমন নির্ভরও করতে পারে না। ফলে, একেবারে বন্ধ হয়ে যায় পরিবারের আয়–রোজগার। মানুষকে না খেয়ে থাকতে হয় দিনের পর দিন। আবার শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকায় বছরের অনেকটা সময় মানুষদের অলসভাবে দিনাতিপাত করতে হয়। এক দিকে বন্যার করাল গ্রাস, অপর দিকে বেকারত্ব এ অঞ্চলের মানুষের জীবনকে একেবারে পিষে দিচ্ছে।

এ বছর আগাম বন্যা ও বৃষ্টির কারণে শস্যের আবাদ ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু পর্যাপ্ত পরামর্শের অভাবে এই অপূরণীয় ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পুরোপুরি ব্যর্থ হবে এ অঞ্চলের জনগণ। আরও লক্ষণীয় যে বন্যার সঙ্গে বৃদ্ধি পেয়েছে নদীভাঙন। নদীভাঙন এ অঞ্চলের একটি স্থায়ী ও পুনঃসংঘটিত প্রাকৃতিক দুর্যোগ। নদী যত পরিণত পর্যায়ে এগোতে থাকে, ততই সেগুলো মন্থর ও বিসর্পিল আকৃতির হতে থাকে। নদীর এই দোলন নদীতীরের ব্যাপক ভাঙন ঘটায়, যার বাস্তব দৃষ্টান্ত কুড়িগ্রাম জেলায় উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণে প্রবহমান ব্রহ্মপুত্র ও ব্রহ্মপুত্রের শেষ প্রান্ত থেকে বিস্তর দক্ষিণে প্রবহমান যমুনা, খাঁড়া উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবহমান দুধকুমার এবং উত্তর-পশ্চিম হতে পূর্ব-দক্ষিণে প্রবহমান ধরলা ও তিস্তার ভাঙনে ফুটে উঠেছে। প্রতিবছর নদীভাঙনের কারণে হাজার হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। খেতের ফসল, ফসলি জমি ও বসতভিটা নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। আবহমানকাল ধরে এই জেলার ৯টি উপজেলায় নদীভাঙন ও বন্যায় দুর্ভোগ যেন নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজ কুড়িগ্রামের জাতীয় দারিদ্র্যের বড় কারণ এই নদীভাঙন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নদীভাঙনের কারণে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও বিপদাপন্ন লোকের সংখ্যা বিস্ময়করভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জেলাটিতে প্রতিবছর প্রায় ৪০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষভাবে নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। প্রায় ৯ হাজার গৃহহীন পরিবার খোলা আকাশের নিচে, পথের পাশে ও সরকারি খাসজায়গায় এসে আশ্রয় নিয়েছে। নদীবর্তী অঞ্চলে ভাঙনের ফলে গ্রামীণ কৃষিকাজ দারুণভাবে ব্যাহত হচ্ছে। ফলে এ অঞ্চলের মানুষেরা আর্থিকভাবে ভীষণ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এসব মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে আসতে সহায়তা করতে সরকারের কোনো উদ্যোগ নেই বললেই চলে। টেকসই দুর্যোগ মোকাবিলা অনেকটা নির্ভর করছে আমরা কতটা জোর দিচ্ছি প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানের ওপর। জলবায়ুজনিত দুর্যোগের কারণে কুড়িগ্রামসহ পুরো দেশের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। সুপরিকল্পনা গ্রহণ করে এখনই এসব দুর্যোগ মোকাবিলা করতে হবে। এ অঞ্চলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ ও কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। শুধু বন্যা ও নদীভাঙন নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হলে কুড়িগ্রাম জেলায় আর মঙ্গা ও দারিদ্র্যের প্রকোপ থাকবে না। হবে আমনের বাম্পার ফলন, লাঘব হবে এ অঞ্চলের প্রান্তিক মানুষের দুঃখ–কষ্ট এবং শান্তির নীড়ে ঘুমাবে এ অঞ্চলের মানুষ।

– রনি সরকার
শিক্ষার্থী, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর।

উম্মাহ২৪ডটকম: এমএ

উম্মাহ পড়তে ক্লিক করুন-
https://www.ummah24.com

দেশি-বিদেশি খবরসহ ইসলামী ভাবধারার গুরুত্বপূর্ণ সব লেখা পেতে ‘উম্মাহ’র ফেসবুক পেইজে লাইক দিয়ে অ্যাকটিভ থাকুন।